সুস্মিতা মুখার্জী চট্টোপাধ্যায়
আজ আমরা এক ঘোর অন্ধকার সময়ের মধ্য দিয়ে চলেছি। সংকীর্ণ রাজনৈতিক শক্তির আগ্রাসনে দেশের বুকে গণতন্ত্র, মানবতা, সাম্য, মৈত্রী, সম্প্রীতি, বাকস্বাধীনতা, মানবাধিকার, শুভবুদ্ধি, সত্যানুশীলন— সমস্ত কিছুই আজ বিপন্ন। বিচারের বাণী আজ নিরবে নিভৃতে কাঁদছে। তাই চারিদিকে চলছে নতুন নতুন সংগ্রাম। এই বিপন্ন সময় আমাদের একমাত্র আশ্রয় রবীন্দ্রনাথ।
Advertisement
লোকোত্তর প্রজ্ঞা ও প্রতিভাধর কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর বিশাল ব্যাপ্ত জীবনে সহস্রধারে সৃষ্টি করে গেছেন বিস্ময়কর বহুমুখী দিক। কিন্তু তার মধ্যে তাঁর সংগীতই তাঁর সর্বোত্তম অবদান। কবিগুরু রচিত দ্বিসহস্রাধিক গানের রত্নভান্ডারে দেশাত্মবোধক গানের সংখ্যা অত্যল্প হলেও সে সব গানের স্বতন্ত্র গুরুত্ব ও প্রাসঙ্গিকতা, স্বকীয়তা অসামান্য। বর্তমান সময়ে তাঁর স্বদেশ পর্যায়ের গানগুলি হোক আমাদের পথ চলার প্রেরণা, পথের দিশারী।
Advertisement
প্রত্যক্ষভাবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কখনো স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণ না করলেও পরোক্ষভাবে তিনি তাঁর গান, লেখা, কবিতার মাধ্যমেই লড়াই চালিয়েছিলেন দেশের জন্য। এই প্রবন্ধে আমি তাঁর কিশোরকাল থেকে জীবনের শেষ পর্ব পর্যন্ত সময়কালে তাঁর স্বদেশপ্রেম, চেতনা ও জনকল্যাণাকাঙ্ক্ষা কীভাবে ফুটে উঠেছে তাই দেখার চেষ্টা করেছি। দেশ, জাতি, সমাজ ও সময়ের সঙ্গে আজ তাই আবর্তিত রবীন্দ্রপ্রতিভা।
বালক রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন মাত্র ছয়। কর্মক্ষেত্রে, সাহিত্যক্ষেত্রে, সমাজকল্যাণের ক্ষেত্রে পরিবর্তনের তখন তুমুল হাওয়া। রবীন্দ্রনাথের পরিবারেও প্রবহমান সেই স্বাদেশিকতার ভাব। জন্মজাত প্রতিভাধর কিশোর তখন থেকেই আহরণ করলেন স্বাদেশিকতার শক্তি। উত্তরোত্তর বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে গভীর সাহিত্য সাধনা, সঙ্গীত চর্চা এবং কর্মসংগঠনেও তৎপর হলেন তিনি। চিন্তায় ও কাজে সমকালীন মনীষীদের সমকক্ষ হয়ে উঠলেন। অনেকের থেকে বেশী ভূয়োদর্শী, সংস্কারমুক্ত, বাস্তববাদী, তেজস্বী ও কর্মনিষ্ঠ।
