বড় হওয়ার স্বপ্নে খেলোয়াড়দের জীবনে অনেক কাহিনি আছে। আর সেই কাহিনির নায়ক কখনও বাবা আবার কখনও স্বপ্ন দেখার ভূমিকায় মায়ের অবদান। অনেক সময়েই মা ও বাবা খেলোয়াড়ি জীবনে হয়তো অনেক স্বপ্নই পূরণ করতে পারেননি। তাই পরবর্তী ক্ষেত্রে তাঁদের সন্তানদের সেই জায়গায় নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রানপাত করে থাকেন। এমনই ঘটনা সবাইকে ভাবিয়ে তোলে। তাই এমন ঘটনা ঘটেছে উইলিয়ামস টেনিস পরিবারে। আবার হকি পরিবারে বাবা সেইভাবে নিজেকে বড় জায়গায় না নিয়ে যেতে পারলেও সন্তানের উপরে বড় ভরসা রেখেছেন। এমনই ঘটনা ঘটেছে খেলোয়াড়দের জীবনে।
তাই প্রথম সন্তান জন্মানোর অনেক আগেই একটি সেকেন্ড হ্যান্ড টেনিস র্যা কেট কিনে এনেছিলেন রিচার্ড উইলিয়ামস। তাঁর জেদের ফসল সেরিনা ও ভিনাস উইলিয়ামস। সন্তানের বিছানার উপরে একটি টেনিস বল ঝুলিয়ে রাখতেন আন্দ্রে আগাসির বাবা। যাতে ছোট থেকেই টেনিস বলের নড়াচড়া নজরে পড়ে আগাসির।
হায়দরাবাদের জি রামি রেড্ডিও হয়তো সেই দলেই পড়েন। নিজে হকি খেলোয়াড় ছিলেন। কিন্তু বেশি দূর এগোতে পারেননি। তাই ঠিক করে নিয়েছিলেন, মেয়েকে ক্রিকেটার করবেনই। সেই লক্ষ্যে প্রাণপাত করেছেন রামি রেড্ডি। মাত্র দু’বছর বয়সে মেয়েকে একটি প্লাস্টিকের ব্যাট কিনে দিয়েছিলেন। তখন থেকেই মেয়ের মধ্যে ক্রিকেট ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। তার ফল পেয়েছে গোটা ভারত। মহিলাদের অনূর্ধ্ব-১৯ টি২০ বিশ্বকাপের সেরা ক্রিকেটার হয়েছেন গোঙ্গাদি তৃষা। ব্যাটে-বলে নজর কেড়েছেন তিনি। তাঁর ক্রিকেটের শুরু মাত্র দু’বছর বয়সে। বাবার এনে দেওয়া ব্যাটে।
কুয়ালালামপুরে টানা দ্বিতীয় বারের জন্য মহিলাদের অনূর্ধ্ব-১৯ টি২০ বিশ্বকাপ জিতেছে ভারত। তাতে বড় ভূমিকা নিয়েছে তৃষা। দলের ওপেনার তিনি। ব্যাট হাতে সাতটি ম্যাচে করেছেন ৩০৯ রান, যা প্রতিযোগিতায় সর্বাধিক। দ্বিতীয় স্থানে থাকা ইংল্যান্ডের ডেভিনা পেরিনের (১৭৬) থেকে ১৩৩ রান বেশি করেছেন তিনি। ৭৭.২৫ গড় ও ১৪৭.১৪ স্ট্রাইক রেটে রান করা তৃষা একমাত্র ভারতীয় মহিলা, যিনি অনূর্ধ্ব-১৯ টি২০ বিশ্বকাপে শতরান করেছেন। স্কটল্যান্ডের বিরুদ্ধে ৫৯ বলে অপরাজিত ১১০ রান করেছেন তিনি।
আবার বল হাতেও সমান দক্ষ তৃষা। ডানহাতি এই স্পিনারের বলের অ্যাকশন অন্য রকমের। ফলে ব্যাটারের সমস্যা হয়। সাতটি ম্যাচে মোট ১০টি উইকেট নিয়েছেন তিনি। শুধু প্রতিযোগিতার সেরা নন, ফাইনালের সেরা ক্রিকেটারও হয়েছেন তৃষা। ফাইনালে ১৫ রান দিয়ে নিয়েছেন ৩ উইকেট। আবার রান তাড়া করতে নেমে ৩৩ বলে অপরাজিত ৪৪ রান করেছেন তিনি। সিরিজ়ের সেরার পুরস্কার নিয়ে বাবাকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন তৃষা। বলেছেন, “আমার কিছু বলার ভাষা নেই। এই পুরস্কার বাবাকে উৎসর্গ করতে চাই। বাবা না থাকলে আমার স্বপ্ন কোনওদিনই পূরণ হত না। বাবার জন্যই ক্রিকেটার হয়েছি। আগামী দিনেও বাবার স্বপ্ন আরও পূর্ণ করতে চাই।”
