ভারতে নাগরিকত্ব আইনের বিবর্তনের ধারা ও সাম্প্রতিক প্রতিক্রিয়া

Written by SNS March 17, 2024 1:34 pm

পার্থ প্রতিম সেন
ভারতবর্ষ দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে দ্বিখণ্ডিত হয়ে ১৯৪৭ সালের ১৫ আগষ্ট স্বাধীনতা লাভ করে৷ সে সময় নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানেরও জন্ম হয়৷ সে সময় অনেকেই একদেশ থেকে অন্য দেশে চলে যান৷ দু’টি দেশেই ব্রিটিশ রাজ থেকে স্বাধীনতা লাভের আগে পরে সাম্রদায়িক দাঙ্গা হাঙ্গামা ঘটে, মানবতা নির্যাতিত হয়৷ দেশভাগের যূপকাষ্ঠে অনেকেই বলি হন৷ পাকিস্তানের দু’টি অংশ ছিল: পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান৷ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও উত্তরপূর্ব ভারতের কয়েকটি রাজ্য যেমন আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা ও মিজোরাম রাজ্যের সীমান্তবর্তী ছিল পূর্ব পাকিস্তান৷ অন্য দিকে ভারতের জম্মু ও কাশ্মীর, গুজরাট, রাজস্থান ও পাঞ্জাব প্রদেশের সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তান সীমান্ত ভাগ করে নিয়েছিল৷ তারপর ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তান থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হয়৷ সে সময় ও পরবর্তী কালে একদেশ থেকে অন্য দেশে প্রব্রজন ঘটে৷ ফলস্বরূপ ভারতের মাটিতে পাকিস্তান বা বাংলাদেশ থেকে আসা অনেকেই উদ্বাস্তু, অনুপ্রবেশকারী, শরণার্থী ইত্যাদি বিভিন্ন নামে ভূষিত, সংজ্ঞায়িত ও চিহ্নিত হন৷ আসামে আশির দশকে বিদেশি বিতাড়নের নামে রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা হয় যার ফলে অসমের উগ্র জাতীয়তাবাদের কোপানলে প্রচুর হিন্দু ও মুসলমান বাঙালি নিহত হন৷

১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি ভারতের সংবিধান কার্যকরী হয়৷ ভারতের সংবিধানের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে ভারত একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্র৷ তবে ১৯৭২ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর আমলে সংবিধান সংশোধন করে প্রস্তাবনায় ‘সমাজতান্ত্রিক’ ও ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ শব্দদুটি যোগ করা হয়েছিল৷

ভারতের সংবিধানের দ্বিতীয় অধ্যায়ের ৫ -১১ অনুচ্ছেদে ভারতে নাগরিকত্ব কিভাবে অর্জিত হয়, সেটা বলা হয়েছে৷

অনুচ্ছেদ ৫: সংবিধানের সূচনার সময় নাগরিকত্ব:- ভারতীয় সংবিধানের সূচনাকালে প্রত্যেক ব্যক্তি যিনি ভারতে জন্মগ্রহণ করেছেন বা যাদের পিতামাতার মধ্যে একজন ভারতে জন্মগ্রহণ করেছেন বা যিনি সেসময় ভারতে কমপক্ষে পাঁচ বছর ধরে বাস করছেন, তিনি ভারতের নাগরিক হবেন৷

অনুচ্ছেদ ছয়: পাকিস্তান থেকে ভারতে চলে আসা কিছু ব্যক্তির নাগরিকত্বের অধিকার:- যদি কোন ব্যক্তি ১৯ জুলাই ১৯৪৮ সালের আগে পাকিস্তান থেকে ভারতে চলে আসেন, তবে তাঁকে ভারতীয় নাগরিক হিসেবে গণ্য করা হবে যদি সেই ব্যক্তির পিতামাতা বা ঠাকুরদা ঠাকুরমার মধ্যে একজন অবিভক্ত ভারতে জন্মগ্রহণ করেন৷ কিন্ত্ত ঐ তারিখের পর ভারতে প্রবেশ করলে নাগরিকত্ব লাভের জন্য ছয় মাস পর নিবন্ধীকৃত হতে হবে৷ অবিভক্ত ভারত বলতে বোঝায় ১৯৩৫ সালের ব্রিটিশের ‘ভারত শাসন আইন’ভুক্ত এলাকা৷

