পর্ব – ৫
আমরা দু’জন প্রবেশ-দ্বার পেরিয়ে পৌঁছলাম মূল মন্দিরে। দুই ধাপ উপরে মন্দিরের প্রশস্ত বেদী– তার উপরে ছোট, সুন্দর এক মন্দির। মন্দিরের থাম ও বেদী গৈরিক বর্ণের। দুই থামের মাঝে রঙিন মালা শোভা পাচ্ছে। মন্দিরের পিছনে দাঁড়িয়ে সুউচ্চ গাছগুলি যেন আকাশ ছুঁতে চাইছে। শান্ত, নির্জন মন্দিরে তখন রয়েছেন শুধুই প্রবীণ পূজারী। মন্দিরের ভিতরে কৃষ্ণবর্ণের পাথরে ক্রমশ প্রকট হওয়া ভবিষ্যবদ্রিকে দর্শন করে বিস্ময়াবিষ্ট হয়ে গেলাম। আরও অবাক হলাম, বিষ্ণুমূর্তির দুই পাশে ক্রমশ প্রকটমান অন্যান্য দেবমূর্তি দেখে। তাই আজ ভবিষ্যবদ্রির নরসিংহরূপী শিলাটিকে ‘বদ্রি পঞ্চায়েত’ও বলা হয়। আগামী রূপের বদ্রিনারায়ণকে প্রণাম জানালাম নতজানু হয়ে।
প্রবীণ পূজারী লক্ষণ সিং বললেন, চাইলে আমরা তাঁর মন্ত্রপাঠের ভিডিও ক্লিপ বানাতে পারি। আমরা সানন্দে তাঁর মন্ত্রপাঠের একটা ছোট ভিডিও ক্লিপ বানিয়ে তাঁকে দেখালাম। বুঝলাম, পূজারীজি বেশ আধুনিক মানসিকতার অধিকারী। এবার আমাদের প্রসাদ দেবার সময় কথায় কথায় তিনি জানালেন, কুড়ি বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনি এই মন্দিরে বিষ্ণুদেবের পুজো করছেন। শুরুতে এই কৃষ্ণবর্ণের মূর্তি ছিল শুধুই একটি কালো পাথর– তখন না সেটাকে মালা পরাতে পারতেন, না পারতেন মুকুট পরাতে। অথচ, সেইদিনের সেই পাথর আজ ক্রমশ বড় হয়ে বিষ্ণুদেবের রূপে প্রকট হচ্ছেন। আজ তাঁর মাথায় মুকুট এবং গলায় মালা পরানো যাচ্ছে। আমরা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে দেখলাম, ক্রমশ প্রকটমান বিষ্ণুমূর্তির মাথায় স্বর্ণবর্ণের মুকুট এবং গলায় তুলসীপত্রের মালা। মূর্তির নিচে, ডানপাশে রত্নখচিত রুপোর মুকুট। কৃষ্ণবর্ণের শিলাটিকে আরও ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে বুঝলাম, মূর্তিতে এখনও পর্যন্ত হাত ও পা প্রকট হয়নি। ঠিক তখনই লক্ষণজি বললেন, আরও দশ বছর পরে এলে হয়তো আমরা পূর্ণাঙ্গ বিষ্ণুমূর্তির দর্শন পাব।
ভাবছিলাম, মাটির নিচে অবস্থিত কোনও শিলা ভূমিস্তরের পরিবর্তনজনিত চাপে মাটির উপরে উঠে আসতেই পারে। কিন্তু সেই শিলাগাত্রে বিভিন্ন বিগ্রহের মূর্তি বহু বছর ধরে ধীরে ধীরে প্রকটিত হচ্ছে কোনও শিল্পীর ছেনি-হাতুড়ির সাহায্য ছাড়া– বিজ্ঞান ও যুক্তি দিয়ে এই ব্যাপারটিকে ব্যাখ্যা করতে পারছি না কিছুতেই। তখনই মনে পড়ল, স্কন্দপুরাণের সেই ভবিষ্যবাণী- কলিযুগের শেষে বদ্রিনারায়ণ মন্দিরে যাওয়ার রাস্তা অগম্য হয়ে যাবে, মন্দিরও বিলুপ্ত হবে এবং নরসিংহ রূপে বিষ্ণুদেবের পুজো শুরু হবে ভবিষ্যবদ্রিতে।
