• facebook
  • twitter
Thursday, 31 July, 2025

কবি নজরুলের ছাত্রজীবন

শিক্ষক সতীশ কাঞ্জিলাল ছিলেন গুণী মানুষ ও সঙ্গীতজ্ঞ। তাঁর সাহচর্যে নজরুলের সুপ্ত সংগীত প্রতিভা নিজস্ব নিয়মে বেড়ে ওঠার পথ খুঁজে নেয়।

ফাইল চিত্র

বিশ্বনাথ পাল

মাত্র বাইশ বছর বয়সে বিদ্রোহী কবিতা লিখে খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছন কাজী নজরুল ইসলাম। অন্যায়, অবিচার আর অত্যাচারের বিরুদ্ধে খাপখোলা তলোয়ার নজরুল জন্মেছিলেন অবিভক্ত বর্ধমান জেলায় জামুড়িয়া ব্লকের চুরুলিয়া গ্রামে, দরিদ্র এক পরিবারে, ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ২৪ মে, বঙ্গাব্দ ১৩০৬, ১১ জ্যৈষ্ঠ। আট ভাই-বোনের মধ্যে নজরুল ছিলেন ষষ্ঠ। তবে আটজনের মধ্যে তিন ভাই ও এক বোন বেঁচেছিলেন, বাকিরা শৈশবে মারা যায়। ১৯০৮ সালে তিনি যখন নিতান্তই ৯ বছরের বালক, তখন বাবা ফকির আহমেদের মৃত্যু হয়। ফকির আহমেদ মসজিদে ইমামতি করতেন, আর মাজারে খাদেম ছিলেন। মোক্তবের পড়ুয়া নজরুল কোরান ও ধর্ম শিক্ষার পর তড়িঘড়ি ওই কাজে যুক্ত হলেন।

ছোটবেলার ডাকনাম ছিল দুখু মিঞা। কাকা বদ্‌লে করিমের লেটোর দলে পেটের টানে অল্প বয়সে যোগ দেন। শিশুশিল্পীর ডাগর চোখে সমাজবীক্ষণের দৃষ্টি ক্রমশ ফুটছে বলেই ওইটুকু একটা শিশু নিজেই গান লিখে আসর মাতিয়ে দেন। এরপর ১৯১১ সালে তিনি রানিগঞ্জে সিহাড়শোল রাজ উচ্চবিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হন। কিন্তু পেট বড় বালাই। পেটের টানে কাজ নিলেন রুটির দোকানে, পড়াশোনায় ইতি। কিন্তু এই সময় সহৃদয় দারোগা রফিজ উল্লাহর সুনজরে পড়ে আবার স্বপ্ন দেখা শুরু হয়। দারোগা তাঁকে বাংলাদেশে ময়মনসিংহের দরিরামপুরে নিয়ে যান। বিনাপয়সায় দরিরামপুর উচ্চবিদ্যালয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি ভাইয়ের বাড়িতে খাওয়ার ব্যবস্থা করেন। সেখান থেকে পূর্ব বর্ধমানের মাথরুন ইস্কুলেও ভর্তি হন, যা পরবর্তীতে সময়ে নবীনচন্দ্র ইনস্টিটিউশন হয়। সেখানকার প্রধান শিক্ষক পল্লীকবি কুমুদরঞ্জন মল্লিকের কলমে সুন্দর ছবি ধরা পড়ে— ‘ছোট সুন্দর চনমনে ছেলেটি। আমি ক্লাস পরিদর্শন করিতে গেলে সে আগেই প্রণাম করিত। আমি হাসিয়া তাকে আদর করিতাম। সে বড় লাজুক ছিল।’