অনুচ্ছেদ সাত: পাকিস্তানের কিছু অভিবাসীর নাগরিকত্বের অধিকার:- ১ মার্চ ১৯৪৭-র পর পাকিস্তানে চলে গিয়েও যদি কেউ পুনর্বাসনের অনুমতি বা স্থায়ীভাবে ফিরে আসার অনুমতির অধীনে ভারতে ফিরে আসেন এবং ছয়মাস থাকার পর নিবন্ধীকৃত হন, তবে তিনি ভারতের নাগরিক৷

অনুচ্ছেদ আট: ভারতের বাইরে বসবাসকারী ভারতীয় বংশোদ্ভূত কিছু ব্যক্তির নাগরিকত্বের অধিকার:- কোনো ব্যক্তি বা তার পিতামাতা বা ঠাকুরদা ঠাকুরমার মধ্যে যদি কেউ ভারতে জন্মগ্রহণ করেছেন এবং যিনি ভারতের বাইরে যেকোনো দেশে বসবাস করছেন, তাকে ভারতের নাগরিক বলে গণ্য করা হবে৷
অনুচ্ছেদ নয়: স্বেচ্ছায় বিদেশী রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব অর্জনকারী ব্যক্তিরা নাগরিক হতে পারবে না কারণ ভারতের সংবিধান দ্বৈত নাগরিকত্বের অনুমোদন দেয় না৷

অনুচ্ছেদ দশ: নাগরিকত্বের অধিকারের ধারাবাহিকতা:- প্রত্যেক ব্যক্তি যিনি সংবিধানের নাগরিকত্ব সম্বন্ধীয় বিধানগুলো অনুযায়ী ভারতের নাগরিক হিসেবে মান্যতা পাবেন, সংসদ কর্তৃক প্রণীত যেকোনও আইনের বিধান সাপেক্ষেও তিনি নাগরিক থাকবেন৷

অনুচ্ছেদ এগারো: নাগরিকত্ব আইনে পরিবর্তন করার অধিকার সংসদের:- নাগরিকত্ব অধিগ্রহণ ও অবসান এবং নাগরিকত্ব সংক্রান্ত অন্য কোনো বিষয়ে আইন প্রণয়ণের অধিকার সংসদেরই আছে৷

১৯৫৫ এর নাগরিকত্ব আইন:-
স্বাধীন ভারতের প্রথম নাগরিকত্ব আইন সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সংসদে পেশ হয় এবং ৩০ ডিসেম্বর ১৯৫৫ সাল থেকে বলবৎ হয়৷ ১৯৫৫ সালের পর এই আইন সংসদে পাঁচবার সংশোধিত হয়েছে – ১৯৮৬, ২০০৩, ২০০৬, ২০১৫ ও ২০১৯৷

বিভিন্ন সময়ে সংশোধিত হওয়া ভারতের ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইন অনুযায়ী কি কি ভাবে ভারতে নাগরিকত্ব লাভ করা যায়, সেটা একটু দেখে নেওয়া যাক:

জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব:- জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব অর্জনের বিষয়টি আছে নাগরিকত্ব আইন ১৯৫৫-এর ৩-নং ধারায়৷ যে কোনও ব্যক্তি ২৬ জানুয়ারি ১৯৫০এবং ১ জুলাই ১৯৮৭ এর মধ্যে ভারতে জন্মগ্রহণ করলে তিনি জন্মসূত্রে ভারতীয় নাগরিক হবেন৷ ১ জুলাই ১৯৮৭ থেকে ৩ ডিসেম্বর ২০০৪-এর পূর্বে ভারতে জন্ম হলে এবং তাঁর মাতাপিতার যে কোনো একজন ভারতীয় হলে তিনি ভারতীয় নাগরিক হবেন৷ ৩ ডিসেম্বর ২০০৪ বা তার পরে ভারতে জন্ম হলে তিনি তখনই ভারতীয় নাগরিক হবেন যদি তাঁর মাতাপিতা উভয়েই ভারতীয় নাগরিক হন অথবা উভয়ের একজন ভারতীয় নাগরিক ও অন্যজন অবৈধ অনুপ্রবেশকারী না হন৷ ১৯৫৫-এর নাগরিকত্ব আইনের ৩-নং ধারায় শর্তবিহীন ভাবে জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব অর্জনের যে সুবিধা ছিল, তা ১৯৮৬ সালের সংশোধনীর ফলে বিলুপ্ত হয় এবং নতুন একটি শর্ত জডি়ত হয় যে জাতকের পিতামাতাকেও ভারতীয় নাগরিক হতে হবে৷ এই সংশোধনীটি গৃহীত হয় আসামে বিদেশি বিতাড়ন সংক্রান্ত লাগাতার আন্দোলনের জেরে ১৯৮৬-তে প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী ‘আসু’র (অল আসাম স্টুডেন্টস ইউনিয়ন) সঙ্গে ‘আসাম চুক্তি’ স্বাক্ষর করার পর৷ তার ফলে ভারতের কোনো ভূমিতে শুধু জন্মসূত্রে যে নাগরিকত্ব লাভের ‘জন্মগত অধিকার’ ছিল, তা খারিজ হয়ে যায় ও জন্মের সঙ্গে রক্তের সম্পর্কও বিবেচনায় আসে৷

উত্তরাধিকারসূত্রে নাগরিকত্ব:-
নাগরিকত্ব আইন ১৯৫৫-এর ৪ নং ধারায় ভারতের বাইরে জন্মানো ব্যক্তির নাগরিকত্ব সম্বন্ধে বলা আছে৷ ২৬ জানুয়ারি ১৯৫০ থেকে ১০ ডিসেম্বর ১৯৯২-এর মধ্যে ভারতের বাইরে জন্মানো কেউ ভারতের নাগরিক হবেন যদি জন্মের সময় তাঁর পিতামাতা ভারতীয় নাগরিক হন এবং ১০ ডিসেম্বর ১৯৯২-এর পর থেকে ভারতের বাইরে জন্মানো কেউ ভারতের নাগরিক হবেন যদি জন্মের সময় তাঁর মাতাপিতার কোনও একজন ভারতীয় নাগরিক হন৷ ৩ ডিসেম্বর ২০০৪-এর পর বিদেশে জন্মানো কাউকে ভারতীয় নাগরিকত্ব অর্জন করতে হলে জন্মের একবছরের মধ্যে বা ভারত সরকারের বিশেষ অনুমতিক্রমে একবছর পরে হলেও ভারতীয় কূটনৈতিক মিশনে আবেদন করতে হবে এবং সেইসাথে তাঁর মাতাপিতাকে অন্যদেশের পাসপোর্ট নেই বলে ঘোষণাপত্র জমা দিতে হবে৷

নিবন্ধীকরণের মাধ্যমে নাগরিকত্ব:-
নাগরিকত্ব আইনের ৫ নং ধারা অনুযায়ী নথিভুক্তিকরণের মাধ্যমে বৈধভাবে নাগরিকত্ব লাভ করা যায় নিম্নলিখিত উপায়ে:
১) ৫(১) (এ) ধারা অনুযায়ী ভারতীয় নাগরিক নয় এমন ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্যক্তি যদি অবৈধ অনুপ্রবেশকারী না হয়ে থাকে, তাহলে ভারতবর্ষে সাতবছর থাকার পর নথিভুক্তির মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে আবেদন করতে পারে৷ তবে আবেদনকারীকে আবেদনের ঠিক আগে অন্তত বারো মাস একটানা ভারতে থাকতে হবে৷
২) কোনও ব্যক্তি কোনও ভারতীয়কে বিয়ে করে ভারতে এসে সাত বছর বৈধভাবে বসবাসের পরও আবেদন করতে পারেন৷
৩) ভারতীয় নাগরিকের অপ্রাপ্তবয়স্ক পুত্রকন্যা বিদেশে জন্মালেও ভারতীয় নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারে৷
৪) বিদেশে থাকা পূর্ণবয়স্ক স্বাবলম্বী ব্যক্তির মাতাপিতার কেউ পূর্বে স্বাধীন ভারতের নাগরিক হয়ে থাকলে এবং সেই ব্যক্তি আবেদন করার একবছর আগে থেকে ভারতে বসবাস করলে নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারেন৷
৫) পূর্ণবয়স্ক স্বাবলম্বী ব্যক্তি ৫ বছর যাবৎ ওভারসিজ সিটিজেন অফ ইন্ডিয়া কার্ডহোল্ডার হলে এবং শেষ বারো মাস ভারতে থাকলে পূর্ণ নাগরিকত্ব লাভের জন্য আবেদন করতে পারেন৷

