• facebook
  • twitter
Saturday, 14 December, 2024

বুদ্ধাবসান! পাড়ার ‘বাচ্চু’ আর নেই, মানতে পারছেন না পুরনো পড়শিরা

পাড়ার ‘বাচ্চু’দাকে বেশ সমীহ করেই চলতেন

১১/ডি, রামধন মিত্র লেন৷ উত্তর কলকাতার আর পাঁচটা সাধারণ পাড়ার মতোই শান্ত, প্রাণোচ্ছল এই পাড়া৷ রোজ বিকেলে এখনও বাড়ির সামনের দাওয়াতে বসে বয়স্কদের আড্ডা৷ তবে বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই এই পাড়া ছিল কিছুটা শোকস্তব্ধ, বলা চলে ভারাক্রান্ত৷ ঠিক যেমনটা হয়েছিল ১৯৯১ সালের ৩ নভেম্বর, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের প্রয়াণের দিন৷ সেই দিনও একই রকম শোকস্তব্ধ ছিল এই পাড়া। আর বৃহস্পতিবার সকলকে ছেড়ে গেলেন তাঁর পাড়ার আরও এক প্রাক্তন পড়শি ‘বাচ্চু’। তথা রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। একজনের কন্ঠ বাঙালির আবেগ, অন্য জন রাজ্য রাজনীতির প্রাক্তন কান্ডারী।

রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর প্রয়াণের খবরটা বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের ভাইপো গৌড় ভদ্রের কানে আসতে বেশি সময় লাগেনি৷ এককালের পাড়াতুতো ভাইয়ের প্রয়াণে শোকাহত তিনিও৷ বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের স্মৃতিবিজড়িত ওই বাড়িতে একাই থাকেন অশীতিপর বৃদ্ধ।

১৯৪৪ সালের পয়লা মার্চ শ্যামপুকুরের ১১/ডি রামধন মিত্র লেনের তিনতলা বাড়িতেই জন্মগ্রহণ করেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ৷ সেখানেই বেড়ে ওঠা৷ শৈশব ও কৈশোর, বুদ্ধদেবের প্রতিটা মুহূর্তের সাক্ষী থেকেছে এই পাড়া৷ সাক্ষী থেকেছেন গৌড়বাবুও৷ তখন অবশ্য পাড়ার ‘বাচ্চু’র গায়ে রাজনীতিবিদের সিলমোহর পড়েনি৷ বুদ্ধবাবুর কথা উঠতেই অশ্রুমিশ্রিত কণ্ঠে গৌড়বাবু বললেন, ‘‘ছোটো থেকেই ওঁর মধ্যে একটা প্রতিভা ছিল৷ পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলোতেও ছিল খুবই ভালো৷ পাড়াতে ওঁকে সবাই খুব ভালবাসতো৷’’ একই সঙ্গে রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর সংস্কৃতিমনস্কতারও সাক্ষী থেকেছেন বছর তিরাশির গৌরবাবু৷ তাঁর কথায়, ‘‘ছোট থেকেই পাড়ার পুজোতে বিভিন্ন নাটক করত ‘বাচ্চু’৷ নিজে নাটকও লিখত একটা সময়। আবৃতিও করতো খুব ভালো৷’’

১৯৬৬ সাল নাগাদ কলেজে পড়ার সময় সপরিবারে পাড়া ছাড়েন বুদ্ধবাবু৷ তারপর পেরিয়ে গিয়েছে অনেকটা সময়৷ রাজ্যের বিধায়ক থেকে শুরু করে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর সিংহাসনে বসেছেন পাড়ার ‘বাচ্চু’৷  কিন্তু শ্বেতশুভ্র ধুতির মতোই ছিল তাঁর জীবনযাপন। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হয়েও কোনোদিন গায়ে লাগতে দেননি হেভিওয়েট তকমা। পুরনো সতীর্থদের খোঁজ নিতে ভোলেননি কোনওদিনই৷ গৌড় ভদ্রের কথায়, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরও আমার খোঁজ নিয়েছে৷ খোঁজ রাখত পাড়ারও৷ পাড়ায় কোনও সমস্যা আছে কি না, তাও নিয়ম করে খোঁজ নিত ‘বাচ্চু’৷ নন্দন চত্বরে কোনও অনুষ্ঠানে দেখা হলেও চিলুবিলু ভিড় এড়িয়ে চলত কথোপকথন”৷ গৌড়বাবুর কথায়, ‘‘একবার নন্দনে আমাদের পাড়ার পরিচিত এক ভদ্রলোক গিয়েছিলেন। কিন্তু টিকিট পাইনি অনুষ্ঠান দেখার৷ সেটা হয়তো ‘বাচ্চু’ লক্ষ্য করেছিল৷ সেই লোক নন্দন বিমুখ হতেই ডাক পড়েছিল আবার৷ এক নিরাপত্তরক্ষী ডেকে নিয়ে গিয়েছিলেন ওঁর কাছে৷ তাঁকে টিকিট জোগাড় করে দিয়েছিল অনুষ্ঠান দেখার’’৷

জীবনকালেই মরণোত্তর দেহদান করে গিয়েছেন রাজ্যের শেষ বাম সেনাপতি এবং দ্বিতীয় বাম মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য৷ সেই মতো শুক্রবার বিকেলে তাঁর দেহ নিয়ে যাওয়া হয় এনআরএস হাসপাতালে৷ সেই খবর অবশ্য আগেই পেয়েছিলেন গৌড়বাবু৷ বছর তিরাশির বৃদ্ধ এখন সোজা হয়ে হাঁটতে অসমর্থ৷ হাঁটার সঙ্গী বলতে ওয়াকার৷

অন্যদিকে, পাড়ার ‘বাচ্চু’দাকে বেশ সমীহ করেই চলতেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর আর এক পড়শি বছর একষট্টির শঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়৷ পাশাপাশি বাড়ি হলেও তাঁকে বেশ ভয়ই পেতেন শঙ্করবাবু৷ বুদ্ধবাবুর সঙ্গে তাঁর শেষবারের মতো দেখা হয়েছিল বছর খানেক আগে৷ ১৯৮৭ সালে শঙ্করবাবুর বিয়ের সময় নিজে আসতে না পারলেও, বাড়ির অন্য সদস্যদের হাত দিয়ে পাঠিয়েছিলেন উপহার৷ তবে আক্ষেপ, কোনও দিনও ভয় কাটিয়ে সেইভাবে কথা বলে হয়ে ওঠা হয়নি ‘বাচ্চু’দার সঙ্গে৷

পাড়ার অদূরেই অবস্থিত শৈলেন্দ্র সরকার বিদ্যালয়৷ সেখানেই ১৯৫৪ থেকে ১৯৬১ সাল, দীর্ঘ আট বছর পড়ুয়া হিসেবে কাটিয়েছেন তিনি৷ কৃতি ছাত্রের প্রয়াণে মন খারাপ স্কুলেরও৷ স্কুলের বর্তমান সহকারি প্রধান শিক্ষক হরিনাথ নন্দীর কথায়, ‘মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন স্কুলে বহুবার এসেছেন৷ তবে নিজস্ব রক্ষীদের কোনও দিনও স্কুলের মধ্যে নিয়ে আসতেন না৷ বাইরে রেখে তবেই প্রবেশ করতেন ভিতরে৷’