প্রবীর মজুমদার
গুয়াহাটিতে দ্বিতীয় টেস্টে দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে ভারত চারশো আট রানে টেস্ট হেরেছে। ঘরের মাঠে এই নিয়ে পরপর পাঁচটা টেস্টে ভারত হারল। ভারতের পরবর্তী টেস্ট সিরিজ আগামী বছরের আগষ্ট মাসে শ্রীলঙ্কায়। তারপর বছরের শেষদিকে নিউজিল্যান্ডে। আবার দেশের মাঠে টেস্ট সেই ২০২৭ সালের গোড়ায় অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে।
Advertisement
আগামী রবিবারই দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে একদিনের ম্যাচের সিরিজ শুরু হবে। তারপররেই টি-২০ সিরিজ। সেটা মিটতে মিটতেই এসে যাবে নতুন বছর। তখন এসে পড়বে নিউজিল্যান্ড – তিনটে একদিনের ম্যাচ আর পাঁচটা টি-২০ ম্যাচ খেলতে। সেটা মিটলে ঘরের মাঠে টি-২০ বিশ্বকাপ। মার্চের গোড়ায় বিশ্বকাপ মিটবে। তার সপ্তাহখানেক পরেই শুরু হয়ে যাবে ভারতীয় ক্রিকেটের মহাধামাকা- আইপিএল – যার জন্যে সারাবছর অধীর আগ্রহে বসে থাকেন বিজ্ঞাপনদাতা, ক্রিকেট বোর্ড ও ক্রিকেটাররা; এমনকি আমরাও। সুতরাং দক্ষিণ আফ্রিকার দলের কাছে নাকানি চোবানি খেয়েও গৌতম গম্ভীর যে ঔদ্ধত্যে সাংবাদিক সম্মেলনে নিজের ছাড়া সকলের দোষ ধরেছেন – তা ভেবেচিন্তেই করা। দিল্লির প্রাক্তন সাংসদ গম্ভীর জানেন, দেশের মানুষ খেলার মাঠের এই ব্যর্থতা, অভূতপূর্ব হলেও, তাড়াতাড়ি ভুলে যাবেন। সাদা বলের প্রতিযোগিতায় ভালো ফল করলেই আবার সব বরাবর হয়ে যাবে।
Advertisement
টেস্ট ক্রিকেটে সব দলই দেশের মাঠে বাঘ, ভারতও। গতবছর নিউজিল্যান্ডের কাছে ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যাওয়ার আগে ভারত দেশের মাঠে হেরেছিল সেই ২০১২-১৩ মরশুমে অ্যালাস্টেয়ার কুকের ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে। এই শতাব্দীতে প্রথম সিরিজ হারে ২০০৪-০৫ মরশুমে অ্যাডাম গিলক্রিস্ট-রিকি পন্টিংয়ের অস্ট্রেলিয়ার কাছে। শ্রীলঙ্কা আজ পর্যন্ত জেতেনি, নিউজিল্যান্ডও আগে কখনো জেতেনি। তারা শেষবার এ দেশে একটা টেস্ট ম্যাচই জিতেছিল সেই ১৯৮৮ সালে, তাও ১৯৬৯ সালের পর প্রথমবার। এমনকি পাকিস্তান, যাদের সঙ্গে আমাদের আবহাওয়া ইত্যাদি সবচেয়ে বেশি মেলে, তারাও ১৯৫২-৫৩ থেকে ২০০৭-০৮ পর্যন্ত ভারত সফরে এসে সিরিজ জিততে পেরেছিল মাত্র একবার – ১৯৮৬-৮৭ মরশুমে। সুতরাং এই যে আজকাল প্রায়ই যে শোনা যায় বিরাট কোহলি নাকি দেশের মাটিতে অপরাজেয় দল গড়ে তুলেছিলেন, সেটাকে গম্ভীর নষ্ট করে দিয়েছেন – সেটা বোকা ঔদ্ধত্যে পূর্ণ অর্ধসত্য। এরকম ঔদ্ধত্যই ভবিষ্যতের কবর খোঁড়ে। আসলে বিরাট দায়িত্ব নেওয়ার আগেও ভারতীয় দল দেশে অপরাজেয়ই ছিল।
বিরাটের আমলে ভারত নিউজিল্যান্ডকে নিউজিল্যান্ডে হারাতে পারেনি, দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেট ইতিহাসের দুঃসময়েও দু-বারের চেষ্টায় একবারও সিরিজ জিততে পারেনি। ইংল্যান্ডেও শোচনীয় হার আর ড্রয়ের ইতিহাস। রোহিতের আমলেও ফলাফল বদলায়নি। গত এক যুগে বিদেশে সাফল্য বলতে পরপর দুবার অস্ট্রেলিয়ায় সিরিজ জেতা। তার মধ্যে ২০২০-২১ মরশুমে কিন্তু প্রথম টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে লজ্জাজনকভাবে ৩৬ রানে অল আউট হয়ে যাওয়া আছে। দ্বিতীয় টেস্ট থেকে বিরাট ছিলেনই না। মেলবোর্নে লড়াকু শতরান করেন অস্থায়ী অধিনায়ক রাহানে, ভারত জেতে। তারপর সিডনির তৃতীয় টেস্টে হনুমা বিহারী আর অশ্বিন শেষদিনে অত্যাশ্চর্য ব্যাটিং করে ম্যাচ বাঁচিয়ে দেন। ব্রিসবেনে চতুর্থ টেস্ট জিতে ভারত সিরিজ জয় করে। ধোনির আমলে বিদেশ সফরের ইতিহাস তো আরও কম উল্লেখযোগ্য। দুর্বল ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে সিরিজ জয় আর সেই ২০০৮-০৯ মরশুমে নিউজিল্যান্ডে সিরিজ জেতা ছাড়া।