স্বাভাবিকরণের মাধ্যমে নাগরিকত্ব: নাগরিকত্ব আইনের ৬ নং ধারা অনুযায়ী স্বাভাবিকরণের মাধ্যমে ভারতের নাগরিকত্ব লাভ করা যায়৷ সেই ধারা অনুযায়ী কোনও বিদেশি ভারতে বারো বছর বসবাস করলে এবং যার মধ্যে আবেদন করার ঠিক আগে অন্ততঃ একবছর ভারতে থেকে থাকলে এবং আবেদন করার পূর্ববর্তী ১৪ বছরের মধ্যে ১১ বছর ভারতে বসবাস করে থাকলে এই স্বাভাবিকরণ পদ্ধতিতে নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারে৷

২০১৯ সালে কেন্দ্রীয় সরকার পাশ করিয়েছিল ‘সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট (সিএএ)’ বা নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন৷

নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন ২০১৯-এর প্রধান ধারাগুলো হল:
১) শরণার্থীদের জন্য স্বাভাবিকরণের যে মেয়াদ ১২ ও ১১ বছর ছিল, তা থেকে কমিয়ে যথাক্রমে ৬ ও ৫ বছর করা হয়েছে৷
২) অনুপ্রবেশ সংক্রান্ত আইন বহাল রাখলেও বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে উৎপীডি়ত বা উৎপীডি়ত হওয়ার আশঙ্কায় আগত হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পার্সি, খ্রিষ্টান শরণার্থীদের অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসেবে গণ্য করা হবে না৷
৩) নাগরিকত্ব আইন ১৯৫৫-এর ৫নং ধারা অনুযায়ী নিবন্ধীকরণ এবং ৬নং ধারা অনুযায়ী স্বাভাবিকরণ এই দুই পদ্ধতিতে নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারেন৷
৪) এই ধরনের অভিবাসীদের জন্য পাসপোর্ট আইন ও বিদেশী আইনেও ছাড় দেওয়া হয়েছে দু’টি নোটিফিকেশনের মাধ্যমে৷ শরণার্থীদের বিরুদ্ধে অনুপ্রবেশকারী মামলাও শিথিল হয়ে যাবে এই সংশোধনী আইন বলবৎ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে৷
৫) আসাম চুক্তি অনুযায়ী যেখানে ভারতবর্ষে আসার সর্বশেষ তারিখ স্থির হয়েছিল ১৯৭১-এর ২৩ মার্চ, সেখানে নতুন সংশোধনী আইনে ভারতে আগমনের ভিত্তিবর্ষ বাডি়য়ে করা হয়েছে ২০১৪-এর ৩১ ডিসেম্বর৷ ১৯৭১ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত যেসব মানুষ ধর্মীয় পরিচয়ের জন্য নিপীড়নের শিকার হয়ে প্রাণ বাঁচাতে এ দেশে আশ্রয় নিয়েছে, তাঁদের সবাইকে উপযুক্ত নিয়ম মেনে নাগরিকত্ব দেওয়া হবে৷
৬) ভারতের বা উত্তরপূর্ব ভারতের ষষ্ঠ তফসিলভুক্ত জায়গাগুলি এই আইনের বাইরে রাখা হয়েছে৷

