নিজস্ব প্রতিনিধি– চলতি সপ্তাহের শুরুতেই অর্থাৎ গত সোমবার কলকাতা হাইকোর্টের বৃহত্তর বেঞ্চ এক নজিরবিহীন রায়দান করেছে৷ সেখানে গত ২০১৬ সালের এসএসসিতে চারটি বিভাগে নিয়োগে ২৫,৭৫৩ জনের চাকরি বাতিল হয়েছে৷ এতে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে সাধারণ চাকরিপ্রার্থীদের মধ্যে৷ নিয়োগে যোগ্য যারা, তারা সর্বমোট নিয়োগে অল্পসংখ্যক অবৈধ নিয়োগের জন্য চাকরি হারিয়েছেন৷ মঙ্গলবার এইসব চাকরিচু্যত শিক্ষকেরা শহীদ মিনারে বিক্ষোভ দেখান৷ আজাহারউদ্দিন রকি নামে এক চাকরিহারা শিক্ষক এদিন সংবাদ মাধ্যমের কাছে ক্ষোভ উগরে দেন৷ প্রায় দু’বছরের কাছাকাছি সিবিআই তদন্ত চালাচ্ছে৷ তাতে কেন প্রকৃত যোগ্যদের চাকরি বাতিল হবে? সেই প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই৷ তাদের বক্তব্য কেন অযোগ্য কয়েক জনের জন্য যোগ্যদের শাস্তি পেতে হচ্ছে? সিবিআই এতদিন ধরে তল্লাশি চালিয়ে কেন যোগ্য-অযোগ্য চাকরিজীবিদের মধ্যে ফারাক করতে পারল না৷ তাদের আরও প্রশ্ন সিবিআই এতদিন ধরে কি করল৷ মঙ্গলবার সকাল থেকেই বিভিন্ন জেলার চাকরিপ্রার্থীরা জড়ো হয়েছেন শহিদ মিনার চত্ত্বরে৷ তাদের প্রত্যেকেরই বক্তব্য হঠাৎ করে চাকরি হারালে তাদের বড় রকম সমস্যায় পড়তে হবে৷ আর্থিক সংকটের পাশাপাশি তাদের সামাজিক সংকটের মুখোমুখি হতে হয়েছে৷
চাকরিহারাদের একাংশের কথায় অযোগ্য চাকরিপ্রাপকদের জন্য যোগ্য চাকরিপ্রাপকদের অপরাধী হিসেবে দেখা হবে৷ হাইকোর্টের নির্দেশে চাকরিহারারা দ্রুত সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হবে বলে জানা গেছে৷ ইতিমধ্যেই প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জড়ো করতেও শুরু করেছে তারা৷ এক চাকরিহারা জানিয়েছেন, ‘তারা ওআরএম শিট বা উত্তরপত্রগুলি জড়ো করছেন৷ সেখানে দেখা যাচ্ছে অনেকেরই নাম মেধাতালিকায় রয়েছে’৷ সেইসব কাগজ নিয়েই সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হবেন৷ সেখানেই ন্যায়বিচার চাইবেন তাঁরা৷ যারা অযোগ্য তাদের কোনও মাথাব্যাথা নেই৷ কিন্ত্ত যারা যোগ্য তারা আন্দোলন চালিয়ে যাবে বলেও জোরের সঙ্গে জানিয়েছেন৷ এই রাজ্যে নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় কলকাতা হাইকোর্টের সিঙ্গেল বেঞ্চ থেকে ডিভিশন বেঞ্চ এর পাশাপাশি নিম্ন আদালতে সিবিআইয়ের তদন্ত নিয়ে প্রশ্ন দেখা গেছে৷ ২৪ হাজার নিয়োগের মধ্যে মাত্র ৫ হাজার নিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে৷ বাকি ১৯ হাজার চাকরি কিভাবে অবৈধ হল? তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে এসএসসি কর্তৃপক্ষ৷ এসএসসির চেয়ারম্যান সিদ্ধার্থ মজুমদার বলেন, ‘আমরা