সৈয়দ হাসমত জালাল
গত শুক্রবার, ১০ অক্টোবর বিকেলে ঢাকায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় প্রয়াত হয়েছেন কথাসাহিত্যিক-চিত্রসমালোচক-শিক্ষাবিদ সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। এক সপ্তাহ আগে হঠাৎই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন তিনি। চিকিৎসার কোনও ত্রুটি না থাকলেও শেষ পর্যন্ত তাঁকে আর জীবনে ফেরানো গেল না।
Advertisement
২০১৪-১৫ সালে বেশ কয়েকবার আমি ঢাকা গিয়েছিলাম কয়েকটি সেমিনারে অংশ নিতে। তখনই সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের সঙ্গে আমার পরিচয়। যখনই তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছে, অত্যন্ত স্মিত হেসে এগিয়ে এসেছেন তিনি। একজন বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক, নামকরা চিত্রসমালোচক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের নামকরা অধ্যাপক মনজুরুল ইসলামের ব্যবহারে কোনও অহঙ্কারের ছাপ দেখিনি কখনও।
Advertisement
কয়েক বছর আগে পশ্চিমবঙ্গের আসানসোলে কাজী নজরুল ইউনিভার্সিটি আয়োজিত দু’দিনব্যাপী কাজী নজরুল ইসলামের জীবন ও সৃষ্টি বিষয়ক সেমিনারে অংশ নিতে তিনি এসেছিলেন। সেই সঙ্গে ঢাকা থেকে এসেছিলেন অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম, ময়মনসিংহের জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মোহীত উল আলম এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক গোলাম মোস্তফা। ওই সেমিনারে আমন্ত্রিত বক্তা হিসেবে অংশ নিয়েছিলাম আমিও।
প্রথম দিনের সেমিনারের তৃতীয় পর্বে ছিল আমাদের আলোচনা। সেই পর্বটি ছিল মধ্যাহ্নভোজের পর। এই পর্বে অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম আলোচনা করলেন কাজী নজরুল ইসলামের উপন্যাস নিয়ে। আমার আলোচনার বিষয় ছিল নজরুলের ছোটগল্প। এই পর্বে আমরা দু’জন ছিলাম বক্তা। আর সভামুখ্য হিসেবে ছিলেন অধ্যাপক সুমিতা চক্রবর্তী। খুব ভালো লেগেছিল মনজুরুল ইসলামের বিশ্লেষণ। প্রায় সারাদিনের সেমিনার। অন্যান্য সময়ে আমরা সবাই শ্রোতার আসনে বসে শুনছিলাম আলোচনা। শুরু থেকেই লক্ষ্য করছিলাম, মনজুরুল ইসলাম একটি খাতায় একটানা কিছু লিখে যাচ্ছিলেন। আমাদের পর্ব শেষ হওয়ার পরেও তাঁকে দেখছিলাম লিখে যেতে। সেদিন সন্ধ্যায় হোটেলে একসঙ্গে বহুক্ষণ আড্ডা হল মনজুরুল ইসলাম ও মোহীত উল আলমের সঙ্গে। আড্ডার ফাঁকে তাঁর ওই লেখা প্রসঙ্গে তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। তিনি হেসে বলছিলেন, ফিরে গিয়েই একটি উপন্যাস জমা দিতে হবে। কিন্তু সময় পাচ্ছিলাম না বলে এভাবেই শেষ করতে হচ্ছে। আমি তো বিস্মিত! রাতের খাবারের আগে এতটা সময় আমরা যে আড্ডা দিচ্ছি, সে সময়টা তো তিনি তাঁর লেখার জন্য দিতে পারতেন। কিন্তু তা না করে আমাদের সঙ্গে এতটা সময় কাটাচ্ছেন এবং তাঁকে যে লিখতে হবে, তা আদৌ আমাদের বুঝতে দিচ্ছেন না। এরপর খাবার টেবিলে দেখা হল অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম ও তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে। সেখানে খাবার ফাঁকে