জমিল সৈয়দ
কাটরা মসজিদ
মুর্শিদাবাদ শহরের লোকেরা তাঁদের ঠিকানায় লেখেন, পোঃ ও জেলা মুর্শিদাবাদ। কিন্তু মুখে বলেন, লালবাগ। মুর্শিদাবাদ শহরের বিভিন্ন অংশের নাম আলাদা-আলাদা। যেমন, লালবাগ, গোলাপবাগ, পিলখানা, কদম শরীফ, সাহমতগঞ্জ, সব্জিকাটরা, অলিগঞ্জ, জাফরাগঞ্জ, মহিমাপুর, ইচ্ছাগঞ্জ, নশিপুর ইত্যাদি !শহরের পূর্বদিকে নবাবি আমলে একটি বড় বাজার বসত। বাজার ও সংলগ্ন সরাইখানাকে বলা হত কাটরা। মোগল আমলে যাত্রীদের জন্য এরকম সরাইখানা স্থাপনের প্রচলন ছিলো। মুর্শিদ কুলিও রাস্তার ধারে এরকম সরাইখানা বানিয়েছিলেন।বাজারের মধ্যে একটি বড় মসজিদ বানিয়েছিলেন মুর্শিদ কুলি খাঁ, সেটাই কাটরা মসজিদ। এক ব্রিটিশ চিত্রশিল্পীর আঁকা এই মসজিদের একটি পুরনো ছবি এখনও উইকিমিডিয়া কমন্স্-এ পাওয়া যায়। সেখানে দেখলাম, মসজিদের সামনে খোলা মাঠে বিক্রেতারা উবু হয়ে বসে আছে, আর ক্রেতারা তাদের সামনে ঝুঁকে পড়ে জিনিসপত্র কিনছে। মুর্শিদ কুলি খাঁ ছিলেন বর্তমান হায়দরাবাদের এক ফৌজদার। তখন তাঁর নাম ছিলো মহম্মদ হাদি। ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকার লিখেছেন, মহম্মদ হাদি জন্মলগ্নে ছিলেন দাক্ষিণাত্যের হিন্দু ব্রাহ্মণ। কিন্তু হাজি শফি ইস্পাহানি নামে এক অভিজাত পারসিক ব্যক্তি তাঁকে পুত্রস্নেহে বড় করেন ও নতুন নামকরণ করেন ‘মহম্মদ হাদি’।
Advertisement
হাজি শফি ইস্পাহানি একসময় ভারত ছেড়ে পারস্য ফিরে যান, তাঁর সঙ্গে মহম্মদ হাদিও পারস্য চলে যান। শফি মারা যাওয়ার পরে মহম্মদ হাদি আবার ফিরে আসেন ভারতে।মহম্মদ হাদি কী করে যেন মোগল সম্রাট ঔরঙ্গজেবের সুদৃষ্টিতে পড়লেন। তখন ঔরঙ্গজেব দাক্ষিণাত্যে ২০ বছর ধরে নানা যুদ্ধে শক্তিক্ষয় ও অর্থব্যয় করছেন, সেইসঙ্গে দিল্লির সিংহাসনকে দুর্বল করছেন। তিনি মহম্মদ হাদিকে দেখে ভাবলেন, এই-ই যোগ্য লোক যাঁকে বাংলায় পাঠিয়ে ভালো রাজস্ব আদায় করা সম্ভব। সেই মহম্মদ হাদিকে ‘করতলব খাঁ’ খেতাব দিয়ে বাংলায় পাঠিয়ে দিলেন সম্রাট ঔরঙ্গজেব। হাদি বাংলায় এসে সোজা জাহাঙ্গিরনগর অর্থাৎ ঢাকা শহরে ঢাকার সুবেদার আজিম-উস-শানের সঙ্গে দেখা করলেন। আজিম-উস-শান ছিলেন ঔরঙ্গজেবের পৌত্র । মহম্মদ হাদি কিংবা করতলব খাঁয়ের প্রতিপত্তি ও তাঁর উপরে সম্রাটের আস্থা দেখে আজিম-উস-শান বারবার তাঁকে হত্যা করার চেষ্টা করতে লাগলেন। ১৭০৪ সালে ঔরঙ্গজেব একটি চিঠিতে মহম্মদ হাদিকে লিখেছিলেন—‘একই ব্যক্তি হয়ে আপনি বাংলা ও বিহারের দেওয়ান, উড়িষ্যার নাজিম ও দেওয়ান। আপনার পরিপূর্ণ ক্ষমতা ও-সব অঞ্চলে। ব্যক্তিগতভাবে আমি নিজে এত কাজ করতে পারতাম না। একমাত্র আল্লার প্রসাদধন্য কোনও ব্যক্তিই এত যোগ্যতার অধিকারী হতে পারে।’ মহম্মদ হাদি ভাবলেন, ঢাকায় থাকা তাঁর পক্ষে নিরাপদ নয়। তিনি অনেক ভেবেচিন্তে ও সম্রাটের অনুমতি নিয়ে ভাগীরথীর তীরে মখসুদাবাদে তাঁর দেওয়ানি দপ্তর সরিয়ে আনলেন। তাঁর সঙ্গে ঢাকা থেকে এলেন জগৎশেঠ বংশের প্রতিষ্ঠাতা মানিকচাঁদ। সম্রাট ঔরঙ্গজেব তাঁর প্রিয়পাত্র হাদি খাঁ কিংবা করতলব খাঁর ওপর অত্যন্ত সন্তুষ্ট হয়ে তাঁকে বহুমূল্য পোশাক, পতাকা, নাগরা ও তরবারি উপহার দিলেন। তারপর তাঁকে ‘মুর্শিদকুলি খাঁ’ উপাধিতে ভূষিত করলেন এবং তাঁর উপাধি অনুসারে মখসুদাবাদের নাম মুর্শিদাবাদ করার অনুমতি দিলেন। মুর্শিদকুলি খাঁ মখসুদাবাদে এসে নতুন নাম মুর্শিদাবাদ চালু করলেন এবং সেখানে একটি বাদশাহি টাঁকশালও স্থাপন করেন। ঐতিহাসিকেরা মোটামুটি একমত যে মুর্শিদাবাদ শহরের প্রতিষ্ঠা হয় ১৭০৪ সালে। বলা হয়, মুর্শিদকুলি খাঁয়ের সময়ে মুর্শিদাবাদে স্বর্ণযুগ চলছিল। বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার রাজধানী হিসেবে মুর্শিদাবাদ শহর গমগম করতো। লোকেরা মাসে ১ টাকা খরচ করতে পারলেই নিত্যদিন পোলাও-কালিয়া খেতে পারতো। মুর্শিদকুলি খাঁ ১৭২৩-১৭২৪ সালে সাড়ে ১৯ একর জমির উপরে কাটরা মসজিদ স্থাপন করেন। তিনি মারা যান ১৭২৭ সালে। তাঁর ইচ্ছা অনুযায়ী, সিঁড়ির নিচে তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়— যেন ধার্মিক লোকেদের পায়ের নিচে শুয়ে তাঁদের পদধূলিতে তিনি পবিত্র হতে পারেন। ‘নগর পুড়িলে দেবালয় কি এড়ায়’!
Advertisement
অতএব কালের করাল গ্রাসে ভেঙে পড়েছে মুর্শিদ কুলি খাঁ-র সাধের মসজিদ। ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে মিনার ও গম্বুজের সারি বিচূর্ণ হয়ে যায়। মসজিদের চারপাশে ৪টি মিনার ছিলো, এখন মাত্র ২টি টিকে আছে, যদিও এদুটি পুনর্নির্মিত হয়েছে।ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ মসজিদের মাথায় দ্বিতীয় সারিতে ১৬টি ছোট ছোট গম্বুজ যথাসাধ্য পুনর্নিমাণ করেছে। মসজিদের মূল গম্বুজ সংখ্যা ছিলো পাঁচ, কিন্তু মাঝের গম্বুজদুটি ধ্বংস হওয়ায় ভিতরে দাঁড়ালে উপরের আকাশ দেখা যায়। এই বিশাল গম্বুজ আজ নতুনভাবে তৈরি করা কার্যত অসম্ভব। দু’পাশের মিনারদুটিও নতুনভাবে গড়ে তোলা হয়েছে। আমি আমার ছোটবেলায় মিনারের ভিতরে ঢুকে অন্ধকারে ভাঙা সিঁড়ি বেয়ে অনেকটা উঠেই, ভয় পেয়ে নেমে এসেছিলাম। গৌড়ের চিকা মসজিদে ঢুকে গম্বুজের নিচে দাঁড়িয়ে খুব আতঙ্কিত হয়েছিলাম, এই বুঝি ভেঙে পড়ল আমার মাথার উপরে। শুধু চুন-সুরকি দিয়ে কীভাবে এই স্তম্ভবিহীন গম্বুজ বানানো হতো, ভাবলেই বিস্ময় জাগে।