অর্ডারটি দেখে আমাদের আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলবো৷ সিবিআই যে তদন্ত করছিল, তাতে মোটামুটি ৫ হাজার জনের চাকরি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল৷ আর চাকরি করছিলেন ২৪ হাজারের বেশি শিক্ষক ও অশিক্ষক কর্মী৷ তাহলে এই ৫ হাজার বাদ দিয়ে বাকি ১৯ হাজার জনের চাকরি যাওয়ার বিষয়ে আদালত কী যুক্তি দিচ্ছেন, তা জানতে হবে৷’ কলকাতা হাইকোর্টের রায় প্রসঙ্গে রাজ্যের শিক্ষক সংগঠন হিসেবে মাধ্যমিক শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী সমিতি’র সভাপতি গৌতম মহান্তি ও সাধারণ সম্পাদক নীলকান্ত ঘোষ সংবাদমাধ্যমে জানিয়েছেন, ‘‘সমিতি মনে করে অনৈতিক উপায়ে প্রাপ্ত চাকরি বাতিল করা একেবারে ঠিক কাজ৷ এই অনৈতিক নিয়োগ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত শিক্ষা প্রশাসনের আমলা তথা নেতা মন্ত্রীদের কঠোর শাস্তি প্রদান করার দাবি করছি৷ সমান্তরাল ভাবে উপযুক্ত যোগ্যতার ভিত্তিতে চাকরি প্রাপকদের চাকরি নিয়ে কোনো অনিশ্চয়তা তৈরি হওয়া কাম্য নয়, সমিতি সর্বতোভাবে তাদের পাশে আছে এবং থাকবে৷ যোগ্য অথচ বঞ্চিত চাকরি প্রার্থীদের নিয়োগের দাবিতে ন্যায্য অধিকার আদায়ে আমাদের সমিতি লড়াই আন্দোলন চালিয়ে যাবে’’৷ শিক্ষানুরাগী ঐক্য মঞ্চের সাধারণ সম্পাদক কিঙ্কর অধিকারী সংবাদ মাধ্যমে বলেন, ‘‘কোনভাবেই যোগ্য ব্যক্তিদের চাকরি বাতিল করা চলবে না৷ সবাই অযোগ্য – কোনোভাবেই তা হতে পারে না৷ সঠিক বিচার চাই৷ তথ্য যাচাইয়ের ক্ষেত্রে সরকার এবং এসএসসিকে বাধ্য করে অযোগ্যদের আলাদা করে চিহ্নিত করতে হত তদন্তকারী সংস্থাকে৷ এসএসসির দুর্নীতির বিরুদ্ধে রায়ের মধ্য দিয়ে যেন কোনোভাবেই যোগ্য ব্যক্তিরা শাস্তি না পায় তা নিশ্চিত করতে হবে৷ দীর্ঘদিন রাস্তায় পডে় থাকা যোগ্য বঞ্চিতরা দ্রুত নিয়োগ পাক৷ শুধু তাই নয়, দুর্নীতির সঙ্গে জডি়ত সমস্ত মাথাকে দৃষ্টান্তমূলক চরম শাস্তি দিতে হবে৷’’ উল্লেখ্য, গ্রুপ সি, গ্রুপ ডি এবং নবম-দশম, একাদশ-দ্বাদশের ২৫ হাজার ৭৫৩ জনের চাকরি বাতিলের নির্দেশ দিয়েছে বিচারপতি দেবাংশু বসাক ও বিচারপতি শব্বর রশিদির ডিভিশন বেঞ্চ৷ এর পাশাপাশি, চার সপ্তাহের মধ্যে অতিরিক্ত শূন্যপদে চাকরিপ্রাপকদের ১২ শতাংশ সুদ-সহ বেতন ফেরত দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট৷ ২৩ লক্ষ পরীক্ষার্থীর ওএমআর শিট পুনর্মূল্যায়নেরও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে৷ হাইকোর্টের নির্দেশ, নিয়োগ দুর্নীতির তদন্ত চালিয়ে যাবে সিবিআই৷ যাকে প্রয়োজন, তাকেই হেফাজতে নিতে পারবে তারা৷ এর পাশাপাশি, টেন্ডার ডেকে নতুন করে নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করতে