ফাঁকে চলল বেশ কিছুক্ষণ কথাবার্তা, আলাপ-আলোচনা। তখনও মনজুরুল ইসলামের কোনও তাড়া আছে বলে মনেই হল না। আসলে নিজেকে জাহির না করে তাঁর এরকম সহজ ও আন্তরিক ব্যবহার মানুষ হিসেবেও তাঁকে খুব জনপ্রিয় করেছিল। তিনি পেয়েছিলেন মানুষের বিপুল শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম সম্পর্কে কয়েকটি তথ্য এখানকার পাঠকদের জন্য দেওয়া প্রয়োজন। ১৯৫১ সালে তাঁর জন্ম বাংলাদেশের সিলেট শহরে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাশ করেন ১৯৭১ ও ১৯৭২ সালে। তাঁর পিএইচডি-র বিষয় ছিল ‘ইয়েটসের কবিতায় ইমানুয়েল সুইডেনবার্গের দর্শনের প্রভাব’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন প্রায় ৪০ বছর। সেখান থেকে অবসর নেওয়ার পর তিনি অধ্যাপনা করছিলেন ‘ইউনিভার্সিটি অফ লিবারাল আর্টস, বাংলাদেশ’ (ইউল্যাব)-এ। নন্দনতত্ত্ব বিষয়ে ছিল তাঁর বিশেষ আগ্রহ। পোস্ট-কলোনিয়ালিজম, পোস্ট-মর্ডানিজম, পোস্ট-স্ট্রাকচারালিজম ইত্যাদি বিষয়ে তাঁর লেখা প্রবন্ধগুলি বোদ্ধামহলে বিশেষ সমাদৃত হয়েছিল।
তাঁর প্রথম গল্প প্রকাশিত হয় ১৯৭৩ সালে। কিন্তু এরপর এক দশকেরও বেশি সময় তিনি আর সাহিত্য রচনা করেননি। আশির দশকের শেষ দিকে আবার ফিরে আসেন লেখায়। পরে নব্বই দশকে তাঁকে কথাসাহিত্যিক হিসেবে নতুন করে আবিষ্কার করে পাঠকমহল। ১৯৯৪ সালে প্রকাশিত তাঁর ‘স্বনির্বাচিত শ্রেষ্ঠ গল্প’ এবং ১৯৯৫ সালে ‘থাকা না থাকার গল্প’ প্রকাশিত হয়। আর পরের বছরই তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার পান তাঁর ‘নন্দনতত্ত্ব’ প্রবন্ধগ্রন্থের জন্য। প্রচলিত গল্পধারার বাইরে বেরিয়ে এক ভিন্ন শৈলীতে লেখা তাঁর গল্পগুলি। সত্তর দশকের মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতা, সামরিক শাসনের দুঃসহ পরিস্থিতি, দারিদ্র্য ও বেকার সমস্যা, নারী নির্যাতন, সন্ত্রাস, স্বপ্নভঙ্গের বেদনা এইসব বাস্তবতার প্রতিফলন রয়েছে তাঁর সৃষ্ট সাহিত্যে। ম্যাজিক রিয়্যালিজম বা জাদুবাস্তবতাকে তিনি ব্যবহার করেছেন চমৎকারভাবে। তাঁর লেখার মধ্যে কঠিন বাস্তবতাকে তিনি অত্যন্ত সাবলীলভাবে তুলে এনেছেন। জাদুবাস্তবতা এবং নিষ্ঠুর বাস্তবতাকে নিপুণভাবে ব্যবহার করেছেন তিনি।
চিত্রসমালোচক হিসেবেও তিনি খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। বিভিন্ন সাহিত্যপত্রিকা এবং সংবাদপত্রে চিত্রকলা বিষয়ক তাঁর বহু লেখা প্রকাশিত হয়েছে। বিভিন্ন আর্ট গ্যালারি বা চিত্রকলা প্রদর্শনীতে তিনি নিয়মিত উপস্থিত থাকতেন। ‘কালি ও কলম’ পত্রিকায় তাঁর শিল্পবিষয়ক লেখাগুলিও তাঁর শিল্পবোধের নিদর্শন।
তাঁর উপন্যাসগুলির মধ্যে ‘আধখানা মানুষ’, ‘দিনরাত্রিগুলি’, ‘তিন পর্বের জীবন’, ‘কানাগলির মানুষেরা’ যথেষ্ট সমাদৃত। ২০১৮ সালে পেয়েছিলেন ‘একুশে পদক’। ইমেরিটাস অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ছাত্রছাত্রীদের কাছে বিপুল জনপ্রিয় হয়েও শুধুমাত্র শিক্ষাজগতের মধ্যেই নিজেকে আবদ্ধ রাখেননি। তাঁর সৃষ্ট কথাসাহিত্য বাংলা সাহিত্যের সম্পদ হয়ে থাকবে। এর বাইরেও মনে থাকবে তাঁর মানুষকে ভালোবাসার কথা।
Advertisement