সিঁড়ি দিয়ে নেমে কিছুদূর হেঁটে পৌঁছলাম একটি চায়ের দোকানে। ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে, ঠান্ডাটা বেশ বেড়ে গিয়েছে। আমার গায়ে একটা পাতলা টি-শার্ট। গরম চায়েও তাই শীত কমছে না। মোহন তার ন্যাপস্যাক থেকে একটা হালকা পুলওভার বার করে আমাকে দিল। আমি সেটা গায়ে চাপিয়ে তবেই আরাম পেলাম। চা শেষ করে গাড়িতে উঠে বসলাম।
তপোবন পেরিয়ে ধৌলীগঙ্গা নদীর উপরি ভাগে দেবদারু ও পাইনের ঘন জঙ্গলের মাঝে অবস্থিত ভবিষ্যতের বদ্রিনাথ মন্দির। আমরা ফিরে চলেছি একই পথে। পেরিয়ে গেলাম রিঙ্গি। তপোবন অঞ্চলে ফিরে এলাম বিকেল ৪টে নাগাদ। গাড়ি থামিয়ে হিমালয়ের ছবি তুললাম কয়েকটা। আর্মি ক্যাম্প পেরিয়ে দেখছি ধৌলীগঙ্গার উপরে এনটিপিসি ব্যারেজ সাইট।
যোশিমঠে পৌঁছলাম বিকেল পৌনে ৫টায়। গাড়িভাড়ার টাকা মিটিয়ে হোটেলে ফিরে এলাম। জয়দীপ ফোনে জানিয়েছে, সকাল সোয়া ৬টায় গাড়ি নিয়ে চলে আসবে। রাত সাড়ে ৮টা নাগাদ একটা হোটেলে ডিনার করতে গেলাম। ভোরে উঠব, তাই ঘণ্টাখানেক পরেই শুয়ে পড়লাম।
২০/৫/২০২৪ – বদ্রিনাথধাম, যোগবদ্রি এবং বিষ্ণুপ্রয়াগ দর্শন
ভোর ৫টায় উঠে চা খেয়ে নিলাম। একে একে স্নান সেরে, বারান্দায় এসে নৃসিংহনাথ মন্দির দর্শন করলাম। সকাল ৬টা ২০ নাগাদ জয়দীপ গাড়ি নিয়ে হোটেলে পৌঁছল। সাড়ে ৬টায় আমরা বদ্রিনাথ ধামের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলাম।
চেনা রাস্তায় গাড়ি চলেছে। মাঝে একবার চারধাম রেজিস্ট্রেশন জনিত চেকিং হল। কর্নেল মোহনের ভারতীয় সেনাবাহিনীর পরিচয় পত্রের সুবাদে আমাদের চেকিং হল না। পৌনে ৮টায় এসে পৌঁছলাম হনুমান চটি-তে। পবননন্দনকে প্রণাম জানিয়ে এবং প্রসাদ পেয়ে আমরা আবার এগোলাম বদ্রিনাথের পথে। কাঞ্চনগঙ্গা পেরিয়ে আমরা ১০,০০০ ফুটের বেশি উচ্চতায় চলে এসেছি। বাঁ-দিকে পরপর ছোট-বড় গ্লেসিয়ার চোখে পড়ছে। বদ্রিনাথ পৌঁছলাম পৌনে ৯টায়। গাড়ি থেকে নেমে দ্রুত এগিয়ে চললাম বদ্রিবিশাল দর্শনের লাইনে দাঁড়াব বলে। সুদীর্ঘ লাইনের পেছনে এসে আমরা দু’জনে দাঁড়িয়ে পড়লাম।
বদ্রিনাথ মন্দিরে আজ জনসমুদ্র বললেও অত্যুক্তি হয় না। আমরা দাঁড়িয়েছি অন্তত ৭০-৮০ হাজার দর্শনার্থীর পিছনে– সামনের লাইনের পাশে প্রথমে বাঁশের, পরে মোটা নাইলন দড়ির ব্যারিকেড। লাইন কখনও এগোচ্ছে ধীরে, কখনও থেমে যাচ্ছে। পৌনে ১০টার মধ্যে আমাদের পিছনে আরও ২৫-৩০ হাজার পূণ্যার্থী দাঁড়িয়ে পড়েছেন। লাইনের ডান পাশে বহু অস্থায়ী দোকানে বিক্রি হচ্ছে লেবুর শরবত, কোল্ড-ড্রিঙ্কস, বিস্কুট, আলু-চিপ্স ইত্যাদি টুকিটাকি। বহু স্বেচ্ছাসেবীর সহায়তায় বিশৃঙ্খলা একেবারেই কম। আমরা মূল মন্দিরে এসে পৌঁছলাম দুপুর ২টো নাগাদ এবং প্রচণ্ড ভিড়ের মাঝেও বদ্রিবিশালজির দর্শন পেলাম ভালোভাবে। ক্লান্ত ও ক্ষুধার্ত হয়ে নিকটস্থ একটা হোটেলে, দক্ষিণ ভারতীয় ভেজ-থালিতে লাঞ্চ সারলাম। জয়দীপকে ফোন করে জেনে নিলাম কোথায় আমাদের গাড়ি। গাড়িতে বসে এসির ঠান্ডায় পাঁচ মিনিট বিশ্রাম করে আমরা এগোলাম যোগবদ্রির পথে।