এসএসসি কে নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট৷ গত সোমবার ৩৫০টি মামলার রায় ঘোষণা করলো বিচারপতি দেবাংশু বসাক ও মহম্মদ শব্বর রশিদির ডিভিশন বেঞ্চ৷ প্রায় সাডে় তিন মাস ধরে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে হাইকোর্টের বিশেষ বেঞ্চে মামলার শুনানি চলেছে৷ গত ২০ মার্চ ওই বেঞ্চে শুনানি শেষ হয়৷ রায় ঘোষণা স্থগিত রেখেছিল আদালত৷ ২০২১ সালের জুন মাসে শুনানি শুরু তৎকালীন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের এজলাসে৷ গত ২২ নভেম্বর সন্দীপ প্রসাদের মামলায় গ্রুপ-ডি নিয়োগ মামলায় প্রথম সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেন বিচারপতি৷ গত ৬ ডিসেম্বর বিচারপতি হরিশ ট্যান্ডন ও বিচারপতি রবীন্দ্রনাথ সমন্তের ডিভিশন বেঞ্চ সিবিআই-নির্দেশ স্থগিত করে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি রণজিৎ বাগের অনুসন্ধান কমিটি গডে়৷ ২০২২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সাবিনা ইয়াসমিনের মামলায় গ্রুপ-সি নিয়োগে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেন তৎকালীন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়৷ ডিভিশন বেঞ্চ সেই নির্দেশও স্থগিত করে বাগ কমিটিকে অনুসন্ধানের নির্দেশ দেয়৷ ৭ এপ্রিল নবম-দশম শিক্ষক নিয়োগের তদন্তও সিবিআই-কে৷ ওই বছরই ১৭ মে রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী পরেশ অধিকারীর মেয়ে অঙ্কিতা অধিকারীর বেআইনি নিয়োগ চিহ্নিত করে তাঁকে সরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ৷ একাদশ-দ্বাদশ নিয়োগের তদন্তও সিবিআই-কে দেওয়া হয়৷ ১৮ মে বিচারপতি সুব্রত তালুকদারের ডিভিশন বেঞ্চ বাগ কমিটির রিপোর্ট গ্রহণ করে সব নিয়োগ দুর্নীতির মামলা সিবিআই-কে তদন্তের নির্দেশ দেয়৷ ২২ জুলাই নিয়োগ মামলায় ইডির হাতে গ্রেফতার হন প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়৷ ২৮ সেপ্টেম্বর সিবিআই আদালতে প্রথম রিপোর্ট জমা দিয়ে জানাল বিভিন্ন ভাবে নিয়োগে দুর্নীতি হয়েছে৷ ওই ডিসেম্বর থেকে পরের বছর মার্চ মাসে কর্মী ও শিক্ষক মিলিয়ে বেআইনি নিয়োগ চিহ্নিত করে ধাপে ধাপে প্রায় পাঁচ হাজার নিয়োগ বাতিল করা হয়৷ গত বছর ৯ নভেম্বর কলকাতা হাইকোর্টকে বিশেষ বেঞ্চ গঠন করে এসএসসি-র সব নিয়োগ মামলা একত্রিত করে শুনানির নির্দেশ দেয় সুপ্রিম কোর্ট৷ ছ’মাসের মধ্যে ফয়সালার সময় বেঁধে দেয় দেশের শীর্ষ আদালত৷ গত সোমবার বাংলার নিয়োগ দুর্নীতি ইতিহাসে যুগান্তকারী রায় দেয় কলকাতা হাইকোর্টের বৃহত্তর বেঞ্চ৷ প্রায় ২৬ হাজার চাকরি বাতিল হয়৷
