• facebook
  • twitter
Wednesday, 17 December, 2025

বাংলার ফুটবলের এই করুণ অবস্থার জন্য দায়ী অনিয়ন্ত্রিত খেপ খেলা

কলকাতা ময়দানে জেলার ফুটবলারদের দাপট দেখতে পাওয়া গিয়েছে দীর্ঘদিন। একটা সময় ব্যান্ডেল, হালিশহর, নৈহাটি, কৃষ্ণনগর ও অশোকনগর, বারাসত থেকে প্রচুর জেলার ফুটবলাররা সকালের ট্রেনে চলে আসতেন কলকাতা ময়দানে। বর্তমানে সেই ফুটবলারদের হয়তো আর দেখতে পাওয়া যায় না। যার ফলে বাংলার ফুটবলে সাপ্লাই লাইন নেই বললেই চলে। উত্তর ২৪ পরগানার ফুটবলাররা দাপটের সঙ্গে কলকাতা ময়দানে রাজত্ব করেছেন। সেই জেলাও ফুটবলের সেই মাহাত্ম হারিয়ে ফেলেছে। সেই গরিমা ফিরিয়ে আনতে এবং জেলার ফুটবলের উন্নতি সাধনে উত্তর ২৪ পরগনা জেলা ক্রীড়া সংস্থার নতুন সচিব নবাব ভট্টাচার্য। তিনি আবার জেলার ফুটবল মাঠে সেই উন্মাদনা ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করছেন। উত্তর ২৪ পরগনা জেলা ক্রীড়া সংস্থার সচিব নবাব ভট্টাচার্য বাংলা ফুটবলের অবস্থা নিয়ে কথা বললেন প্রতিনিধি অলিভিয়া সরকার-এর সঙ্গে।

প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র

প্রশ্ন: নতুন দায়িত্ব পেয়ে আপনার প্রথম লক্ষ্য কি?
নবাব: জেলায় বর্তমানে ফুটবল, ক্রিকেট ছাড়া অন্যান্য খেলাধুলোর ক্ষেত্রে একটু সমস্যা রয়েছে। পরিকাঠামো একদম নেই বললেই চলে। আমাদের জেলায় খেলাধুলোর একটা ঐতিহ্য আছে। তার চেয়েও বড় কথা আমাদের জেলায় প্রচুর প্রতিভাবান খেলোয়াড় আছেন। পড়াশোনায় উন্নতির জন্য যেমন স্কুল, তেমনই স্থানীয় ক্লাবগুলোই হলো খেলোয়াড়দের প্রথম স্কুল। কোনও খেলোয়াড় প্রথমেই ভাবে না সে বড় খেলোয়াড় হবে বা খেলা থেকে ভালো চাকরি পাবে। প্রথমে সে শুধুমাত্র আনন্দের জন্যই খেলে। তাই, বর্তমানে আমাদের প্রথম লক্ষ্য ক্লাবগুলোকে শক্তিশালী করা ও যে সমস্ত খেলাধুলো একটু পিছিয়ে রয়েছে সেগুলোর উন্নতি করা।

প্রশ্ন: উত্তর ২৪ পরগনা জেলা লিগকে কি চোখে দেখছেন?
নবাব: উত্তর ২৪ পরগনা জেলা লিগ আগে শুধুই ফুটবল লিগ ছিল। তার পাশে ভলিবল, সাঁতার ও কবাডি আছে। কবাডি প্রায় উঠে যেতে বসেছিল। আমরা কবাডিটাকে নতুন করে চালু করছি। এছাড়াও, নতুন করে দু-তিনটে খেলা আনার চেষ্টা করছি। জুডো ও জিমনাস্টিকস সহ একাধিক খেলা যোগ করার চেষ্টা করছি। ব্যাডমিন্টন আগে থাকলেও এতদিন কোনও প্রতিযোগিতা হয় না। তবে, এবার আমরা ব্যাডমিন্টনের বড় প্রতিযোগিতা করতে চলেছি। সবচেয়ে বড় কথা আমার আর্চারি আর ফেন্সিং খেলা দুটো আনার খুব ইচ্ছা রয়েছে।

Advertisement

প্রশ্ন: জেলার প্রতিভাবান ফুটবলাররা এখন আর কোনও জায়গা পায় না জাতীয় দলে। এর কারণ কি ?
নবাব: এটা একটা জেলার বিষয় নয়। আর আমরা উত্তর ২৪ পরগনার বাইরে কাজ করতে পারব না। রাজ্য সরকারের পক্ষে বিশেষত ক্রীড়ামন্ত্রী এগিয়ে আসলে জেলার চেহারা বদলে যাবে। তিনি যদি সকলের মধ্যে সমন্বয় তৈরি করতে পারেন তাহলেই বিষয়টি অনেকটা গুরুত্ব পাবে। তবে, সরকার তো সব করে দেবে না। তারা সাহায্য করতে পারে। কাজ তো করতে হবে সংগঠনকে। আমার মতে, পশ্চিমবঙ্গে খেলা ভালোবাসার লোকের যেমন অভাব নেই, খেলাধুলোকে ভালো জায়গায় পৌঁছে দেবার জন্য লোকেরও অভাব নেই। অর্থাৎভিশন থাকতে হবে। তাই, সরকার যদি একটা গাইডলাইন ঠিক করে দেয়, তখনই সত্যিকারের উন্নতি হবে। আমাদের জেলার ক্ষেত্রে আমি সেই চেষ্টাটাই করছি। আমাদের টিমকে দিয়ে সেই গাইডলাইনটা তৈরী করতে চাই। তবে, ক্রীড়ামন্ত্রী যদি আমাদের একটু সাহায্য করেন। সাহায্য মানে আমি শুধু আর্থিক সাহায্য বলছি না। তিনি ডিএসই’গুলোর থেকে যদি নিয়মিত রিপোর্ট নেন, যেটা সিএবি বা আইএফএ করে। ক্রীড়ামন্ত্রী যদি ছ’মাসে একটা মিটিং করেন, সবার কাজের হিসাব চান তাহলে সব ডিএসই কাজ করতে বাধ্য।

Advertisement

প্রশ্ন: সরকার আপনাদের পাশে দাঁড়াচ্ছে কি?
নবাব: সরকার যা সাহায্য করছে, একজন সংগঠক হিসেবে আমি বলব চিন্তা করা যায় না। অতীতে উত্তর ২৪ পরগনায় কটা স্টেডিয়াম ছিল ? এখন স্টেডিয়ামের সংখ্যা বাড়ছে। মাঠ চাইলে মাঠ বাড়ছে, টাকার প্রয়োজন হলে সরকার ক্লাবগুলোকে টাকা দিচ্ছে। এবার সেগুলো কি হচ্ছে তার একটা নজরদারি প্রয়োজন। টাকা দিয়ে সরকার প্রয়োজনীয় সাহায্য করছে। তবে, টাকা দেওয়ার পর সেই কাজটা হচ্ছে কি না সেটা সরকার যদি একটু নজরদারি করে তাহলে আমার ধারণা জেলার খেলাধুলোর ছবিটা একেবারেই বদলে যাবে।

প্রশ্ন : এখন ভারতীয় দলে বাংলার ফুটবলারদের দেখা যায় না। আপনি একথা বিশ্বাস করেন?
নবাব: এই কথাতে আমার আপত্তি আছে। আমিও চাই বাঙালি ফুটবলার খেলুক। কিন্তু বাঙালি খেলোয়াড় খেলবে বাংলার দলে। ভারতীয় দলে নয়। ভারতীয় দলে খেলুক যোগ্য এগারোজন খেলোয়াড়। একটা ১৬-১৭ বছরের ছেলে, আমাদের এখানে প্রতি শনি-রবিবার স্থানীয় প্রায় পাঁচ -ছ’হাজার টুর্নামেন্ট হয়। এখন মরশুম শুরু হয়েছে, এবার এটা বেড়ে হয়ে যাবে আট-ন’হাজার। এত টুর্নামেন্ট খেলার মতো খেলোয়াড় নেই। সেইজন্যে এই বাচ্চা ছেলেগুলোকে খেপ খেলতে হচ্ছে। একটা ছেলে খেপ খেলে যদি সপ্তাহে দশ হাজার টাকা রোজগার করে তাঁর কিসের অভাব ? কেন সে পরিশ্রম করে বড় খেলোয়াড় হবে ? বড় খেলোয়াড় হতে গেলে পরিশ্রম দরকার। আজকে যদি অ্যাথলেটিক্স মাঠেও যদি খেপ শুরু হয় তাহলে অ্যাথলিট আসবে না। বাংলার ফুটবলের এই অবনমনের জন্য মূলত দায়ী হলো খেপ। এজন্যই কেউ বড় খেলোয়াড় হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন না।

প্রশ্ন: আচ্ছা, বাংলার মেয়ে সংগীতা বাসফোর নজর কেড়েছেন। তবে?
নবাব: দেখুন, প্রথম কথা পুরুষদের চেয়ে মহিলাদের ফুটবলে ভারত কিন্তু অনেকটাই ওপরের দিকে আছে। দ্বিতীয়ত, মেয়েদের দল এখনও কর্মকর্তারা বানালেও ছেলেদের দলগঠন কিন্তু পুরোপুরি এজেন্ট এবং স্পনসরদের ওপর নির্ভরশীল। কর্মকর্তারা জানে কিভাবে খুঁজে খুঁজে খেলোয়াড় আনতে হয়। কিন্তু, এজেন্টদের ক্ষেত্রে খেলোয়াড়রা যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করে। কিছুদিন আগেই ইস্টবেঙ্গলে সই করা হায়দ্রাবাদ এফসির চার নম্বর গোলরক্ষক ছিল। দিল্লিতে খেলার কথা বলা হলেও তার কোনও রেকর্ড নেই। সে এসে ইস্টবেঙ্গলে সই করলেও বাংলার সন্তোষ ট্রফি দলের প্রধান গোলরক্ষক সুযোগ পাচ্ছে না। কর্মকর্তারা চাইলেও পারছে না। স্বাভাবিকভাবেই বাংলার ফুটবলার উঠছে না। আমার মনে হয়, যদি স্পনসররা দল গঠনের ক্ষেত্রে একটু কর্মকর্তাদের ওপর ভরসা করতে পারে, তাহলে আদতে বাংলা ফুটবলের লাভ।

প্রশ্ন: শ্যামনগর ফুটবল ফেস্টিভ্যাল নিয়ে আগামী ভাবনা?
নবাব: আমাদের মূল লক্ষ্য ছিল স্থানীয় অন্নপূর্ণা মাঠকে বিক্রি হয়ে যাওয়া থেকে বাঁচানো। এজন্য, আমার বিরুদ্ধে হাইকোর্টে মামলা করা হয়েছে। তবে, এবার আমরা এটাকে ইন্টার স্কুল প্রতিযোগিতা করতে চাই। জগদ্দল বিধানসভার সমস্ত স্কুলকে বাধ্যতামূলক অংশগ্রহণ করতে হবে। যেকোনও ক্ষেত্রে তৃণমূল স্তর থেকেই কাজ করতে হয়। তবেই, প্রকৃত উন্নতি সম্ভব। তবে, দু -চার বছরের মধ্যে দেখতে পাওয়া যাবে শ্যামনগর ফুটবলের মানচিত্র কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে।

Advertisement