• facebook
  • twitter
Monday, 28 July, 2025

তাইল্যান্ড পর্যটনের মডেল হতে পারে

পশ্চিমবঙ্গের চেয়েও জনসংখ্যা কম। সাড়ে সাত কোটির মতো। পর্যটনের পাশাপাশি তাইল্যান্ড চাষবাসেও প্রভূত উন্নতি করেছে। বিশেষ করে মাছ আর ফল চাষে তাদের আন্তর্জাতিক বাজারে এখন আলাদা কদর।

প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র

প্রবীর ঘোষাল

দেশের অনেক দ্রষ্টব্য স্থান দর্শনের সুযোগ হয়েছে। পর্যটক হিসাবে তার কিছু কিছু বর্ণনা এক পত্রিকাতে লিখেওছি। বিদেশে ভ্রমণের অভিজ্ঞতাও সমানভাবে পরিবেশন করেছি। তার জন্য পাঠকদের নানারকম অভিমত পেয়েছি। বাঙালির মতো ভারতের আর কোনও জাতির এমন ভ্রমণের নেশা আছে বলে তো মনে হয় না।

বিদেশ সফরের গল্প বলতে গিয়ে প্রথম পর্বে বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছি। তবে আমার বিদেশ সফরের কথা আলোচনা করতে গেলে, প্রথমেই এসে পড়বে তাইল্যান্ড। আসলে বাংলাদেশকে যতই বিদেশ বলি না কেন, কেমন যেন একটা দেশি দেশি গন্ধ রয়েছে ঢাকা-চট্টগ্রামে!

ঈশ্বরের আশীর্বাদে এবং আপনজনদের আন্তরিকতায় বহু দেশ ঘুরেছি। তাইল্যান্ড হল, পর্যটন-পরিকাঠামোয় অন্যতম সেরা দেশ। অন্তত আমার অভিমত তাই। পাঁচবার গিয়েছি। ব্যাঙ্কক-পাটায়া হচ্ছে চিপ অ্যান্ড বেস্ট। তাইল্যান্ডের এই দুটি জায়গায় মধ্যবিত্ত-ধনী সবাই ভ্রমণ করতে পারে। আমাদের যেমন দিঘা-দার্জিলিং। আবার ও দেশে বেশ কিছু পর্যটন কেন্দ্র আছে, যেখানে পৃথিবীর বহু ধনী ব্যক্তির ফ্ল্যাট রয়েছে। বিলাসবহুল রিসর্টেও বিনোদনের অঢেল ব্যবস্থা আছে। যারা বলে তাইল্যান্ড মানে সেক্স-ট্যুরিজম, তাদের সঙ্গে আমি মোটেই একমত নই। পর্যটনের সব ব্যবস্থা ওদেশে পরিপাটি। পরিবহন, রাস্তাঘাট, হোটেল-রেস্তোরাঁ সবই দেখার মতো। এমন পরিকাঠামো অন্য অনেক দেশেই দেখিনি।

চলতি দশকের গোড়াতেই প্রথম তাইল্যান্ড যাই। সেটা ছিল, ডাক্তারদের একটা অনুষ্ঠান। ইন্ডিয়ান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (আইএমএ) সভাপতি নির্বাচিত হলেন ডা. সুদীপ্ত রায়। দীর্ঘদিনের শ্রীরামপুরের বিধায়ক এবং আমাদের আপজন। সভাপতির চেয়ারে বসে সুদীপ্তবাবু সংগঠনের প্রথম কর্মসমিতির বর্ধিত বৈঠক করবেন। ট্যুর অপারেটরের কাছে এই বৈঠকের স্থান নির্বাচনের জন্য আইএমএ-র কর্মকর্তারা আলোচনায় বসেন। প্রস্তাব আসে, গোয়ায় এই বৈঠকের ব্যবস্থা হলে কেমন হয়? ট্যুর অপারেটর পাল্টা প্রস্তাব দেন, গোয়ার চেয়ে কিছুটা হলেও কম টাকায় ব্যাঙ্কক-পাটায়া করে দেওয়া যাবে। তা শুনে আইএমএ-র কর্তারা অবাক হলেও, সেই প্রস্তাব গ্রহণ করেন।