গত ১১ মার্চ, ২০২৪ তারিখে
কেন্দ্রীয় সরকার ‘সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট ( সিএএ)’ বা ‘নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন’ কার্যকর করে নিয়মবিধি ঘোষণা করেছে৷ নাগরিকত্বের আবেদন জানানোর জন্য কেন্দ্রীয় সরকার একটি আলাদা পোর্টাল তৈরি করেছে৷ সেখানে জমা দিতে হবে কিছু নির্দিষ্ট নথি ও হলফনামা৷ প্রথম ভাগের (১এ)-এর জন্য নিম্নলিখিত ন’টি নথির মধ্যে একটি নথি জমা দিতে হবে আবেদনের সঙ্গে:

১) বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান সরকারের ইসু্য করা পাসপোর্টের কপি
২) ভারতের বিদেশি নিবন্ধন অফিসারের ইসু্য করা রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট বা রেসিডেনসিয়াল পারমিট
৩) বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান সরকারের ইসু্য করা বার্থ সার্টিফিকেট
৪) বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান-এর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একটি সার্টিফিকেট
৫) বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান সরকারের বা সরকারি এজেন্সির ইসু্য করা যে কোন ধরণের পরিচয়পত্র
৬) বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান সরকারের ইসু্য করা যে কোনও লাইসেন্স বা সার্টিফিকেট
৭) বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তানে জমি থাকার বা ভাড়া থাকার নথি
৮) মাতাপিতা, পিতামহ-পিতামহী, প্রপিতামহ-প্রপিতামহীদের সংশ্লিষ্ট দেশের নাগরিকত্বের প্রমাণপত্র
৯) বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান সরকারের বা সরকারি এজেন্সির ইসু্য করা এমন কোনও নথি যা আবেদনকারীদের সংশ্লিষ্ট দেশের নাগরিক হিসেবে চিহ্নিত করবে৷

দ্বিতীয় ভাগে (১বি) নথির মাধ্যমে প্রমাণ দাখিল করতে হবে যে তিনি কখন ভারতে প্রবেশ করেছেন৷ তার জন্য ২০টি নথির তালিকা দেওয়া হয়েছে৷ তারমধ্য থেকে যার জন্য যেটা প্রযোজ্য, সেগুলি আবেদনের সময় জমা দিতে হবে৷ নথিগুলোর সাথে আবেদনকারীর একটি হলফনামাও জমা দিতে হবে৷

এখন বিভিন্ন মহল থেকে প্রশ্ন উঠেছে যে কোনো আবেদনকারীর কাছে যদি একটিও নথি না থাকে, তাহলে কি হবে? উত্তরে বলা যায়, সরকার যদি নিপীডি়ত মানুষদের জন্য আন্তরিকভাবে নাগরিকত্বের ব্যবস্থা করতে চায়, তাহলে অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এইসব নথির বিকল্প হিসেবে অন্য কোনো পদ্ধতিও গ্রহণ করতে পারে ভবিষ্যতে৷ এদিকে ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ বলেছেন যাঁদের কোনো নথি নেই, তাঁদের বিষয়টি পরে বিবেচনা করে দেখা হবে৷ তাঁর মতে অত্যন্ত ৮৫ শতাংশ মানুষের কাছে কোনো না কোনো নথি থাকবে৷

এই সংশোধনীর মাধ্যমে প্রথম ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব প্রদানের কথা বলা হল৷ বাদ পডে়ছেন মুসলিমরা৷ তাই আইনটির ধর্মনিরপেক্ষতা ও সাংবিধানিক বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে৷ ভারতের সংবিধানের ১৪ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ভারতে বসবাসকারী কোনও ব্যক্তির আইনি সুরক্ষা ও আইনি সমানাধিকার রাষ্ট্র খর্ব করবে না৷ সংবিধানের ১৫ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ধর্ম-বর্ণ-জাতি-লিঙ্গ ও জন্মস্থান নিরপেক্ষ ভাবে ভারতের প্রতিটি নাগরিক আইনের চোখে সমান৷ তাই নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরুদ্ধে ভারতের বিভিন্ন জাতি ও ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ করার অভিযোগ উঠেছে৷ তবে সরকারের যুক্তি হল মুসলিমদের এই নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের আওতায় না রাখার কারণ পাকিস্তান আফগানিস্তান ও বাংলাদেশ এই তিনটি দেশই ইসলামি দেশ এবং সেখানে মুসলিমদের ধর্মীয় কারণে নিপীড়নের প্রশ্ন নেই৷