চতুর্দশবর্ষীয় বালক ‘হিন্দুমেলার উপহার’, ‘প্রকৃতির খেদ’ ইত্যাদি রচনায় দেশপ্রীতি ও পরাধীনতার গ্লানি ব্যক্ত করলেন বিদ্বজ্জন সভায়। পনেরো ষোলো বছর বয়স থেকে হেমচন্দ্রের ভারতসঙ্গীত, সত্যেন্দ্রনাথের ‘মিলে সবে ভারত সন্তান’ ও অন্যান্যদের স্বদেশী গানের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে নিজেও স্বদেশী গান রচনা শুরু করলেন। জাতীয় মান-সম্মান ও মনুষ্যত্ববোধ, আত্মশক্তির জাগরণ ও সঠিক জনশিক্ষা ও গ্রামোন্নয়ন, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ইত্যাদি সার্বিক বিষয়ে অভ্রান্ত লেখনী চালনা করেছেন তিনি।
রবীন্দ্রজীবনের নির্ধারিত তিন পর্বের দেশভাবনাদ্যোতক গানগুলির কালানুক্রমিক পরিচিতি উপস্থাপন করলে দেখা যায়, হিন্দুমেলা ও সঞ্জীবনী সভা প্রভৃতির দ্বারা সৃষ্ট স্বদেশচেতনা বালক রবীন্দ্রনাথকে কবিতা রচনায় উদ্বুদ্ধ করে। এরপর ১৮৮৫ পর্যন্ত কবির ২৩ বছর বয়সের মধ্যে রচিত নানা বিষয়ের গানের সংখ্যা দেখি প্রায় ৩০৭ । কিন্তু দেশাত্মবোধের গান মাত্র ৯টি।
১৮৮৫ থেকে ১৮৯৭ পর্যন্ত দীর্ঘ বারো বছর তিনি শিলাইদহ কুষ্টিয়া পদ্মাতীরস্থ বৃহৎ জনপদের কৃষক শ্রমিক আউল বাউল হিন্দু মুসলমান প্রভৃতি দীনদুঃখী লোকায়ত জনগোষ্ঠীর সান্নিধ্য পেয়েছিলেন। বিশাল মিছিলের পুরোভাগে নেতা ও চারণ গায়ক রূপে কন্ঠে কন্ঠ মিলিয়ে গাইলেন তাঁরই অন্তর্প্লাবী স্বদেশী গান। যুগান্তকারী সৃষ্টি সেই স্বদেশি গানগুলি আজও জাতির সার্বিক বোধের মন্ত্রোচ্চারণ।
স্বদেশব্রতে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন নির্ভীক প্রতিবাদী। দেশবাসী, দেশনেতাদের যেমন ভ্রান্তি, সংকীর্ণতা, অপরাধ ইত্যাদি ধরিয়ে দিয়েছেন অসঙ্কোচে, তেমনি প্রতিবাদ ও ধিক্কার উচ্চারণ করেছেন ব্রিটিশ সরকারের দমন, পীড়ন, সন্ত্রাস, হিংস্রতার বিরুদ্ধে। আমৃত্যু খাঁটি দেশপ্রেমিকের কর্তব্য করেছেন কখনও প্রত্যক্ষভাবে কখনো পরোক্ষে। প্রাক-যৌবন পর্ব থেকে যৌবন পর্বে কবি থেকে মহাকবিতে তাঁর উত্তরণ খুবই বিস্ময়কর। দেশের চরম সংকটকালে দেশের সেবায় যৌবনদীপ্ত রবীন্দ্রনাথের ভূমিকা বিস্ময়কর। কল্পনাবিলাসী উচ্চ মিনারের কবিকে ধূলিমাটির বিপন্ন দেশভূমিতে নেমে আসতে হয়েছে বারংবার।
রবীন্দ্রনাথের স্বদেশভাবনার মূল সুরটি হল মানবতাবোধ। সংকীর্ণ দেশ কাল পাত্রের অনেক ঊর্ধ্বে উঠে এর সুর ছিল বাঁধা। তিনি দেশকে ভালোবাসতেন। রবীন্দ্রগানে দেশাত্মবোধ ও স্বাদেশিকতার যে পরিচয় পাওয়া যায় তা গভীর ব্যাপক এবং বিশ্বমৈত্রীর নামান্তর। তিনি বলেছেন, ‘দেশকে ভালো না বাসলে তাকে ভালো করে জানার ধৈর্য থাকে না। তাকে না জানলে তার ভালো করতে চাইলেও ভালো করা যায় না’।
রবীন্দ্রনাথের স্বদেশ ও জাতীয় ভাবনার অখণ্ড ধারাবাহিকতা সুস্পষ্ট হলেও তাঁর স্বদেশ-গৌরবী গান সৃষ্টির ধারাবাহিকতা ছিল না। ব্রহ্মসঙ্গীত ও কাব্যসঙ্গীতে তাঁর অব্যাহত গতি। কিন্তু দেশ- গৌরবী সঙ্গীত প্রায়শই উপলক্ষ চালিত। বঙ্গভঙ্গ পর্বে কবির স্বদেশি গানের সমৃদ্ধতম সময়। এই সময়ে রচিত স্বদেশি গানের সংখ্যাও বেশি, বৈশিষ্ট্যে ও স্বকীয়তায় প্রোজ্জ্বল।
১৯০৫ সালের বঙ্গচ্ছেদ প্রতিরোধ আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা অনন্যসাধারণ। আমজনতার কাছে কবি, গায়ক ও নেতারূপে তিনি সুসম্পন্ন করলেন তাঁর অভিনব চারণ ধর্ম। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের কালে তাঁর স্বদেশ প্রেমের স্ফূরণ দেখা দেয়। তিনি আসমুদ্রহিমাচল বৃটিশ বিরোধিতা ছড়িয়ে দিয়েছেন। সেসময় স্বদেশ প্রেমের গানগুলো দেশপ্রেমিকদের কণ্ঠে কন্ঠে ধ্বনিত হয়েছে। যেমন— ‘এবার তোর মরা গাঙে বান এসেছে’, ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে’, ‘আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে’।
রবীন্দ্রনাথ বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের সময় রচনা করেন স্বদেশবন্দনা। সেগুলোর অন্যতম ‘আমার সোনার বাংলা’, ‘ও আমার দেশের মাটি’, ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’, ‘সার্থক জনম আমার’ ইত্যাদি।
প্রবল দেশপ্রেমের আবেগ থেকেই কবি সেদিন এমন দু-একটা টপ্পাঙ্গের গান গেয়েছিলেন, যা আজও আমাদের স্নায়ুতন্ত্রে আলোড়ন তুলতে পারে। এই আলোড়নের জোরেই এক দিন ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীতের মর্যাদা লাভ করেছে। আর পাশাপাশি আর একবার অসম্ভব জনপ্রিয় হয়েছিল এই অসাধারণ গানটি—
‘সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে
সার্থক জনম, মা গো, তোমায় ভালোবেসে।’
যে কোনো আন্দোলনে আশাবাদ জাগিয়ে রাখতে হয়। সংগ্রাম চলতে চলতে শুরুর দিকে অনেক ব্যর্থতা আসে, পরাজয় আসে। তার থেকে আসে হতাশা, নিরুদ্যম। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের নানা পর্বেও এই আশাবাদের সঞ্চারের লক্ষ্যে তিনি যে স্বদেশী গীতগুলি রচনা করেছিলেন, আমাদের বর্তমান শ্রমিক কৃষকের আন্দোলনের আঁকেবাঁকে যখন নৈরাশ্য দেখা দেয় তখনও সেই সব গান গাওয়া যেতে পারে—
‘ওরে, নূতন যুগের ভোরে
দিস নে সময় কাটিয়ে বৃথা সময় বিচার করে।’
কবি যখন সংগ্রামের প্রান্তরে আহ্বান জানান, তখন এই ভাষাতেই আগামী দিনের আবেদনকে তুলে ধরেন এক অনবদ্য দৃপ্ততায়—
‘নাই নাই ভয়, হবে হবে জয়, খুলে যাবে এই দ্বার’
জানি জানি তোর বন্ধনডোর ছিঁড়ে যাবে বারে বার।’
অশান্ত সমুদ্রে নৌকা নিয়ে দুঃসাহসিক পাড়ি দেবার রূপক এঁকে গণসংগ্রামের আবেদন সৃষ্টির সেই যে সূত্রপাত হয়েছিল কবিগুরুর গানে, তা আমাদের কালে এসেও অব্যাহত থেকেছে—
‘খরবায়ু বয় বেগে, চারি দিক ছায় মেঘে,
ওগো নেয়ে, নাওখানি বাইয়ো।’
সাম্প্রদায়িক ঐক্য রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক ভাবনায় বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছিল বলে তিনি সেই ঐক্য বাস্তবায়িত করতে চেয়েছিলেন জাতীয় জীবনের নানা খাতে। তিনি আজীবন ধর্মীয় উন্মাদনার বিরোধিতা করে এসেছেন। যে ধর্ম মানুষে মানুষে ঘৃণার বীজ রোপণ করে, যে ধর্ম সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে সংঘাত প্রতিঘাতের বাতাবরণ সৃষ্টি করে, যে ধর্ম আমাদের সামাজিক ঐক্যকে খণ্ড বিখণ্ড করে, রবীন্দ্রনাথ বরাবর সেই ধর্মের বিরোধিতা করে এসেছেন। তাঁর এই দর্শন অখণ্ড মানবতাবাদের নিদর্শন।
উচ্চাঙ্গ রাগরাগিণীর সুর ও ভাবদ্যোতনায়, এমনকি গায়কীর সৌকর্যে সুগীতজ্ঞ রবীন্দ্রনাথ অন্যান্য গানগুলিকেও অসাধারণত্ব দিয়েছেন। ‘এ ভারত রাখো নিত্য প্রভু’, হাম্বির একতালে ‘জননী দ্বারে আজি ওই’, ভৈরবী রূপক তাল ‘কে এসে যায় ফিরে ফিরে’, স্বদেশাত্মক গানগুলি অবশ্যই সাধারণ গায়কদের পক্ষে রপ্ত করা সহজ ছিল না। এই গুচ্ছের শেষ গানটি স্বদেশী গান নয়। ১৯০৪ সালে বরোদারাজ গাইকোয়াড়ের অভ্যর্থনা উপলক্ষে রচিত। গানটি পর পর রূপান্তরিত হয়েছে নানা উপলক্ষে। শান্তিনিকেতনে ইতালীয় পণ্ডিত কার্লো ফরমিকিকে অভ্যর্থনায় গানটি দাঁড়ালো, ‘শান্তিমন্দির পুণ্য অঙ্গন হোক সুমঙ্গল আজ হে’ ইত্যাদি। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকে রবীন্দ্রনাথের প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক জীবনের ক্রান্তিকাল হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। স্বদেশী গান রচনারও সর্বশ্রেষ্ঠ স্বর্ণসময় এটি। বঙ্গ অঙ্গচ্ছেদের গভীর ষড়যন্ত্রের সময় থেকেই বাংলা দেশব্যাপী গণআন্দোলন দানা বাঁধে।