মাকে ছেড়ে, জন্মভূমি মাটিকে ছেড়ে থাকতে মন চাইত না নজরুলের। তাই শিকড়ের সন্ধানে আবার ফেরা। মাথরুনে সপ্তম শ্রেণিতে বাৎসরিক পরীক্ষায় প্রথম হওয়ার সংবাদ তাঁর জানা ছিল না, তাই ১৯১৫, রানিগঞ্জের রাজাদের টালির চালের পেল্লাই সেই সিহাড়শোল রাজ উচ্চ বিদ্যালয়েই সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হলেন। ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত বিদ্যাসাগর মশাইয়ের চরণধূলিধন্য— এই বিদ্যালয় আক্ষরিক অর্থে কবির দ্বিতীয় জননী। পড়াশোনায় বেশ ভাল নজরুল। অঙ্কের মাথাটিও বেশ। বন্ধুরা খেপায়, হাঁড়ির মত মাথাতেই যত বুদ্ধি! বর্ধমান নিউ স্কুলে কিছুদিন নজরুল ছাত্র হয়ে প্রধান শিক্ষকের নজরে পড়েন। ছাত্রাভাবে এই স্কুলটি বন্ধ হলে প্রধানশিক্ষক সিহাড়শোল রাজাদের উচ্চ বিদ্যালয়ে বদলি হলেন। খবর পেয়ে নজরুলও তাই সিহাড়শোল রাজ উচ্চ বিদ্যালয়ে দ্বিতীয়বার ভর্তি হলেন। বার্ষিক পরীক্ষায় খুব ভাল ফল করায় ডাবল প্রমোশন পেয়ে নবম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হলেন। দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন নজরুল। এই সময় প্রধান শিক্ষক নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় নজরুলের বিনা বেতনে পড়ার সুযোগ শুধু নয়, মহমেডান বোর্ডিংয়ে থাকার ব্যবস্থা করে ছিলেন। তার চেয়ে বড় কথা, তিনি রাজবাড়ির বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে নজরুলের জলপানির ব্যবস্থাও করেছিলেন। জলপানি তথা ছাত্রবৃত্তির এই পরিমাণ, বর্তমান লেখকের ওই বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার সুবাদে নিজের চোখে বিদ্যালয় পরিচালন সমিতির ঝরনা কলমে লেখা রেজলিউশন দেখে শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়েছিল।

নজরুল মাসে ৫টি টাকা পেতেন। আর অধুনালুপ্ত মুসলিম ছাত্রাবাসের প্রধান ফটক সকালে খোলা আর রাতে বন্ধ করার জন্য মাসে আরো ২টি টাকা—সব মিলিয়ে ৭ টাকা পেতেন। ওই টাকাতে খাওয়া পরা এবং পড়াশোনার খরচ করেও উদ্বৃত্ত টাকা চুরুলিয়ায় মাকে পাঠাতেন। আজকের ছোট্ট বন্ধুরা শুনলে অবাক হবে, প্রধান শিক্ষক মহাশয়ের সেই সময় বেতন ছিল ১২ টাকা।
মাটির বাড়ি আর খড়ের চালের মহমেডান বোর্ডিংয়ের সেই বাড়িতে নজরুল থাকতেন। সস্তা খাটের ওপর বইপত্র ছড়ানো। এখানে থাকার সময় গান গাইতেন বন্ধুদের আবদারে, তবলা বাজাতেন, আবার সাঁতার কাটতেন। এখানেই উড়তে না শেখা একটি চড়ুই পাখির ছানা কড়িকাঠের বাসা থেকে পড়ে যায়। মা-পাখিটির কাতর ডাকে নজরুল একটি মই জোগাড় করে ছানাটিকে মায়ের বাসায় তুলে দেন। আর মা-পাখিটির মনোবাসনা পূর্ণ হওয়ায় নজরুল এ বিষয়ে খুশি হয়ে একটি কবিতা লেখেন। নজরুলের এই কবিতাটিই তাঁর ছাত্রজীবনের সেরা কবিতা। তার প্রথম দুটি লাইন এরকম—
‘‘মস্ত বড় দালান-বাড়ির উই-লাগা ঐ কড়ির ফাঁকে
ছোট্ট একটি চড়াই-ছানা কেঁদে কেঁদে ডাক্‌ছে মা’কে।’’