তবে সেই সূত্র ধরেই মায়ানমারের রোহিঙ্গা, পাকিস্তানের আহমদিয়া ও শ্রীলঙ্কার তামিলদের কথাও উঠে আসছে৷ তবে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক থেকে জানানো হয়েছে সিএএ-এর কারণে কোনও মুসলিমের ( বা অন্য ধর্মাবলম্বীদের) ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই৷ এই আইনের ফলে তাঁদের নাগরিকত্বে কোনও ধরণের প্রভাব পড়বে না৷ তবে প্রশ্ন থেকে যায় হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পার্শি ও খ্রিস্টান-এর মত মুসলিম যদি কেউ ১৯৭১ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে ভারতে এসে থাকেন, তাহলে তাদের নাগরিকত্বের ব্যাপারটা কি হবে? তাদেরকে কি নাগরিকত্ব দেওয়া হবে? যদি দেওয়া হয়, তা হলে নাগরিকত্ব আইনের কোন ধারায় দেওয়া হবে? ন্যাচারালাইজেশন বা স্বাভাবিকরণ ধারায়? না, অন্য কোন ধারা সৃষ্টি হবে সংশোধনীর মাধ্যমে? বাস্তব পরিস্থিতির বিচারে স্বাভাবিকভাবেই এইসব প্রশ্ন উঠে আসে যা কিনা আগামীদিনের চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিবে৷ আরেকটি টেকনিক্যাল প্রশ্ন ও আশঙ্কা দেখা দিয়েছে অনেকের মনে যে যারা নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করবেন তারা কি প্রথমতঃ বিদেশি হিসেবে গণ্য হবেন? আর যাদের আবেদন মঞ্জুর হবে না বা খারিজ হয়ে যাবে, তাদের পজিশন কি হবে? তাদের কি ভারতে থাকাকালীন অর্জিত সমস্ত সুবিধা বাতিল হয়ে যাবে? তাদের উপর কি অবৈধ অনুপ্রবেশকারী, বিদেশি হিসেবে কোন অ্যাকশন নেওয়া হবে? এইসব আশঙ্কা ঘোরপাক খাচ্ছে জনমানসে৷ তাই জনগণকে আশ্বস্ত করার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারকে অতি অবশ্যই এবং অতিসত্ত্বর স্বচ্ছ ও স্পষ্টভাবে একটি স্পষ্টীকরণ দেওয়ার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয়৷ তবে এই সংশোধনী আইন অনুযায়ী ধর্মীয় নিপীড়নের কারণে বা সেই আশঙ্কায় যারা ভারতে চলে এসেছেন, তাঁদের অবৈধ অনুপ্রবেশকারীর তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হবে৷ তবে ধর্মীয় নিপীড়নের প্রমাণ দিতে গেলেই অনেকের সমস্যা হতে পারে৷ তাছাড়া অনেকেই সেল্ফ ডিক্লেয়ারেশনের ভিত্তিতে নিঃশর্ত নাগরিকত্ব প্রদানের দাবি তুলছেন৷

