বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের খেতাব তুলে নিল দক্ষিণ আফ্রিকা। প্রথম ইনিংসে দক্ষিণ আফ্রিকা ৭৪ রানে পিছিয়ে ছিল। কিন্তু দ্বিতীয় ইনিংসে অস্ট্রেলিয়া দল খেলতে নেমে তাদের সেই দাপট চোখে পড়ল না। বরঞ্চ দক্ষিণ আফ্রিকার বোলারদের মোকাবিলা করতে গিয়ে দ্বিতীয় ইনিংস মাত্র ২০৭ রানে শেষ করে অস্ট্রেলিয়া। ২৮১ রানে এগিয়ে থাকে অস্ট্রেলিয়া। তার জবাবে খেলতে নেমে দক্ষিণ আফ্রিকা ৫ উইকেট হারিয়ে ২৮২ রান করে জয়েল উল্লাসে মেতে ওঠেন খেলোয়াড়রা। দক্ষিণ আফ্রিকার ওপেনার মার্করাম অসাধারণ একটা ইনিংস খেললেন। অস্ট্রেলিয়ার বোলারদের এককথায় বলা যায় উড়িয়ে দিতে তাঁর ব্যাট ঝলসে উঠল। তিনি ১৩৬ রান করে দক্ষিণ আফ্রিকার স্কোরবোর্ডকে শুধু উজ্জ্বল করেননি। জয়ের পথকে মসৃণ করে তুলেছিলেন। এই রান করতে গিয়ে তিনি ২০৭টি বল খেলেছিলেন। তাঁর ব্যাট থেকে কোনও ছক্কা না এলেও ১৪টি বাউন্ডারি হয়েছে। আবার দলের অধিনায়ক টেম্বা বাভুমা হাল ধরেছিলেন। স্বচ্ছন্দে তিনি খেলতে থাকেন উইকেটে। প্যাট কামিন্সরা অনেক চেষ্টা করেও আসল লক্ষ্যে পৌঁছতে পারেননি। বাভুমা ৬৬ রান উপহার দিয়েছেন। খেলেছেন অবশ্য ১৩৪টি বল। তিনিও কোনও ছক্কা মারতে পারেননি। তবে চারটি বাউন্ডারি মেরে ওই রান সংখ্যাটা পৌঁছে গেলেন। শেষ পর্যন্ত ৮৩.৪ ওভারে ২৮২ রান তুলে অস্ট্রেলিয়াকে পরাস্ত করে বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের খেতাবটা তুলে নিল দক্ষিণ আফ্রিকা।
১৯৯৮ সালে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জিতেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। নির্বাসন কাটিয়ে সাড়ে তিন দশক পর টেস্ট ক্রিকেটের সিংহাসনে বসার সম্মান পেলেন বাভুমারা। দীর্ঘদিন দক্ষিণ আফ্রিকা বলতেই ‘চোকার্স’ তকমাটা লেখা হত। কিন্তু তা মুছে দিলেন বাভুমা ও মার্করামরা। দ্বিতীয় ইনিংসে অস্ট্রেলিয়ার প্যাট কামিন্স, মিচেল স্টার্ক ও হেজেলউডরা তেমনভাবে সুযোগ পাননি প্রতিপক্ষ দলের বোলারদের মোকাবিলা করতে। বিশেষ করে রাবাডার বোলিংয়ের কাছে তাঁদের হার মানতে হয়। যার ফলে বড় অঙ্কের স্কোরবোর্ডে নাম লেখাতে পারেনি অস্ট্রেলিয়া। কোনও কোনও সময় তাঁদের দেখা গিয়েছে রক্ষণাত্মক ভূমিকা পালন করে বোলারদের সামাল দিতে। কিন্তু তা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। দক্ষিণ আফ্রিকার অধিনায়ক যেভাবে ফিল্ডিংটা সাজিয়েছিলেন, তাতে অস্ট্রেলিয়া দলের রান পাওয়াটা বেশ কঠিন হয়ে গিয়েছিল। সেই কারণে দ্বিতীয় ইনিংসে দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেটাররা বাড়তি সুযোগ পেয়ে যান জয়ের পথে পৌঁছতে। শনিবার চতুর্থ দিনে অস্ট্রিলিয়া হয়তো বুঝেই গিয়েছিল তাদের সামনে হার ছাড়া অন্য কোনও ছবি দেখতে পাওয়া যাবে না। তাই খেলোয়াড়দের শরীরী ভাষা সে কথাই বারবার ফুটে উঠেছিল।
দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেট ইতিহাস দীর্ঘদিনের। ব্রিটিশদের হাত ধরে ১৯৮০ সালে তাদের ক্রিকেট খেলা শুরু হয়। ধীরে ধীরে তারা পরিণত হয়। ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার পর তারাই তৃতীয় দেশ যারা টেস্ট খেলেছে। ১৯৭০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেটে বড় ঝড় বয়ে যায়। বলা হয় কোনও কৃষ্ণাঙ্গ ক্রিকেটারকে নেওয়া যাবে না। যার ফলে তারা শাস্তি পায়। ২১ বছর তারা নির্বাসিত ছিল। আইসিসি নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও তারা টেস্ট খেললেও সরকারি কোনও স্বীকৃতি ছিল না। অবশ্য ১৯৯১ সালে নতুন পলিসি আনার পরে আইসিসি তাদের আবার ক্রিকেট খেলায় অনুমতি দেয়। তবে নির্দিষ্ট সংখ্যক কৃষ্ণাঙ্গ ক্রিকেটারকে রাখতে হবে। এই নির্বাসন কাটিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা প্রথম টেস্ট খেলতে আসে কলকাতায়। ১৯৯২ সালে কলকাতার ইডেন গার্ডেন্সে ভারতের বিরুদ্ধে তারা প্রথম টেস্ট ম্যাচ খেলে। এই টেস্ট ম্যাচ আয়োজনের পক্ষে বড় ভূমিকা নিয়েছিলেন তৎকালীন বিসিসিআইয়ের সভাপতি জগমোহন ডালমিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেট বোর্ডের প্রধান আলি বাখার। ওই টেস্ট ম্যাচে ভারতীয় দলকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন কপিল দেব। কপিল দেবের ভারতের কাছে ওই ম্যাচ হারতে হয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকাকে। দীর্ঘ ২২ বছর বাদে লাল বলের ক্রিকেটে দক্ষিণ আফ্রিকার খেলোয়াড়দের দেখতে পাওয়া গিয়েছিল। ক্রিকেটে ফিরে আসার পরে ১৯৯২ সালের বিশ্বকাপ ক্রিকেটে প্রথমবার প্রকৃতির কাছে তাদের হার মানতে হয়েছিল। সেমিফাইনালে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে জয়ের জন্য রান তাড়া করেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। ফাইনালে খেলার জন্য ১৩ বলে ২২ রানের দরকার ছিল তাদের। বৃষ্টিতে খেলা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরে আবার খেলা শুরু হওয়ার পরে ডাকওয়ার্থ লুইস নিয়মে ১ বলে ২২ রানের প্রয়োজন ছিল। সেটা সম্ভব হয়নি দক্ষিণ আফ্রিকার পক্ষে। তার সাত বছর বাদে প্রথম আইসিসি ট্রফি জিতেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। বাংলাদেশের মাটিতে তাদের হাতে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি শোভা পেয়েছিল। তারপর থেকে অনেক হতাশার মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেটারদের দিন কাটাতে হয়েছে। আইসিসি প্রতিযোগিতার সেমিফাইনালে খেলায় যোগ্যতা অর্জন করেছিল ১১ বার। কিন্তু একবারের জন্যও সেমিফাইনাল ম্যাচ জিতে ফাইনালে খেলার ছাড়পত্র পায়নি। ১৯৯৯ সালে বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে ডোনাল্ডের ‘বেনফেড’ হয়ে রান আউট ক্রিকেটের ইতিহাসে আজও উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে।
