• facebook
  • twitter
Friday, 5 December, 2025

লো​হাপুরে জলে জঙ্গলে

আওয়াজ‌ও আর‌ও তীব্র। এ এক বুনোপাহাড়ের নদী। লোহাবাঁধা পথে দেখতে দেখতে ওপরে চড়ছি। সৌজন্য: ভারত সরকারের সেইল দপ্তর। তাই এত ছিমছাম।

লো​হাপুরের খন্ডচিত্র।

ঋত্বিক ঠাকুর

(১)
ছোট্ট একটা লাট্টু আমি। তাকে দমে রেখে বনবনাচ্ছে এক আজব লেত্তি। কে সে? চোখেই দেখিনি কোন‌ওদিন। তবে তার উপস্থিতি টের পেয়ে চলেছি তা আজ প্রায় ৫০ বছর ধরে। এবারের গপ্পটা বলা যাক। হাওড়া-বরবিল জনশতাব্দী এক্সপ্রেস লেটে চলতে চলতে রাত ৮টায় দেহ রাখল বড়া জামদা স্টেশানে। আমার গন্তব্য বরবিলের আগের স্টেশান এই বড়া জামদা। এ জায়গাটা ঝারখন্ডের মধ‌্যে পড়ে। আবার বরবিল ওড়িশায়। মানে দু’রাজ্যের সীমানায় এক অচেনা জনপদের রেলস্টেশানের ২ নম্বর প্ল্যাটফর্মে নেমে পড়েছি। শরীরে ঘেমো অবসাদ। মনে খটকা। এবার কী হবে! এই লাট্টুপাকে এবার বুঝি লম্বা দাঁড়ি পড়বে। আসলে যে পরিচিত ছেলেটির কথায় এবার দুগ্গাপুজোয় ঘর ছেড়েছি, তিনি কোনও এক অজানা কারণে আমাকে ফোনে জানিয়েছেন তাঁর অসুবিধের কথা অর্থাৎ আমার সফরে তাঁকে সঙ্গে পাচ্ছি না। তবে তিনি অন্য একজনকে আমার নাম্বার দিয়ে রেখেছেন।

Advertisement

সে-ই আমার এই চক্করের সব ব্যবস্থা করে দেবে, এমনতর আশ্বাসে বুক বেঁধে বড়া জামদা স্টেশনের বাইরে বেরিয়ে এসে একটা চা-দোকানে চায়ের চুমুকে অপেক্ষা করছি সেই মহাসারথির। মুশকিল হয়েছে, সে মানুষটির কোন‌ও ফোন নাম্বার আমার কাছে নেই। এটা ডাহা একটা ভুল করে ফেলেছি। এদিকে আমার পরিচিত ওই ছেলেটির ফোন বেজেই চলেছে নিরুত্তর। অগত্যা.. কপাল ঠুকে… ঘড়ির কাঁটায় চোখ রাখা ছাড়া আর কিচ্ছু করার নেই। বেশ কিছুটা সময় গড়িয়েছে… আমার ফোনের দেয়ালে একটা অচেনা নাম্বার বেজে উঠেছে… হ্যালো…। ওপ্রান্তে ভাঙা হিন্দিতে গলা শুনতে পেলাম… ঠাকুরসাহাব, ম্যায় সন্তোষ বিস‌ওয়াল… আপকা ইস ট্যুর পে ম্যায় মদৎ করুঙ্গা… মেরা গাড়ি ১০ মিনিট মে আপকো রিসিভ করেগা… বড়া জামদা স্টেশনকে বাহারি গেট পর আপ ইন্তেজার করিয়ে… গাড়ি কা নাম্বার ভেজ রহা হুঁ। সত্যিই… গাড়ি এল। একটা বড় উইঙ্গার। জিগ্যেস করে চেপে বসলাম। আর‌ও অনেকের সঙ্গে। গাড়ি চলল। কোন অজানায়…। বেশ খানিকটা বাদে গাড়ি এসে থামল একটা বড়োসড়ো অতিথি নিবাসের ফটকে। ‘আধার’ তার নাম। সংশয় কাটাতে ওই বিস‌ওয়াল ভাইটিকে পাল্টা ফোন করলাম। উত্তর এল দাদা, ফিকর না করে… আপ সহি জায়গা পর আয়ে হো… আজ বিশ্রাম কিজিয়ে… কাল সুবে মিলতে হোঙ্গে। আজব ব্যাপার! একটা এক কামরার ঘরে রাতের থাকার বন্দোবস্ত হলো। বেশ আরামপ্রদ। রুটি-ভাজি দিয়ে ডিনার সেরে নিয়ে বালিশে ভর করলাম।সকালে ঘুম ভাঙল বিছানা চায়ের ডাকে। এক সুদর্শন যুবক আমার দরজায় চায়ের কাপ নিয়ে দাঁড়িয়ে। চা-টা হাতে নিয়েই জিগ্যেস করলাম.. বিস‌ওয়ালজি কিধার হ্যায়? সে বলল, স্যার আয়েঙ্গে ৯ বাজে। বেশ। দেখা যাক। আজ পুজোর সপ্তমী। এখানে এখন আকাশে নীলের ফেট্টি হাওয়ায় উড়িয়ে শরতের মাস্তানি দেখছি। আর কলকাতায়? ঝমঝমানো বরিষনে পুজো মাটি হ‌ওয়ার মুখে। যাক গে। আমার আসন্ন চক্কর নিয়ে ভাবছি। বিস‌ওয়ালবাবুই ভরসা আপাতত। চা শেষ করেই রিসেপশনের ডেস্কের কাছে গেলাম। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই একজন সুপুরুষ প্রৌঢ় উঠে দাঁড়িয়ে আমাকে নমস্কার করে বললেন… আমি সন্তোষ… আপনার কাছেই যাচ্ছিলাম… আপনি রেডি হয়ে নিন… ঘুমেঙ্গে না? বললাম,‌ অবশ্য‌ই… কিন্তু টাকা পয়সা…। সন্তোষজি হো হো হেসে বললেন… পুরা ঘুমিয়ে… সন্তুষ্ট্ হুয়া তো সন্তোষকো ইয়াদ করিয়েগা, সাহাব! এ কেমন আলোর মুখোমুখি হলাম, পাঠক! কোন‌ও শর্ত ছাড়া এভাবে…। চলো… আগে বঢ়ে…।

Advertisement

চালু হয়ে গেল চক্কর… চলো পথিক, লোহাপুরের চাকায়। ছুটছে সাদা রঙের আরটিগা। চালক ভাই করণ বেহেরা। বেরিয়ে পড়েছি থলকোবাদের পথে। সন্তোষভাইয়ের অসীম বদান্যতায় আমি শেয়ারিং বন্দোবস্তে একটি সুভদ্র বাঙালি পরিবারের দলে জুড়ে গিয়েছি। গৌতম বসু ও তাঁর চার সদস্যের পরিবার। গৌতমবাবু শিক্ষক ও নেশাদার ফটোগ্রাফার। নিকন ক্যামেরায় টেলি-লেনস লাগিয়ে গৌতম মগ্ন প্রকৃতিপাঠে। আমি দেখছি আকাশ। নির্মল নীল আশ্বিন মেখে মুখর এ বনভূমি। চলেছি। চলেছি। দেখতে দেখতে। বোলানির লোহাখনি পেছনে ফেলে চড়ে বসলাম পাহাড়ি ঘাটিতে। যতদূর চোখ মেলা যাচ্ছে, ঘন সবুজ উপত্যকা। রাস্তা লোহামেটে। কেমন যেন সন্ন্যাসপুরের গল্প আঁকা। আর‌ও কিছুটা চলার পরে কিরিবুরুর টাউনশিপ ছেড়ে একেবারে বুনো পথ। দু’ধারে আকাশ ছোঁওয়া শাল। মাথার ওপরে মেঘের আলপনা। হাওয়ায় কথা আঁকা চুমু। কেমন যেন ‘হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা’। সবাই চুপ। মজে আছে স্তব্ধ বিস্ময়ে। একজায়গায় এসে গাড়ি দাঁড়াল। এ জায়গার নাম মেঘহাতাবুরু। একটা মাইনসের ফটক। মেঘহাতাবুরু আয়রন ওরস মাইনস। করণভাই বিশেষ পারমিট আনতে চলে গেল। নিরাপত্তার কারণে। আসলে থলকোবাদ অঞ্চলটি এখন‌ও উপদ্রুত তালিকাভুক্ত।

করণ পারমিট বাগিয়ে ফিরল। আবার চলা। মাইলফলক বলছে, থলকো ২৫ কিমি পথ। রাস্তা আস্তে আস্তে সরু হয়ে আসছে। গাছের মাথায় গাছ। রকমারি গাছ। অচেনাই বেশি। এক জায়গায় দেখা পেলাম এক বুনো নদীর। সেতুর ওপরে কাদাজলে খেলছে একদঙ্গল শিশু-কিশোর। নীচে ব‌ইছে বন্ধু নদী। নদীতে চলছে বাসন মাজা কাপড় কাচা। গ্রামের মেয়ে ব‌উদের দুপুরের আড্ডা। ওই কচিকাঁচাদের জিগ্যেস করে জানলাম, এ নদীর নাম ফুলিয়াগাড়া। এ গাঁয়ের নাম সাগুনবেড়া। থমকে র‌ইলাম বেশ কিছুটা সময়। তারপর আবার…। এবার বনান্তর চিরে এসে পড়লাম এক আশ্চর্যের মুখোমুখি। বোর্ডে লেখা: ঘাগিরথী ইকো-ট্যুরিজম। গাড়ি গড়াচ্ছে। বাঁ হাতে। ৫০০ মিটার। এবার পায়ে পায়ে। এসে পড়লাম এক লৌহসেতুর সামনে। এক কিমি লম্বা একটা রোপ ব্রিজ। শালকাঠের পাটাতন পায়ের তলায় দুলছে। এঁকেবেঁকে চলা। যাচ্ছি দুলতে দুলতে। ভেসে আসছে বুনো ঝোরের ঝমঝম। এই বুঝি ঘাগিরথী। দেহাতি নাম: লিগিরদা। যত ওপরে উঠছি ঝোর তত চ‌ওড়া হয়ে উঠছে।

আওয়াজ‌ও আর‌ও তীব্র। এ এক বুনোপাহাড়ের নদী। লোহাবাঁধা পথে দেখতে দেখতে ওপরে চড়ছি। সৌজন্য: ভারত সরকারের সেইল দপ্তর। তাই এত ছিমছাম। শেষ বিন্দুতে এসে পড়লাম। এ যেন দিগন্ত ভাসান! লিগিরদা একার যাত্রায় এলোমেলো জলরানি। চোখ আমার আনন্দে ডুবে। জলের অনন্ত রূপকথা। ভয়ংকরের সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে সুন্দর করে তুলতে সাধ জাগল। ঘাগিরথীর ছিটে স্নানে দিলাম অথৈ ডুব। না। ডুবতে পারলাম না। করণভাই পেছনে দাঁড়িয়েছিল। বলল, স্যর, আগে অউর ভি বাকি হ্যায়।

(২)
উধাও। উধাও। শুধু আলোর চলায়। লোহা সরবরের সামনে দু’দণ্ড থমকে দাঁড়াই। পাথর ফুঁড়ে উঠে আসছে লোহা। ট্রলিতে বোঝাই হয়ে চলে যাচ্ছে রিফাইনারিতে। এ জায়গাটা মেঘহাতাবুরুতে। মানে, ঝারখন্ডের মধ্যে। খনি আর খনি। লোহা আর লোহা। তার মধ্যে প্রকৃতি উদার অকৃপণ। ভাবছি। ভাবতে ভাবতে একটা আর.ও. ফ্যাক্টরির উঠোনে পৌঁছলাম। আলাপ হলো হঠাৎই কেয়ারটেকার অশোক পানের সঙ্গে। কী মিশুকে! লাঞ্চ খেতে খেতে বলে চললেন সারান্ডা পাহাড়ের আলো অন্ধকারের কথা। খেয়াল নেই। করণের তাড়া খেলাম। তারপর আরটিগায় চেপে দশ মিনিটে পৌঁছলাম মেঘহাতাবুরু সানসেট ভিউ পয়েন্ট। এখন বিকেল সাড়ে ৪টে বাজে। বাঁধানো সিঁড়ি বেয়ে উঠে এলাম ভিউ উঠোনে। লোকের মেলা লেগে গেছে। পশ্চিমে সারান্ডা। সাতশো পাহাড়ের ভুবনটলানো চুড়ো দেখা যাচ্ছে। তার‌ই মধ্যে মেঘের শামিয়ানায় সূর্য বিশ্রাম নিচ্ছে। হয়ত আমার‌ই মতন ভাতঘুমের অভ্যেস। মেঘ না সরলে অস্তদর্শন অসম্ভব। সব্বাই নিজের নিজের ক্যামেরা মোবাইল তাক করে চোখ রেখেছে সূর্যর গতিবিধির ওপর। আমি এক কোণে একটা বেঞ্চে চোখ বুজেছি বিশ্রামে। হঠাৎই চীৎকার… ওই, ওই তো…। সূর্য মেঘচাদর সরিয়ে ডুবতে যাচ্ছে। বাহ্! নামছে… নামছে…। ক’মুহূর্ত! তারপর আবার ডুব… নীচে মেঘের সাগরে। ব্যস! আজকের মতন ছুটি। এবার অন্ধকারের অধিকার। তার পালা শুরু হতে চলল… আরেক উদয়ের ঠিকানা লেখার।

ঝমঝমিয়ে কী করে যে এখন‌ই বৃষ্টি এল। অপেক্ষা করছিল হয়ত সূর্যডুবির। তড়বড়িয়ে নেমে এলাম ভিউ পয়েন্ট থেকে। আমাদের ড্রাইভার ভাই করণ চোখ কচলিয়ে জিগ্যেস করল, স্যর, ‘সানসেট’ ডোবা দেখতে পেলেন? মনে মনে হাসলাম। সহজ করণ। সাদাসিধে দেহাতি ছেলে করণ। ও জানে না চেনে না আমাদের শহুরে মহলটিকে। ওর কাছে সানসেট মানে ভ্রমণপাগল মানুষের জন্য খুশখবরির মুখর বৃত্তান্ত। ভালো থাকুক করণের ভুবন। এবার ফেরার চাকা। গড়াচ্ছে। গড়াক। অন্য কোন‌ও দিকে। অন্য টানের কড়চায়।

Advertisement