এদিকে পশ্চিমবঙ্গে মতুয়ারা বিভক্ত হয়ে গেছেন নাগরিকত্ব আইন কার্যকারীর বিজ্ঞপ্তি জারি হওয়ার পর৷ একদিকে কেন্দ্রীয় জাহাজ মন্ত্রী শান্তনু ঠাকুরের নেতৃত্বে ডঙ্কা, কাঁসর বাজিয়ে গাইঘাটার ঠাকুর বাডি়তে হয় কীর্তন ও আবীর খেলা, অন্যদিকে তৃণমূল দলের রাজ্যসভার সাংসদ মমতাবালা ঠাকুর ও অন্যান্য তৃণমূল দল প্রভাবিত মতুয়ারা বলেন, ‘আমাদের তো আধার কার্ড, রেশন কার্ড সহ এ দেশের নাগরিক হিসেবে যা যা থাকা প্রয়োজন, তার সবটাই আছে৷ কেন্দ্রের যদি এতই দরদ হয়, তাহলে রাজ্যের প্রতিটি ব্লক ধরে ধরে সিটিজেনশিপ কার্ড দিক৷ কেন নাগরিকত্বের জন্য নতুন করে অনলাইনে আবেদন করতে হবে আমাদের?‘এদিকে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন পশ্চিমবঙ্গে সিএএ, এনআরসি বা ডিটেনশন ক্যাম্প হতে দেবেন না৷ এদিকে আসামে এনআরসি থেকে ১৯ লক্ষ আসামে বসবাসকারী মানুষের নাম বাদ পডে়ছিল যার মধ্যে প্রায় ১২ লক্ষ হিন্দু বাঙালি ছিল বলে খবরে প্রকাশ৷ আসামে অনেকেই যাঁরা ডাউটফুল ভোটার বা যাঁদের কাছে বিভিন্ন কারণে নথিপত্র নেই, তাঁরা ডিটেনশন ক্যাম্পে আছেন৷ অনেকে মারা গেছেন এবং আত্মহত্যাও করেছেন৷ আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী কোন একসময় অসমের শিলচরে গিয়ে একবার বলেছিলেন যে অসমের ডিটেনশন ক্যাম্প সব গুঁডি়য়ে ফেলা হবে, কিন্ত্ত এখনও অসমে ডিটেনশন ক্যাম্প বহাল তবিয়তে আছে৷

অসমের শিলচরে ফোরাম ফর সোশ্যাল হারমনি, নাগরিক অধিকার সুরক্ষা সমন্বয় সমিতি (সিআরপিসিসি) ও আরো কয়েকটি সংগঠনের তরফ থেকে জানানো হয়েছে যে অসমের এনআরসি প্রক্রিয়ার দাবি-আপত্তি পর্যায়ে অসমের রাজ্য সরকার আধার কর্তৃপক্ষের সহযোগিতায় মোট ২৭ লক্ষ লোকের বায়োমেট্রিক তথ্য সংগ্রহ করে এবং তাদের বঞ্চিত করে আধার প্রদান করা আটকে রেখেছে৷ ৫ বছর ধরে আধার আটকে থাকা লোকজন নানা সমস্যা ও হেনস্থার সম্মুখীন হয়েছেন৷ বিভিন্ন ধরনের সরকারি সুযোগ সুবিধা লাভ থেকে তারা বঞ্চিত৷

চারবছর আগে সংসদে সংশোধিত আইন বা সিএএ পাশ হওয়ার পর ব্যাপক অশান্তি ছডি়য়েছিল অসমে৷
সেখানে অসমীয়া অনেকই আশঙ্কা করেছিলেন এবং এখনও করছেন ‘সিএএ’ কার্যকর হলে হিন্দু শরণার্থীদের ব্যাপক ভিড় বৃদ্ধি পাবে অসম সহ উত্তরপূর্ব ভারতের রাজ্যগুলিতে যার ফলে ভাষাগত ও সংস্কৃতিগত সমস্যা প্রকট হতে পারে৷ অসমের রাইজর দলনেতা অখিল গগৈ বলেন, ‘ সিএএ অসমীয়া সম্প্রদায়ের উপর কেন্দ্রের আক্রমণ ছাড়া আর কিছুই নয়৷ বিজেপি ও