২০০৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে আইএমএ-র প্রায় জনা পঞ্চাশেক চিকিৎসকের সঙ্গী হয়ে কলকাতার দুই সাংবাদিক আমি এবং কিংশুক প্রামাণিক ব্যাঙ্কক রওনা হই। কিংশুকও আমার মতো ভ্রমণ-পাগল মানুষ। খুব ঘুরে বেড়ায়। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে গত কয়েকবছর কিংশুক বেশ কিছু বিদেশ সফরও করেছে। আমরা ব্যাঙ্ককে নেমে বিমানবন্দর দেখেই মুগ্ধ হয়ে যাই। ৫০টিরও বেশি কাউন্টার। ইমিগ্রেশনের কোনও সমস্যাই নেই। এমনকি ভিসারও ব্যবস্থা হয়ে যাচ্ছে। আমাদের সঙ্গে যাওয়া কয়েকজন চিকিৎসক তো ব্যাঙ্কক বিমানবন্দরেই অন অ্যারাইভাল ভিসা বানালেন। ঘণ্টাখানেক সময় লাগল। এই যা। বর্তমানে ভারতীয়দের তাইল্যান্ডে গেলে কোনও ভিসাই লাগে না। এরকম ব্যবস্থা বহু দেশের সঙ্গেই দিল্লির বিদেশমন্ত্রক করে ফেলেছে।

যে কোনও দেশে পর্যটকরা বিমানবন্দরে নেমেই টের পেয়ে যায়, সে দেশের পর্যটন পরিকাঠামো কেমন। আগেই বলেছি, একবার নয়, পাঁচবার তাইল্যান্ড গিয়েছি। গত বছরের একটা অভিজ্ঞতা শোনাই। আমরা দলে ছিলাম ১৪ জন। ব্যাঙ্কক বিমানবন্দরে নেমে ইমিগ্রেশনের জন্য লাইনে দাঁড়িয়েছি। আমাদের টিকিট দুটি পাতায় ভাগ করা ছিল। কাউন্টারে গিয়ে টের পাই, আমাদের হাতে যে কাগজটি রয়েছে, তাতে স্ত্রী রিঙ্কু এবং আমার নাম নেই। সেটা দেখিয়ে কাউন্টারে বসা কর্মী কিন্তু আমাদের লাইন থেকে বার করে দিলেন না। সেই তাই যুবক হেসে জানতে চাইলেন, ‘আপনারা দলে ক’জন আছেন?’ বললাম, ‘১৪ জন।’ বিমানবন্দরের ওই কর্মী কম্পিউটার মেশিনে চোখ রেখে টাইপ করতেই বেরিয়ে এল, অন্য পাতার টিকিটে আমাদের নাম। সহজেই ইমিগ্রেশনের কাজ মিটে গেল।

কিন্তু আমাদের দেশে বিমানবন্দরগুলিতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা থেকে শুরু করে অন্যান্য কাজে যাত্রীদের কিরকম দুর্ভোগে পড়তে হয়, অনেকেরই সেটা মালুম হয়েছে। আমরা একবার দুবাই যাচ্ছিলাম। কোভিড কমে গেলেও, কিছু কিছু বিধিনিষেধ যাত্রীদের ওপর তখনও আরোপ করা ছিল। আমরা সবাই (১২ জন ছিলাম) কোভিডের নির্দিষ্ট পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাগজপত্র নিয়ে দিল্লির বিমানবন্দরে হাজির হয়েছিলাম। টিকিট নিয়ে লাইনে দাঁড়িয়েছি। কাউন্টারে কোভিডের কাগজও জমা দেওয়া হল। কিন্তু বিমানবন্দরের কর্মী জানিয়ে দিল, এইসব কাগজ চলবে না। সেখানে বিমানবন্দরের মধ্যে গ্যাঁটের কড়ি নতুন করে খরচ করে কোভিডের পরীক্ষার কাগজ আনতে হবে। কেবল বাড়তি খরচ নয়, আমাদের বিমান টেক-অফ করতে হাতে মাত্র ২ ঘণ্টার মতো সময় আছে। বিনা মেঘে বজ্রাঘাত। দিল্লির বিশাল বিমানবন্দরের একেবারে অন্য ধারে রয়েছে কোভিড টেস্টের কাউন্টার। দলবল নিয়ে ছুটলাম সেখানে। কর্মীদের হাতে টাকা গুঁজে দিয়ে নতুন রিপোর্ট নিই এবং হাঁফাতে হাঁফাতে এসে কোনওক্রমে বিমানে উঠতে পেরেছিলাম।