দক্ষিণ আফ্রিকা গত বছর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠেছিল। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জেতার ২৬ বছর বাদে তারা ফাইনালে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে। প্রতিপক্ষ ছিল ভারত। একটা সময় মনে হয়েছিল হয়তো ভারতকে হেরে যেতে হবে দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে। খেলায় এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, যদি দক্ষিণ আফ্রিকা ২৪ বলে ২৬ রান করতে পারে, তাহলে বাজিমাত করবে। কিন্তু ভারতের বোলাররা করতে দেননি। এই মুহূর্তে দক্ষিণ আফ্রিকার অন্ধকারের দিন শেষ হয়ে গেল। নতুন আলোয় তারা আলোকিত। আর এই নতুন আলোকবর্তিকা জ্বালিয়ে দিলেন অধিনায়ক বাভুমা। এই বাভুমার ২০১৪ সালে টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেক হয়। তিন ফরম্যাটেই ধীরে ধীরে তিনি নিজেকে প্রকাশ করতে থাকেন। ২০১৬ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ ক্রিকেটার হিসেবে টেস্ট ক্রিকেটে শতরান করেন। ২০২১ সালে তাঁর হাতে অধিনায়কের ব্যাটনটা তুলে দেওয়া হয় একদিনের ক্রিকেটে। তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ অধিনায়ক। ২০২৩ সালে টেস্ট ক্রিকেটের অধিনায়ক হন তিনি। ১০টি টেস্ট ম্যাচের মধ্যে তাঁর অধিনায়কত্বে ৯টি ম্যাচ জেতার রেকর্ড রয়েছে। একটা ম্যাচও তিনি হারেননি। তাই তাঁর দক্ষতা নিয়ে কোনও প্রশ্নই উঠতে পারে না। তাঁর ক্রিকেট কেরিয়ারে এখনও পর্যন্ত চারটি শতরান রয়েছে। পাশাপাশি ৭০, ৮০ ও ৯০ রানের ইনিংসও খেলেছেন। স্বাভাবিকভাবে বাভুমার এই কৃতিত্ব তাঁকে শিরোনামে পৌঁছে দিয়েছে।
আর এবারে দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে খেলবে এটা অনেকের কাছে দূরঅস্ত ছিল। কিন্তু শেষ দু’টি সিরিজে পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে ফাইনালে খেলার টিকিটটা পেয়ে যায়। অনেকে হয়তো বলেছিলেন কমসংখ্যক ম্যাচ খেলে দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে গেছে। লর্ডসে পৌঁছে দক্ষিণ আফ্রিকা যে ক্রিকেট উপহার দিয়েছে, তা মনে রাখার মতো। তা না হলে দ্বিতীয় দিনের শেষে ডিভিলিয়ার্স বলেছিলেন, দক্ষিণ আফ্রিকা জিতলে কেঁদে ফেলবেন তিনি। হয়তো এখন মার্করাম, বেডিংহ্যাম জুটির খেলা দেখে নিশ্চয়ই তিনি কাঁদছেন। এটাও ঠিক অস্ট্রেলিয়া দ্বিতীয় ইনিংসের পরে দক্ষিণ আফ্রিকা খেতাব জিতে নেবে, কোনও ক্রিকেট বিশেষজ্ঞরা ভাবতেই পারেননি। তাই তো শোনা গিয়েছিল, দক্ষিণ আফ্রিকা ২৮২ রান তাড়া করা অসম্ভব। সেই অসম্ভবকে সম্ভব করে দেখিয়ে দিলেন বাভুমা ও মার্করাম। যেভাবে তাঁরা অস্ট্রেলিয়ার দুরন্ত বোলার মিচেল স্টার্ক, প্যাট কামিন্স ও হেজেলউডদের মোকাবিলা করেছেন, তা ভাবা যায় না। এই বাভুমার পাশে প্রথম ইনিংসে খেলতে নেমে মার্করাম শূন্য রানে প্যাভিলিয়নে ফেরত গিয়েছিলেন। আর সেই মার্করামই দ্বিতীয় ইনিংসে শতরান করে দলের জয়কে প্রায় নিশ্চিত করে দেন। চতুর্থ দিনে বাভুমা দুরন্ত খেলে তাঁর ব্যাট যেন কথা বলছিল। দক্ষিণ আফ্রিকার এই জয়ে প্রাক্তন ক্রিকেটাররা আবেগে ভেসে গেলেন। কীভাবে এই দিনটাকে উদযাপিত করবেন, তা প্রকাশ করতে পারছিলেন না। তাঁদের শরীরী ভাষায় বারবার যেন মনে হয়েছিল, এতদিন যেভাবে আমাদের সমালোচিত হতে হয়েছে তাঁদের কাছে উচিত জবাবটা দেওয়া গেল। সত্যিই একজন কৃষ্ণাঙ্গ অধিনায়কের হাত ধরে দক্ষিণ আফ্রিকার এই সাফল্যকে সারা বিশ্ব কুর্নিশ জানাচ্ছে।