আরএসএস অসমিয়া সম্প্রদায়কে প্রান্তিক করতে সিএএ ব্যবহার করছে৷ ‘ সিএএ প্রত্যাহারের দাবিতে অসমের ১৬টি দলের যৌথমঞ্চ ‘ইউনাইটেড অপজিশন ফোরাম অসম’ ১২ মার্চ, ২০২৪ সর্বাত্মক হরতালের ডাক দিয়েছিল৷ তাতে সাড়া দিয়ে শিবসাগর, গোলাঘাট, নগাঁও ও কামরূপ জেলায় দোকান ও অন্যান্য বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়৷ কংগ্রেস দলের তরফে বিধানসভার বিরোধী দলনেতা দেবব্রত শইকিয়ার নেতৃত্বে গুয়াহাটিতে আইনের কপি পুডি়য়ে প্রতিবাদ জানানো হয়৷ অল অসম স্টুডেন্টস ইউনিয়ন (আসু) ও ৩০টি অরাজনৈতিক জনজাতি সংগঠনের তরফে মশাল মিছিলের আয়োজন করা হয়৷

১৩ মার্চ থেকে তারা সত্যাগ্রহ শুরু করবেন বলে জানিয়েছে৷ আসু এই আইনের বিরুদ্ধে সুপ্রীমকোর্টের শরণাপন্ন হয়েছে৷ অসমের মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, অসমে এনআরসি হয়ে গেছে, তাই সংশোধনী আইনের কোনো প্রাসঙ্গিকতা নেই অসমে৷ ‘এনআরসি’র সব তথ্য লক করে রাখা হয়েছে৷ নতুন করে
একজনও এতে ঢোকানোর সুযোগ নেই৷ মুখ্যমন্ত্রী কি বলতে চাইছেন ঠিক বোঝা যাচ্ছে না কারণ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী তো বলেছেন ‘সিএএ’-এর ‘ সঙ্গে এনআরসি’-এর কোনো সম্পর্ক নেই৷

বর্তমান উদ্ভূত পরিস্থিতিতে অসমে এনআরসি থেকে বাদ পড়া লক্ষ লক্ষ হিন্দু বাঙালি ‘সিএএ’-এর ফলে কি ভারতের নাগরিকত্ব পাবেন? সেটা এখন লাখ টাকার প্রশ্ন হয়ে নিশ্চুপ হয়ে চারিদিকে ঘুরছে, প্রকাশ্যে সশব্দে কেউ কোনো কথা বলছেন না৷ মনেহয় ভুক্তভোগীর স্বার্থের চেয়ে রাজনীতি হচ্ছে বেশি, সবাই যেন জল মাপছে! এদিকে দেশব্যাপী সিএএ-এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, আন্দোলনের জেরে উদ্বিগ্ন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন ‘দয়া করে বাংলাদেশ থেকে আসা হিন্দুদের সঙ্গে অবিচার করবেননা৷ হাতজোড় করে বলছি, এ নিয়ে রাজনীতি করবেননা৷ ‘বিজেপি শাসিত অসম রাজ্যে নিপীডি়ত হিন্দু শরণার্থীরা কি পাবে বহুকাঙ্কিত নাগরিকত্বের স্বাদ? কেন্দ্রীয় সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক কি পারবে সেটা নিশ্চিত করতে, ডিটেনশন ক্যাম্প ও লাগাতার হুমকিসঞ্জাত ও আশঙ্কার পরিমন্ডলের বাইরে গিয়ে একটি নিশ্চিন্ত সুখী জীবনযাপন? এইসব প্রশ্নগুলোর উত্তর ভবিষ্যতের গর্ভেই লুকিয়ে আছে৷ আর এখন আসন্ন লোকসভা নির্বাচন নিয়ে সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়বে৷ ‘সিএএ’ নিয়ে ভোটের বাজার গরম হবে৷ শাসক দল, বিরোধী দল ও বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠনের অভিমত, যুক্তি, পাল্টা যুক্তিতে পশ্চিমবঙ্গ ও অসমের অভিবাসীরা হয়ত বিভ্রান্ত হবেন, তবে মানবতার চরম ও পরম মুক্তির দিশা না যেন হয় সুদূর পরাহত৷ এই মুহূর্তে এইটুকুই কামনা ও আশা৷