পর্যটন শিল্পের প্রসারে পরিকাঠামো কীভাবে তৈরি করতে হয়, সেটা তাইল্যান্ডের কাছ থেকে আমাদের শিখতে হবে। ওদের চেয়ে প্রাকৃতিক সম্পদ আমাদের অনেক বেশি। পাহাড়-পর্বত, বন-জঙ্গল থেকে নদী-সমুদ্র সবই আছে। কিন্তু পরিকাঠামো পর্যাপ্ত নয়। তবে আশার কথা, ভারতে বেসরকারি উদ্যোগে পর্যটন দ্রুত উন্নতি করছে। সম্প্রতি কলকাতায় বেঙ্গল ট্যুরিজম ফেস্টের তিনদিনের পর্যটন মেলা হয়ে গেল। সেখানে ৮টি রাজ্যের সরকার স্টল দিয়েছিল। সব মিলিয়ে প্রায় ১৩০টি স্টলে দেশ-বিদেশ ঘোরার আগ্রহ নিয়ে প্রচুর দর্শক হাজির হয়েছিলেন। যদিও সেখানে বহু পর্যটকেরই প্রশ্ন ছিল, কেন আমরা পরিকাঠামোয় এত পিছিয়ে আছি?

তাইল্যান্ডের যেটুকু প্রকৃতি আছে, তাকে পর্যটকদের কাছ আকর্ষণীয় করতে চেষ্টার ত্রুটি রাখে না সে দেশের সরকার। গত ১৫-২০ বছরে কত নতুন নতুন পর্যটন কেন্দ্র ওরা তৈরি করেছে। সারা পৃথিবীর পর্যটকদের তারা টেনে আনছে। ওরা চিড়িয়াখানার বৈচিত্র্য আনতে দেশের নানা প্রান্তে অ্যানিমাল-শোয়ের ব্যবস্থা করেছে। হাতি-বাঘ-ভল্লুক থেকে শুরু করে কুমির-সাপ-পাখি কী নেই? কাঞ্চনাবুড়ি নামে বছর দশেক আগে আমরা তাইল্যান্ডের একটি অঞ্চলে গিয়েছিলাম। সেখানে টাইগার-টেম্পল নামে একটি বৌদ্ধ মন্দির আছে। এমনিতে তাইল্যান্ডে খুব নামকরা অনেকগুলি বৌদ্ধমন্দির আছে। বহু পর্যটক সেসব মন্দির দর্শন করে। যে মন্দিরের কথা বলছি, সেই মন্দির সংলগ্ন আশ্রমে বাঘেদের সঙ্গে পর্যটকদের ‘খেলা’ করার সুযোগ দেওয়া হত। আমরা তো দল ভাগ করে ১৫ মিনিট সময় ধরে বাঘেদের সঙ্গে নিজেদের ক্যামেরায় ভিডিও রেকর্ডিং করেছিলাম। সব পর্যটকদের জন্যই অর্থের বিনিময়ে এই সুযোগ বরাদ্দ ছিল।

বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের তত্ত্বাবধানেই সেই বাঘ-মন্দির পরিচালিত হত। এক সন্ন্যাসীর কাছে জানতে চেয়েছিলাম, এই বাঘেরা মানুষকে আক্রমণ করে না কেন? জবাবে তিনি বলেছিলেন, এদের ফুড হ্যাবিটই আলাদা। বাল্যকাল থেকেই ওদের মাংসের সঙ্গে নানা সবজি সেদ্ধ করে খাওয়ানো হয়। বাঘের বাচ্চারা শিশুকাল থেকেই মাংস পেলেও, রক্তের স্বাদের থেকে তারা দূরেই রয়ে যায়। তাই বাঘেরা হিংস্র হয় না। এই বিচিত্র চিড়িয়াখানা দর্শনের আগে টেলিভিশনে থাই বৌদ্ধ মন্দিরের ভিডিও দেখতাম। সেখানে দেখা যেত, পোষমানা বাঘেদের নিয়ে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা বাজারে যাচ্ছেন। পোষা কুকুরের মতো পোষ্যদের গলায় চেন লাগানো।

তবে, আমরা ভাগ্যবান। কারণ, কয়েক বছর আগে কাঞ্চনাবুড়ির বিখ্যাত সেই টাইগার-টেম্পল বন্ধ হয়ে গিয়েছে। বাঘ সংক্রান্ত ব্যবসাজনিত কিছু গুরুতর অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ওয়াইল্ড লাইফ দপ্তর বৌদ্ধ মন্দিরের চিড়িয়াখানায় তালা ঝুলিয়ে দেয়।
তবে, তাইল্যান্ডে তো পর্যটকদের আকর্ষণ করার কেন্দ্র একটা নয়, প্রায় ১৫-২০টি। ফুকেট, ক্রাবি, চিয়াং মাথ, কো-সামুইয়ের মতো অনেক পর্যটন কেন্দ্র রয়েছে, যেখানে প্রায় সারা বছর বিদেশি পর্যটকরা এসে থাকেন। খরচও কম নয়। কিন্তু ধনী পর্যটকও তো পৃথিবীতে কম নেই। ক্র্যাবির মতো বিলাসবহুল অঞ্চলে বিমানবন্দরে যাত্রীদের ভিড় দেখে অবাক হয়েছিলাম। তাদের মধ্যে সিংহভাগই বিদেশি। শীতকালে পূর্ব ইউরোপের বহু বিদেশি কয়েকমাস ধরে বাড়ি ভাড়া নিয়ে তাইল্যান্ডে দু-তিন মাস সপরিবারে কাটিয়ে যান। কারণ, তাদের দেশ তখন বরফে ঢেকে যায়। জীবন অচল হয়ে পড়ে।

পশ্চিমবঙ্গের চেয়েও জনসংখ্যা কম। সাড়ে সাত কোটির মতো। পর্যটনের পাশাপাশি তাইল্যান্ড চাষবাসেও প্রভূত উন্নতি করেছে। বিশেষ করে মাছ আর ফল চাষে তাদের আন্তর্জাতিক বাজারে এখন আলাদা কদর। তাই ম্যাসাজ, তাই ফুডের মতো ওদের বাগানের পেঁপে, পিয়ারা থেকে নানা ফলমূল এখন ভারতের বাজার ছেয়ে ফেলেছে। কলকাতাও তাই।

তাইল্যান্ডের নামে বদনাম আছে সেক্স ট্যুরিজম নিয়ে। কোনও সন্দেহ নেই ওদেশে যৌন ব্যবসা ভীষণ সচল। কিন্তু তারও নিয়ন্ত্রণ আছে প্রশাসনের হাতে। তাছাড়া গোটা দুনিয়ায় ট্যুরিজমের সঙ্গে সেক্স এখন হাত ধরাধরি করে চলছে। কিন্তু সাধারণ পর্যটকদের কোনওভাবে বিরক্ত হতে হয় না যৌনকর্মীদের হাতে। কড়া আইনে তাইল্যান্ড সহ অন্যান্য দেশে অপরাধীদের সাজা দেওয়া হয়। হল্যান্ডের রাজধানী আমস্টারডাম ইউরোপের মধ্যে সবচেয়ে মহা-মস্তির শহর বলে খ্যাত। সেখানে রেড-লাইট ডিস্ট্রিক্ট নামে শহরে একটি এলাকা আছে। ওই অঞ্চল আমস্টারডামের সবচেয়ে বিলাসবহুল হিসাবে পরিচিত। হোটেল-রেস্টুরেন্টের চড়া দর। সারারাত গমগম করে রেড লাইট ডিস্ট্রিক্ট। সেখানে এক বাংলাদেশি রেস্টুরেন্টের মালিক আমাকে বলেছিলেন, ‘নোংরামির নামগন্ধ নেই। প্রশাসন সর্বদা সজাগ।’