আজ কোচ গম্ভীর আর প্রধান নির্বাচক অজিত আগরকরের ক্রিকেট বুদ্ধির প্রভাবে টেস্ট দলের যে হাস্যকর চেহারাটা হয়েছে, তারও সূচনা ধোনি-শাস্ত্রী, বিরাট-শাস্ত্রী আমলেই। বিরাট অধিনায়ক হিসাবে নিজের প্রথম ১৪-১৫ খানা টেস্টের একটাতেও একই একাদশ খেলাননি। কেবলই বদলাতে থাকতেন। ধোনির আমল থেকেই দেখা গেছে, সম্ভাবনাময় টেস্ট ক্রিকেটারদের লালন করে না দল। উলটে তাদের ক্ষতি করে। যেমন ভুবনেশ্বর কুমারের অযোগ্যতা হয়ে দাঁড়াল বল সুইং করানোর দক্ষতা। দেখা গেছে, তিনি একটা টেস্টে পাঁচ উইকেট নিয়ে পরের টেস্টে বাদ পড়ে যাচ্ছেন। হার্দিক পান্ডিয়া একবার দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে একটা টেস্টে প্রায় শতরান করে ফেলেছিলেন আর চারটে উইকেট নিয়েছিলেন। তাতেই তাঁকে মিডিয়া পরবর্তী কপিলদেব বলে ফেলল। কিন্তু কয়েকটা টেস্ট যেতে না যেতেই দেখা গেল – না তিনি ব্যাটে সুবিধা করতে পারছেন, না বলে অপরিহার্য।
আজকাল ব্যাটসম্যানদের ট্যালেন্ট মাপা হয় আইপিএলের রান দিয়ে। স্বভাবতই তরুণ ব্যাটসম্যানরা চার-ছয় মারার দিকে মন দেবেন, স্পিনের বিরুদ্ধে ফুটওয়ার্ক শেখায় নয়। রঞ্জি ট্রফির রানকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। রঞ্জি ট্রফিতে সাড়া জাগানো ইনিংস খেলেও ব্রাত্য থেকে যায় অনেক তরুণ প্রতিভা।
শুধু কি ব্যাটিংয়ের এই অবস্থা? বোলিংয়েরও তো কঙ্কালসার চেহারা। বিরাট অধিনায়ক থাকার সময়ে দিনরাত বলাবলি এবং লেখালিখি হত – তিনি নাকি পেস বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলেছেন। এদিকে ওই পেস ব্যাটারি বিদেশে সিরিজ জেতাতে পারত না, দেশের ধুলো ওড়া পিচে দারুণ। অধিনায়ক বিরাটের বিদেশে স্মরণীয় জয়গুলোর স্থপতি আসলে যশপ্রীত বুমরা আর মহম্মদ শামি। শামির বয়স বেড়েছে, চোট-আঘাত বেড়েছে। গম্ভীর-আগরকর জুটি কোনো অজ্ঞাত কারণে তাঁকে আর দলে নেবেন না। কিন্তু বুমরা তো আছেন। তাঁর বয়স মোটে ৩১। অথচ দেখা যাচ্ছে তিনিও টানা তিনটে টেস্ট খেলার অবস্থায় নেই।
আর স্পিনের কথা? রবিচন্দ্রন অশ্বিন পাঁচশোর বেশি উইকেট নিয়েছেন, জাদেজা প্রায় সাড়ে তিনশো। দু’জনেই দেশের সেইসব পিচে রাজা, যেগুলো ব্যাটিংয়ের পক্ষে এত অনুপযুক্ত যে ওঁরা রান করে উঠতে পারেননি। আর বিদেশে অশ্বিনকে খুব বেশি ম্যাচ খেলানোর সাহসই করে উঠতে পারলেন না তাঁর টেস্ট জীবনের তিন অধিনায়ক। কিন্তু বিদেশের স্পিন সহায়ক নয় এমন পিচে একটা ম্যাচেও তাঁকে বিশ্বমানের বোলার মনে হয়নি। দেশের মাঠে নিউজিল্যান্ড সিরিজ আর এই সদ্যসমাপ্ত সিরিজে প্রচণ্ড স্পিন সহায়ক আর সাধারণ ভারতীয় – দুরকম পিচেই যেভাবে মিচেল স্যান্টনার, সাইমন হার্মাররা জাদেজাকে টেক্কা মেরে বেরিয়ে গেলেন, তাতে ওই সাড়ে তিনশো উইকেটের বেশিরভাগটাই যে পিচের দাক্ষিণ্যে – এমন সন্দেহ দৃঢ় হয়।
ইডেনের পিচ দেখে ভারতীয় সমর্থকরা বলেছিলেন, অমন পিচে খেলার দরকার নেই। ওতে মুড়ি মিছরি এক দর হয়ে যায়। তাই বিদেশের স্পিনাররা আমাদের স্পিনারদের থেকে বেশি উইকেট নিয়ে ফেলে। আমাদের ক্রিকেটারদের যা প্রতিভা, তাতে ভালো পিচেই আমরা দিব্যি জিততে পারি। গুয়াহাটির বর্ষাপাড়া স্টেডিয়ামের পিচ দেখিয়ে দিল – সমর্থকরা দিবাস্বপ্ন দেখেন। গম্ভীর জানেন জাদেজা, অক্ষর প্যাটেলদের সীমাবদ্ধতা।
আইপিএল দেখুন, টেস্ট ক্রিকেট ভুলে যান। কারণ টেস্টে কী হল তা নিয়ে বিসিসিআই-এর মাথাব্যথা নেই।
Advertisement