বদ্রিনাথ মন্দিরের স্থাপত্যে উত্তর ভারতীয় রীতির সুস্পষ্ট প্রভাব– ভাস্কর্যে জটিল খোদাই ও বহু চিত্রের সমাহার। মন্দির গাত্রে বিভিন্ন উজ্জ্বল বর্ণের উপস্থিতিতে তিব্বতি রীতির প্রভাবও যথেষ্ট। মূল মন্দিরকে ছাড়িয়ে উপরে উঠেছে শিখর। মন্দিরে যাওয়ার পথ বিরাট খিলানযুক্ত প্রবেশদ্বারের মধ্য দিয়ে, যেগুলো সজ্জিত জটিল খোদাই ও ভাস্কর্যে।
এগিয়ে চলেছি পাহাড়ি প্রকৃতি ও গ্রাম্য পরিবেশের মাঝখান দিয়ে। বিকেল ৪টে নাগাদ পৌঁছে গেলাম পাণ্ডুকেশ্বরে অবস্থিত যোগবদ্রির কাছে। গাড়ি থেকে নেমে যোগবদ্রির প্রবেশদ্বার পেরোলাম। সংলগ্ন সিঁড়ি দিয়ে নেমে কিছুদূর হেঁটে পৌঁছলাম প্রাচীন যোগবদ্রি ও বাসুদেব মন্দিরের কাছে। যোশিমঠ থেকে ২৪ কিমি দূরে পাণ্ডুকেশ্বরে অবস্থিত যোগবদ্রি মন্দির, বদ্রিনাথ মন্দিরের সমসাময়িক। দুই মন্দিরেই বিষ্ণুমূর্তি যোগমুদ্রায় আসীন। ভগবান বিষ্ণু জনকল্যাণের স্বার্থে এই স্থানেই গভীর ধ্যানে লিপ্ত ছিলেন। মন্দিরে কৃষ্ণপাথরে নির্মিত বিষ্ণুদেবের মূর্তিটি ফুল, পোশাক ও অলঙ্কারে ভূষিত, মাথায় রুপোর মুকুট। নিচে ডান পাশে মহারাজ পাণ্ডু ও মহারানি কুন্তির সুন্দর দুটি রৌপ্যমূর্তি। হিমালয়ের সেই অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং শান্ত পরিবেশের মাঝে দাঁড়িয়ে রয়েছে যোগবদ্রি মন্দির।
পুরাকাহিনী অনুসারে পাণ্ডবগণ হস্তিনাপুরের দায়িত্ব রাজা পরীক্ষিতের হাতে অর্পণ করে, পাণ্ডুকেশ্বরে এসে বসবাস শুরু করেন। পাণ্ডবদের পিতা রাজা পাণ্ডু তাঁর জীবনের শেষ দিনগুলি বিষ্ণুদেবের উপাসনায় নিমগ্ন হয়ে কাটান এই স্থানেই। পাণ্ডু রাজার নির্বাণ-প্রাপ্তি এই স্থানেই হয়, তাই জায়গার নাম পাণ্ডুকেশ্বর। আশপাশের জায়গা-সহ সেকালের পাঞ্চাল দেশই আজকের উত্তরাখণ্ড।
জনমানসে বিশ্বাস, মিলাম হিমবাহের উপরে অবস্থিত সূর্য কুণ্ডেই মহারানি কুন্তি, সূর্যপুত্র কর্ণের জন্ম দেন। পাণ্ডুকেশ্বরেই রাজা পাণ্ডু, কুন্তিকে বিবাহ করেন। এই স্থানটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব জড়িয়ে আছে নবম শতকের কত্যুরি রাজবংশের সঙ্গে, যেখানে আবিষ্কৃত হয়েছিল পাঁচটি তাম্রফলক ও একটি প্রস্তরখণ্ডে খোদিত লিপি। এএসআই দ্বারা সংরক্ষিত যোগবদ্রি মন্দিরে প্রাপ্ত চারটি তাম্রলিপির দুইটিতে, কত্যুরি রাজা ললিতাসুর দেব এবং বাকি দুটির একটিতে রাজা পদ্মাতা দেব ও অন্যটিতে সুভিক্ষরাজা দেব-এর উল্লেখ পাওয়া যায়। হিমালয় এমনই পৌরাণিক গাথা আর আধ্যাত্মিকতায় পরিপূর্ণ। এই আকর্ষণেই যুগ যুগ ধরে মানুষ ছুটে যায় এই পাহাড়ের টানে।
(ক্রমশ)