শিক্ষক সতীশ কাঞ্জিলাল ছিলেন গুণী মানুষ ও সঙ্গীতজ্ঞ। তাঁর সাহচর্যে নজরুলের সুপ্ত সংগীত প্রতিভা নিজস্ব নিয়মে বেড়ে ওঠার পথ খুঁজে নেয়। নজরুল তাঁর বাসায় গিয়ে হারমোনিয়াম নিয়ে প্রায় গলা সাধতেন। সঙ্গীতের ব্যাকরণ মেনে প্রথামাফিক প্রথম তালিম তিনি এই শিক্ষক মশাইয়ের কাছ থেকে পান। নজরুলের মধ্যে যে একজন সঙ্গীত বিশেষজ্ঞ লুকিয়ে আছে তা সন্ধান পেয়ে কাঞ্জিলালবাবুই প্রথম তাঁকে সাদরে বরণ করে মনের মাধুরী দিয়ে তাঁর অর্জিত সঙ্গীত বিদ্যা উজাড় করে দেন। তাই তো আমরা রাগপ্রধান গানের বাইরে বাঙলা গানের দুটি ধারায় গঙ্গা ও যমুনার মতো রবীন্দ্র সংগীত ও নজরুলগীতিকে পাই। নিবারণচন্দ্র ঘটক ছিলেন স্বদেশি দলের কর্মী এবং সমাজসেবক। তিনি এই বিদ্যালয়ের নামজাদা শিক্ষক ছিলেন। কাজী নজরুলের মধ্যে স্বদেশপ্রেমের বীজ তিনিই বপন করেন। বাংলার অগ্নিযুগের আর একজন ঋত্বিক, কলকাতায় তাঁর নামে আজও জ্বলজ্বল করছে বিপিনবিহারী গাঙ্গুলি স্ট্রিট, সেই বিপিনবিহারী গাঙ্গুলি রণেন সেন ছদ্মনামে এই বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন। নজরুল পরবর্তী জীবনে দেশের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন— দেশপ্রেমিক এইসব শিক্ষকদের প্রত্যক্ষ সংস্পর্শে এসে। আর একজন শিক্ষক হাফিজ নূরনবী সাহেব ছিলেন উর্দু ভাষার পণ্ডিত ও সাহিত্যিক, নজরুলের অসীম আগ্রহ দেখে এই শিক্ষক নজরুলকে ফার্সি ভাষা শিক্ষা দেন, যার উজ্জ্বল প্রভাব সমগ্র নজরুল সাহিত্যে যুক্ত হয়ে আছে।

এই বিদ্যালয়ের ছাত্র হয়ে তিনি লাভ করেন তাঁর অভিন্ন হৃদয়ের বন্ধু সাহিত্যিক শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়কে। তিনি অবশ্য পড়তেন স্টেশন সংলগ্ন রানিগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ে। দু’জনের মনের মিল ছিল খুব, নজরুল ছিলেন পিতৃহীন, শৈলজানন্দ মাতৃহীন। সে সময় নজরুল স্বপ্ন দেখতেন কথাকার হওয়ার, আর শৈলজানন্দ হতে চেয়েছিলেন কবি। পরবর্তী কালে দু’জনেরই অভিমুখ বদলে যায় কালের নিয়মে। গাদা বন্দুক নিয়ে পাখি মারার বদলে পেঁপে গাছে তাক করে ইংরেজ তাড়ানোর প্র্যাকটিস করতেন‌ নজরুল।

দুই বন্ধুতে মিলে কখনো গল্প করতে করতে শ্মশানের দিকে যেতেন। আবার কখনো বা যেতেন বড়দৈ নামের বড় দিঘির পাশে। মনের সুখে সাহিত্য, ধর্ম, সংস্কৃতি, সমাজ ও দেশের স্বাধীনতা বিষয়ে আলোচনা হতো। এখানেই তিনি ‘রাজার গড়’ ও ‘রাণীর গড়’ নামে দুটি কবিতা লেখেন। দু’জন শিক্ষক মহাশয়ের বিদায় সম্বর্ধনা উপলক্ষে দুটি স্বরচিত কবিতা তিনি পাঠও করেছিলেন।
১৯১৭ সাল, ছাত্রজীবনের গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা ম্যাট্রিকুলেশন। দশম শ্রেণির ছাত্র নজরুলের ক্ষেত্রে যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনই মেধাবী ছাত্র নজরুলকে নিয়েও শিক্ষকদের মধ্যে অদম্য উৎসাহ যথেষ্ট দানা বেঁধেছে। এমন অবস্থায় একদিন দেখা গেল একটি ট্রেন এসে থেমেছে রানিগঞ্জ স্টেশনে, আঠারো বছরের নজরুল সঙ্গে বন্ধু শৈলজানন্দ কৌতুহলবশত সেখানে গিয়ে দেখেন তাঁদের বয়সী ছেলেদের ভিড়। কৌতুহলবশত দু’জনেই সৈনিক পদে নাম লেখালেন। শারীরিক পরীক্ষায় বাদ পড়লেন শৈলজানন্দ, কিন্তু রেলে চড়ে বসলেন অকুতোভয় নজরুল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের জন্য বৃটিশ সৈন্যবাহিনীতে যোগ দিলেন। ফলে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাঙ্গনে নজরুলের ছাত্রজীবন এখানেই শেষ হয়।