স্বদেশী আন্দোলনের (১৯০৫) সময়কে মধ্য পর্ব ধরলে পূর্ববর্তী ও পরবর্তী দুটি প্রায় সমান সমান পর্বের সময় ভাগ সুস্পষ্ট। কালানুক্রমিকভাবে ৪৪ বছর বয়সের পূর্বে কিশোর কাল থেকে ৪৩ বছর বয়স পর্যন্ত এবং ৪৫ বছর বয়স থেকে শেষ স্বদেশি গান লেখা পর্যন্ত মোট তিনটি পর্বে তাঁর স্বদেশি গানের সংখ্যা যথাক্রমে ২৩, ২৫, ১৬ অর্থাৎ মোট ৬৪। রবীন্দ্র জীবনীকার মনীষী প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের নির্ণীত ও প্রাপ্ত মোট গানের সংখ্যা ২২৩২— গীতবিতান তিন খণ্ডে সংকলিত। এই সুবিশাল সংখ্যার মধ্যে দেশ ও জাতীয়ভাবোদ্দীপক গানের সংখ্যা নিতান্তই অল্প।
কবির নির্ধারিত ‘স্বদেশ’ পর্যায়ের গানের সংখ্যা ৪৬টি। স্বদেশী যুগের অধিকাংশ গানসহ আগের ও পরের কিছু গান নিয়েই গীতবিতানের স্বদেশ গান। কবির তিরোধানের পর গীতবিতানের তৃতীয় খণ্ডে জাতীয় সঙ্গীত শিরোনামে কবির বর্জিত ১৬টি গান সংকলিত। তাহলে গীতবিতানের স্বদেশি গানের সংখ্যা হল মোট ৬২ টি।
‘তোমারি তরে মা সঁপিনু এ দেহ’— (সঞ্জীবনীসভার জন্য রচিত বলে অনুমান) গানটি সম্ভবত প্রথম স্বদেশভাবনার সার্থক রচনা এবং যথেষ্ট সমাদৃত। সঙ্গীত কল্পতরু গ্রন্থে সংকলিত গান— ‘তোমারি তরে মা’, ‘ভেতরে তোর’।
এই গানগুলির ৮টিতে রাগরাগিণী ও তাদের প্রয়োগ আছে। ভাব ও ভাষানির্মিতিতে কিছুটা সমকালীন প্রখ্যাত হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় সত্যেন্দ্রনাথ, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ প্রমুখের গানের ভাব ভাষার অনুসৃতি আছে। এরপর রচিত স্বদেশী গানের বাণী, ভাব ও সুরের সমন্বয়ে বৈচিত্র্য ও স্বকীয়তায় সুস্পষ্ট। স্বদেশ গৌরবী উদ্দীপনা ও প্রেরণার গান হিসেবে এগুলি আরো হৃদয়স্পর্শী। ‘একবার তোরা মা বলে ডাক’, ‘কেন চেয়ে আছ গো মা’, ‘তবু পারিনা সঁপিতে প্রাণ’, ‘আনন্দ ধ্বনি জাগাও গগনে’ …গানগুলি উল্লেখযোগ্য। গানগুলিতে গীতিকার ও সুরকার রবীন্দ্রনাথের স্বাতন্ত্র্যের চিহ্ন সুস্পষ্ট । রাগরাগিণীর সুরের মধ্য থেকে লোকসঙ্গীত বাউল কীর্তনের সুরের অন্তর্গুঞ্জরণে অনুরণিত। ‘একবার তোরা মা বলিয়া ডাক’, ‘আমরা মিলেছি আজ’— বাউল কীর্তন রামপ্রসাদীর লোকায়ত সুরের অনুষঙ্গে স্বদেশি যুগের জনচিত্তকে উদ্বেলিত করে।
এইসময় রবীন্দ্রনাথ ‘বন্দেমাতরম’ গানে দেশ রাগের সুর যোজনা করে বঙ্কিমচন্দ্রকে শুনিয়েছিলেন (১৮৮৬); পরে কংগ্রেস অধিবেশনেও গান করেন। ১৩০০ থেকে ১৩১১ পর্যন্ত বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের পূর্বে একগুচ্ছ অসাধারণ স্বদেশ গৌরবী গান নতুন করে লেখা হয়। যেমন— ‘অয়ি ভুবনমোহিনী’, ‘কে এসে যায় ফিরে ফিরে’, ‘আজি এ ভারত লজ্জিত হে’, ‘হে ভারত আজি তোমারি সভায়’, ‘বঙ্গ জননী মন্দিরাঙ্গন মