বিরোধীরা শাসকদলের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ তুলে পদত্যাগের দাবি জানায়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এটা কোনও নতুন ঘটনা নয়। কিন্তু সরকার চালাতে কে কত পারদর্শী, তা ক্ষমতায় এলেই তারিফ করা যায়। এই বিষয়টি কতটা সত্য, তা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থায় স্পষ্ট। শাসনক্ষমতায় থাকাকালীন হাসিনা সরকারের একাধিক ত্রুটি নিয়ে অভিযোগ তুলেছিল বিরোধীরা। উদ্দেশ্য ছিল, ছলে-বলে-কৌশলে তাঁকে গদি থেকে সরিয়ে ক্ষমতায় আসা। এজন্য ইউনূস পন্থীরা মৌলবাদী শক্তিকে কাজে লাগিয়ে ক্ষমতায় এলেও শাসনক্ষমতা পরিচালনায় তাঁরা কতটা পারদর্শী তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন প্রবাসে আত্মগোপন করে থাকা খোদ আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা।
সামাজিক মাধ্যমে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ইউনূসকে তুলোধোনা করেছেন মুজিব কন্যা। হাসিনার বিস্ফোরক অভিযোগ, বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সাহায্যে দেশ চালাচ্ছেন ইউনুস, আমেরিকার কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশকে। দেশ ছাড়ার প্রায় দশ মাস পর সামাজিক মাধ্যমে তাঁর পোস্ট নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে বাংলাদেশের রাজনীতিতে।
সম্প্রতি আওয়ামি লিগের ফেসবুক পেজে একটি অডিও বার্তা দিয়েছেন বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেখানে তাঁকে বলতে শোনা গিয়েছে, ‘সেন্ট মার্টিন দ্বীপ আমেরিকা চেয়েছিল। আমার বাবা রাজি হননি। তাঁকে জীবন দিতে হল। আমার ভাগ্যেও সেটাই জুটল। দেশ বিক্রি করে ক্ষমতায় থাকার চিন্তা কখনওই ছিল না আমার। যে দেশটা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে হাতে অস্ত্র তুলে নিয়ে, যুদ্ধ করে, ৩০ লক্ষ মানুষ জীবন দিয়ে স্বাধীন করেছেন, সেই দেশের মাটি কাউকে ছেড়ে দেওয়া কারও অভিসন্ধি হতে পারে না।’
সেই অডিও বার্তায় হাসিনা আরও বলেন, ‘আজ কী দুর্ভাগ্য! এমন এক ব্যক্তি ক্ষমতায় এলেন, তিনি নাকি গোটা দেশের খুব পছন্দের! বিশ্বের পছন্দের মানুষ। আজ তিনি ক্ষমতায় এসে কী হল? আমি তো এঁকে দরজা খুলে দিয়েছিলাম ’৯৬ সালে যখন সরকার গড়ি। আমার কাছেই তো হাত পেতেছিলেন। গ্রামীণ ব্যাঙ্কে নাকি টাকা নেই! টাকাগুলি যে সরিয়ে রেখেছেন, জানতাম না। এতবড় প্রতারণা ভাবতেই পারিনি। খুচরো ঋণ দেওয়া যাচ্ছে না বললেন, তখন বন্যাও। মোট ৪০০ কোটি দিয়েছিলাম। সেই টাকার কিন্তু কোনও হদিশ নেই। গ্রামীণ ফোরাম ব্য়বসার কথা বলা হল। ইউনূসের হাতেও সংস্থা দিলাম, কারণ প্রতিদিন ধর্না দিতেন। ওখান থেকেই টাকা মেরে খেল! ৬০০০ টাকা বেতনে যে ব্যক্তি ১৯৯০ সালে গ্রামীণ ব্যাঙ্কের এমডি-র চাকরি করতেন, তিনি দেশ-বিদেশে হাজার হাজার কোটির মালিক হলেন কী করে, সেই প্রশ্ন কেন জাগল না কারও মনে?’
ইউনূসকে ‘জঙ্গিনেতা’ বলে উল্লেখ করেন হাসিনা বলেন, ‘যে সংবিধান দীর্ঘ সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালিজাতি পেয়েছে, তাতে হাত দেওয়ার অধিকার এই অবৈধ ভাবে ক্ষমতা দখলকারী জঙ্গিনেতাকে কে দিয়েছে? যে ৭.৬২ রাইফেল-বুলেট, সেই অস্ত্র কার কাছে আছে? উদ্ধার হয়েছে কি? পাকিস্তান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে আসা জামাত-ই-ইসলামির অস্ত্র কি উদ্ধার হয়েছে? সে সব উদ্ধার না করে, পুলিশের অস্ত্র কেড়ে হাতে লাঠি ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তাঁদের জীবন বিপন্ন হচ্ছে আজ। যে ক্ষমতায় আছেন, তা দখল করা। মানুষের সমর্থন নেই, সাংবিধানিক ভিত্তি নেই, পদেরও কোনও ভিত্তি নেই।’
ইউনূসের প্রতি হাসিনার প্রশ্ন, সংসদ ছাড়া তিনি কী করে আইন তৈরি করেন? পাশাপাশি শিক্ষক-বিচারপতিদের উপর যে পড়ুয়াদের দিয়ে হামলা করানো হচ্ছে, সেই গোটা প্রজন্মের ভবিষ্যৎ কী, সেই প্রশ্নও তোলেন হাসিনা। বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও সীমান্ত নিরাপত্তা নিয়েও বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে ইঙ্গিত করেছেন আওয়ামী লীগ নেত্রী। তিনি বলেন, ‘আজ বাংলাদেশের সীমান্ত কোথায়? মায়ানমার সীমান্তে নিয়ন্ত্রণ নেই। লজ্জা হয় না, যে ক্ষমতায় থাকতে দেশের সার্বভৌমত্ব বিক্রি করে দিচ্ছে? কোথায় নিয়ে যাচ্ছে দেশটাকে? দেশের মানুকে বিপদের মুখে ফেলে দিয়েছে। মায়ানমার সরকার আক্রমণ করলে মানুষের জীবনে ধাক্কা এসে পড়বে। ক্ষমতার লোভী ইউনূস। ক্ষমতায় এসেই রোহিঙ্গা ফেরত পাঠাবে বলেছিলেন। আট মাসে ক’জনকে ফেরত পাঠাতে পেরেছেন? বরং আরও ১.৫ লক্ষ রোহিঙ্গা ঢুকে গিয়েছে। একটা প্রতিশ্রুতিও রাখতে পারেননি, শুধু মিথ্যে বাহানায় ভুলিয়ে রাখছেন। এভাবে একটা দেশকে শেষ হয়ে যেতে দেওয়া যায় না।’
প্রসঙ্গত সংরক্ষণ বিরোধী আন্দোলনের জেরে গতবছর হাসিনার সরকারের পতন ঘটে বাংলাদেশে। আর তার পরই বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে ক্ষমতায় আসীন হন ইউনূস। তিনি ক্ষমতায় আসার পর বেশ কিছু দিন ধরে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে নানা জল্পনা শুরু হয়েছে। একদিকে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন সম্পন্ন করতে হবে বলে সময়সীমা বেঁধে দিয়েছেন বর্তমান সেনা প্রধান। অন্যদিকে, বিএনপি-র তরফেও দ্রুত নির্বাচন করানোর জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছে বলে সূত্রের খবর। সেই আবহেই গতকাল কড়া বার্তা দেয় ইউনূস সরকার। ‘পরাজিত শক্তি’ ও ‘বিদেশি শক্তি’র ষড়যন্ত্র তত্ত্বে খাড়া করেন তাঁরা। সরকারের কাজে বাধা দেওয়া ও অযথা চাপ সৃষ্টি করার অভিযোগ তুলে হুঁশিয়ারি দিয়েছে ইউনুস সরকার। চলতি বছরের মধ্যে নির্বাচন করাতে সেনার চাপে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার ইস্তফা-জল্পনা নিয়ে তোলপাড় বাংলাদেশে। সেই জল্পনার মাঝে বাংলাদেশের মহম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার কড়া বার্তা দিয়েছে। ‘পরাজিত শক্তি’ ও ‘বিদেশি শক্তি’র ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব তুলে ধরেছেন তাঁরা। আর ঠিক সেই আবহেই ইউনূসকে কড়া ভাষায় পাল্টা আক্রমণ করলেন বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ইউনূস ‘আমেরিকাকে দেশ বিক্রি করে দিচ্ছেন’ বলে অভিযোগ করেছেন তিনি।
সেই প্রসঙ্গে হাসিনার বক্তব্য, ‘নিজের যত দুর্নীতির মামলা, গ্রামীণ ব্যাঙ্কের টাকা, শ্রমিকদের টাকা মেরে খাওয়ার মামলা, শ্রমিক আদালতে টাকা তছরুপের মামলায় সাজাপ্রাপ্ত ইউনূস। ক্ষমতায় এসে যত দুর্নীতির মামলা সব বাতিল করে দিয়েছেন, নিজেরটাও, বাকিদেরটাও। জঙ্গি, সন্ত্রাসীদের সাহায্যে ক্ষমতা দখল করেছেন। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও যারা নিষিদ্ধ, যাদের হাত থেকে বাংলাদেশের মানুষকে রক্ষা করেছিলাম আমরা, সবাইকে মুক্ত করে দিয়েছে। যত জঙ্গি, সন্ত্রাসী, খুনি, সব ছেড়ে দিয়েছে। দেশের জেলখানাও খালি। এখন বাংলাদেশে সেই জঙ্গিদের রাজত্ব। তাদের ব্যবহার করেই, আমাকে হত্যার চক্রান্ত করেই ক্ষমতা দখল করেছেন ইউনূস। শয়ে শয়ে শুধু মামলা করছেন আওয়ামি লিগ ও আমার নামে।’
হাসিনা লিখেছেন, ‘আওয়ামি লিগকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আর ইউনুস তা করেছেন সন্ত্রাসবাদীদের সাহায্য নিয়ে, তাদের তুষ্ট করতে। আমাদের সময় সন্ত্রাসবাদীরা হামলার সঙ্গে সঙ্গে পদক্ষেপ করেছি। অনেককে জেলবন্দি করা হয়েছে। আর এখন, জেলগুলো সব ফাঁকা। ইউনুসের সরকার সব জঙ্গিদেরক ছেড়ে দিয়েছে। বাংলাদেশ এখন জঙ্গিতে পরিপূর্ণ। তারাই সরকার নিয়ন্ত্রণ করছে। আর সেই সুযোগে ক্ষমতা উপভোগ করছেন ইউনুস।’
হাসিনা তাঁর পোস্টে গত বছর জুলাইয়ের ছাত্র আন্দোলনকেও বড় ষড়যন্ত্র বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁর বক্তব্য, ‘১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে যে হত্যাকাণ্ড ও অগ্নিসংযোগ শুরু হয়, তা ইউনূসের নির্দেশেই হয়। উনি যে হিসেব কষে এগিয়েছেন, তা নিজেই স্বীকার করেছেন। ছাত্র আন্দোলনের কোনও নেতা ছিল না। উনি মাস্টারমাইন্ড হিসেবে সূক্ষ্মভাবে গোটা বিষয়টির পরিকল্পনা করে ঘটিয়েছেন। হত্যাকারীরা দায়মুক্ত হয়েছে, মামলা হয়েছে আওয়ামি লিগের বিরুদ্ধে। এটা কোন ধরনের গণতন্ত্র, কোন ধরনের ন্যায়, কোন ধরনের স্বাধীনতা?’