তৃষার কথা থেকে পরিষ্কার, তাঁর কেরিয়ারে বাবার কতটা গুরুত্ব। মেয়ের যখন মাত্র দু’বছর বয়স তখন একটি প্লাস্টিকের ব্যাট এনে তৃষার হাতে ধরিয়ে দেন রামি রেড্ডি। প্লাস্টিকের বল দিয়ে বাবার সঙ্গে খেলা শুরু। চার বছর বয়সে তৃষাকে জিমে নিয়ে যান রামি রেড্ডি। সেখানে তিনি প্রশিক্ষকের কাজ করতেন। ছোট থেকেই মেয়ের শারীরিক শক্তির দিকে নজর রেখেছিলেন। তৃষার জন্য ডায়েট মেনে খাবার তৈরি হত।
কেন এত আগে থেকে প্রস্তুতি নিয়েছিলেন রামি রেড্ডি? একটাই কারণ। মেয়েকে এক কদম এগিয়ে রাখা। মেয়ে বিশ্বকাপের সেরা ক্রিকেটার হওয়ার পরে তাই আবেগ ধরে রাখতে পারেননি তিনি। বলেছেন, “সাধারণত সকলে সাত-আট বছর বয়স থেকে খেলা শুরু করে। কিন্তু তখনই তো অনেক প্রতিযোগিতা। তাই আমি চেয়েছিলাম ওই বয়সে যাওয়ার আগে তৃষা তৈরি হয়ে যাক। সেটা আমি করতে পেরেছি। মেয়ে আমাকে গর্বিত করেছে। আর কী চাই!”
তৃষা ছোট থাকতেই পাশের একটি কলেজে সিমেন্টের পিচ তৈরি করান রামি রেড্ডি। সেখানে তৃষাকে প্রতি দিন অন্তত এক হাজার বল করতেন তিনি। রামি রেড্ডি জানতেন, যত বেশি বল তৃষা খেলবেন, তত তাড়াতাড়ি তাঁর মাসল মেমোরি তৈরি হবে। বলের সঙ্গে তত তাড়াতাড়ি তিনি নিজেকে মানিয়ে নিতে পারবেন। রামি রেড্ডি যে ঠিক ছিলেন তা বিশ্বকাপে দেখা গিয়েছে। বাকিদের থেকে সেখানে অনেকটা এগিয়ে থেকেছেন তিনি।
তৃষার খেলায় যাতে বাধা না হয়, তার জন্য তাঁকে কয়েক বছর স্কুলেও পাঠাননি রামি রে়ড্ডি। যখন পাঠান তখন স্কুলের সঙ্গে কথা বলে নিয়েছিলেন যে তিন ঘণ্টার বেশি ক্লাব করবেন না তৃষা। সেটাই হয়। প্রতি দিন তিন ঘণ্টা স্কুল ও ছয় থেকে সাত ঘণ্টা ক্রিকেট অনুশীলন চলত তৃষার। ফলে মাত্র ১২ বছর বয়সে হায়দরাবাদের অনূর্ধ্ব-২৩ দলে খেলেছেন তিনি। ১৩ বছর বয়সে খেলেছেন সিনিয়র দলে।
তৃষাকে আরও উন্নত করতে সেন্ট জন ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে ভর্তি করে দিয়েছিলেন রামি রেড্ডি। সেখানে কোচ জন মনোজের অধীনে নিজেকে তৈরি করেছেন তৃষা। এই অ্যাকাডেমি থেকেই বেরিয়েছেন ভিভিএস লক্ষ্মণ, মিতালি রাজেরা। খুব অল্প দিনে ভারতীয় ক্রিকেটে নিজের নাম করেছেন ত়ৃষা। অ্যাকাডেমিতে অনুশীলনের সময় মিতালিকেও আউট করেছেন তিনি। খুব দ্রুত তিনি ভারতের সিনিয়র দলে খেলবেন, এমনটাই মনে করেন মনোজ। তিনি বলেছেন, “সচিন তেন্ডুলকর কেন ১৬ বছর বয়সে ভারতীয় দলে খেলেছিলেন? কারণ, তিনি ব্যতিক্রমী। তৃষাও খেলবে। কারণ, আমাদের মেয়েও ব্যতিক্রমী। তৃষার এখন লক্ষ্য সিনিয়র দলের হয়ে ভারতীয় দলে প্রতিনিধিত্ব করা। এখন জুনিয়র দলের হয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছি, তা আমার কাছে অবশ্যই বড় প্রাপ্তি। চ্যাম্পিয়ন হওয়ার অনুপ্রেরণায় আগামী দিনে আরও বড় জায়গায় পৌঁছনোর জন্য সবরকম চেষ্টা থাকবে। শুধু সময়ের অপেক্ষা।