মুর্শিদাবাদ শহর গড়ে ওঠার আগে, জায়গাটির নাম ছিলো মখসুদাবাদ। সমসাময়িক ইতিহাসগ্রন্থ থেকে দেখা যাচ্ছে, ওই জায়গায় মখসুস খাঁ নামে এক মোগল অমাত্য থাকতেন, তিনিই নিজের নামের সঙ্গে মিলিয়ে জায়গাটির নাম রেখেছিলেন মখসুদাবাদ। কিন্তু লোকমুখে প্রচলিত আছে যে ওই জায়গায় থাকতেন মুখসূদন দাস নামে এক সন্ন্যাসী, যিনি গৌড়ের সুলতান হোসেন শাহকে অসুখ থেকে সারিয়ে তুলেছিলেন, তাই হোসেন শাহ ওই সন্ন্যাসীকে এই জায়গাটি দান করেছিলেন। সেই সন্ন্যাসীর নামেই জায়গাটির নাম হয় মখসুদাবাদ। এই গল্প অনেকেই বিশ্বাস করেন না। মুখসূদন নাম একেবারেই অস্বাভাবিক, বরং মধুসূদন হলেও বিশ্বাস করা যেত। দ্বিতীয়ত ওই গল্পের কোনও লিখিত প্রমাণ নেই।মুর্শিদ কুলি খাঁ-র সময় থেকে সিরাজ-উদ-দৌলার পতন পর্যন্ত সময়কালকে মুর্শিদাবাদের স্বর্ণযুগ বলা হয়।
দিল্লির বাদশাদের সঙ্গে মুর্শিদ কুলির সম্পর্ক খুব ভালো ছিলো। দিল্লিতে সেসময় খুব অস্থিরতা চলছে। ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পরে তাঁর উত্তরসূরিদের মধ্যে কলহ চলছে। দিল্লির সিংহাসনে ঘনঘন ক্ষমতাধিকারীর বদল হচ্ছে। কিন্তু মুর্শিদ কুলি খাঁ নির্বিকার, যখন যিনি দিল্লির সম্রাট হচ্ছেন তাঁকেই খাজনা ও উপঢৌকন পাঠিয়ে দিচ্ছেন। এরকম গল্প প্রচলিত আছে যে, কাটরা মসজিদ তৈরির জন্য মুর্শিদাবাদ থেকে ৪দিনের হাঁটাপথের দূরত্বের মধ্যে অবস্থিত সমস্ত মন্দির ভেঙে সেই ইট নিয়ে এসেছিলেন মুর্শিদ কুলির অনুচর মুরাদ ফরাস। এই গল্প নিতান্তই গল্প। মুর্শিদাবাদ শহরের উল্টোদিকে কিরীটেশ্বরীর মন্দির কিংবা ভট্টবাটির শিবমন্দির বহাল তবিয়তে আজও বিদ্যমান। ৪ দিনের নয়, মাত্র কয়েক ঘন্টার হাঁটাপথের দূরত্বে।কিন্তু ওই মুরাদ ফরাস খুব বজ্জাত লোক ছিলো। মুর্শিদ কুলি খাঁয়ের বলে বলীয়ান হয়ে জনগণের উপরে নানারকম অত্যাচার করতো। মুর্শিদ কুলি মারা যাওয়ার পরে, তাঁর জামাতা সুজাউদ্দিন ওই মুরাদ ফরাসকে ধরে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেন। ঐতিহাসিক নিখিলনাথ রায় লিখেছেন, ‘মুশিদকুলী খাঁ হিন্দুবিদ্বেষী বলিয়া ইতিহাসে পরিচিত; কিন্তু আমরা সেরূপ মনে করি না; তবে হিন্দু অপেক্ষা মুসলমানদিগের প্রতি তাঁহার অনুরক্তি কিছু অধিক ছিল।’
ফুটি মসজিদ
আমাদের কম বয়সে, হাজারদুয়ারিতে ঘোরাঘুরি করে কাটরা মসজিদের দিকে যাওয়ার সময়, রেললাইন পেরোতে হতো। শিয়ালদহ-লালগোলা রেললাইনে রিকশার চাকা তুলে রিকশাওয়ালা বাম দিকে আঙুল তুলে বলতো, ওই যে ফুটো মসজিদ ! কিন্তু সেখানে থামা হতো না। কারণ, তালগাছ-সমান উঁচু জঙ্গলে পুরোটা ঢাকা ছিলো। ১২৫ বছর আগের সাক্ষ্য অনুযায়ী, ‘এক্ষণে জঙ্গলে আবৃত হইয়া ব্যাঘ্রাদি হিংস্র জন্তুর আবাসস্থান হইয়া উঠিয়াছে।’
কিন্তু গত কয়েকবছরের মধ্যে সেই জঙ্গল প্রায় সাফ হয়ে গেছে। আশেপাশে মানুষের বসবাসের ঝুপড়ি তৈরি হয়ে গেছে। ফুটো মসজিদের গায়ে খোঁটা পুতে দড়ি ঝুলিয়ে কাপড়চোপড় মেলে দেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। ফুটো বা ফুটি মসজিদ বানাচ্ছিলেন সরফরাজ খাঁ। কে এই সরফরাজ ?তিনি ছিলেন নবাব মুর্শিদ কুলি খাঁয়ের দৌহিত্র। মাত্র ১ বছরের জন্য বাংলার এক নবাব। মুর্শিদ কুলি খাঁয়ের কোনও পুত্র ছিলো না। তিনি উত্তরাধিকারী নির্বাচন করে গেছিলেন নিজের নাতি সরফরাজকে। কিন্তু মুর্শিদ কুলি খাঁ ১৭২৭ সালে মারা যাওয়ার পরেই, সিংহাসনের লোভে উড়িষ্যা থেকে ছুটে এলেন তাঁর জামাতা সুজাউদ্দিন। সরফরাজের পিতা।
সুজাউদ্দিন ছিলেন উড়িষ্যার ডেপুটি গভর্নর। বৃদ্ধ মানুষ। কিন্তু লোভ তাঁকে তাড়িত করে নিয়ে এলো মুর্শিদাবাদে, নিজেকে নবাব বলে ঘোষণা করলেন। দিল্লিতে সে-সময় নানারকম ডামাডোল চলছে, ফলে দিল্লির হাত শিথিল হয়ে গেছে। সরফরাজ ঠিক করলেন, পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবেন। কিন্তু তাঁর দিদিমা ও তাঁর মা, দুই মহিলা মিলে সরফরাজকে নিবৃত্ত করলেন। তাঁকে বোঝালেন, তাঁর পিতা বৃদ্ধ, কতোদিনই বাঁচবেন, তাই সিংহাসন তো সরফরাজের হাতেই আসবে। কিন্তু, না, সুজাউদ্দিন সহজে মারা গেলেন না! ১২ বছর বসে রইলেন মুর্শিদাবাদের গদি আঁকড়ে।
১৭৩৯ সালে সুজাউদ্দিন মারা যেতেই সরফরাজ খাঁ সিংহাসনে চড়ে বসলেন। পিতার মৃত্যুতে তিনি ব্যথিত হয়েছিলেন কি না, তা ইতিহাসে লেখা নেই! তবে বলে রাখা দরকার, ঐতিহাসিকেরা কিন্তু বলেছেন, “সুজাউদ্দিনের রাজত্বকালে শান্তি ও সমৃদ্ধি বিরাজমান ছিলো।’ কেউ লিখেছেন, ‘সুজাউদ্দিনের সময় এতোই সমৃদ্ধি দেখা গেছে যে চারদিকে সুখের ও প্রাচুর্যের বাতাবরণ সৃষ্টি হয়েছিল।’ সিংহাসনে বসে সরফরাজ খাঁ কিন্তু শান্তি পেলেন না। পিতা সুজাউদ্দিন নেই, তো কী হয়েছে, সুজাউদ্দিনের ঘনিষ্ট অমাত্য-পারিষদেরা সরফরাজকে গদিচ্যুত করার ষড়যন্ত্র করতে লাগলেন। তখন দিল্লির বাদশাহ মুহম্মদ শাহ, দস্যু নাদির শাহের আক্রমণে ল্যাজে-গোবরে অবস্থায় পড়েছেন। ফলে দিল্লির নজরদারিও নেই মুর্শিদাবাদের উপরে। সুজাউদ্দিনের অমাত্য-পারিষদের দলে ছিলেন আলিবর্দি খান, তাঁর প্রিয়পাত্র, তখন বিহারের শাসনকর্তা। সুজাউদ্দিন তাঁকে ‘মহববত জং’ খেতাব দিয়েছিলেন। এই আলিবর্দি ছিলেন কর্নাটকি লোক, কিন্তু তাঁর পিতা এসেছিলেন আরব কিংবা তুরস্ক থেকে। তিনি সৈন্যসামন্ত ও লোক-লশকর নিয়ে পাটনা থেকে মুর্শিদাবাদের দিকে ধেয়ে আসতে লাগলেন। সরফরাজ তখন একটা মসজিদ তৈরি করছেন। প্রায় সমাপ্তির মুখে। এমন সময় শুনলেন বিপদের ঘন্টা। মুর্শিদাবাদ আক্রমণ করতে আসছেন আলিবর্দি। অতএব মসজিদের কাজ থামিয়ে রেখে সরফরাজ চললেন আলিবর্দিকে বাধা দিতে।জঙ্গীপুরের অদূরে, বিহার ও বাংলার সীমান্ত ঘেষা এলাকা গিরিয়া। সেখানে মুখোমুখি হলো দুই প্রতিপক্ষ। কিন্তু ভাগ্যাহত সরফরাজ— গিরিয়ার যুদ্ধে নিহত হলেন। আলিবর্দির করতলগত হলো মুর্শিদাবাদের মসনদ। সেটা ইংরেজি ১৭৪০ সালের শেষভাগ। পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে রইল সরফরাজের অর্ধসমাপ্ত মসজিদ। নবাব যুদ্ধে ‘ফৌত’ (মৃত) হয়ে গেছিলেন বলে এই মসজিদের নাম হয়ে গেল, ফৌতি মসজিদ। মুর্শিদাবাদের মানুষেরা খুব কল্পনাপ্রবণ ও গল্পবাজ। নানারকম গালগল্প বানিয়ে অন্যকে মুগ্ধ করতে বেশ পারদর্শী।
তাঁদের গল্প অনুযায়ী, সরফরাজ খাঁ চেয়েছিলেন, একদিনে একটি মসজিদ বানিয়ে ফেলতে। কিন্তু একদিনে পুরো কাজ সমাপ্ত করা সম্ভব হয়নি, তাই যতোটুকু কাজ হয়েছিল সেখানেই থেমে গেছিলেন নবাব।
কাটরা মসজিদের অনুকরণে এখানেও পাঁচটি গম্বুজ বানানো হয়েছিল। কয়েকটি গম্বুজ ভেঙে পড়েছে, কিন্তু উপরে তাকালে একটি গোল ফুটো চোখে পড়ে। তাই ‘ফৌতি’কে ফুটো মসজিদ বলা মুর্শিদাবাদের মানুষের পক্ষে যথোপযুক্ত! ১৯৯৯ কি ২০০০ সালে, আমার হাতে একটি নতুন দলিল আসে। সেটি একটি বিক্রয় কোবালা (Sale deed)— একজন তাঁর ২ কাঠা জমি অন্যজনকে বিক্রি করছেন। সেখানে জমির চৌহদ্দি (বাউণ্ডারি) লেখা আছে— ‘দক্ষিণে সরফরাজ খানের কবর।’ এটা পড়ে আমি চমকে উঠি। মুর্শিদাবাদের নবাবের কবর ঘেঁষে জমি কেনাবেচা হচ্ছে! আমি কৌতূহলবশত জায়গাটি দেখতে যাই। মুর্শিদাবাদ রেলওয়ে স্টেশন থেকে যে রাস্তাটা শহরে ঢুকছে, সেই স্টেশন রোডের পাশে একটি জঙ্গলাকীর্ণ ঢিপি আবিষ্কার করি। চারপাশে মানুষজনের ঘরবাড়ি গড়ে উঠেছে, সেই ঘরবাড়ির মধ্য দিয়ে তাদের অনুমতি নিয়ে এগোতে থাকি। দেখি, শুধু একটা ছোট্ট ঢিপি জঙ্গল-আবৃত হয়ে পড়ে আছে। চারপাশের জায়গা জবরদখল হয়ে গেছে। সমাধিসৌধ কিছু থাকলেও সেটার আর অস্তিত্ব নেই। যে ছোট্ট ঢিপিটুকু ছাড় পেয়েছে, ওটাই সরফরাজ খাঁয়ের সমাধি। মানুষের জন্য বরাদ্দ সাড়ে তিন হাত জমির নিচে শুয়ে আছেন বাংলার এক ভাগ্যাহত নবাব।
Advertisement



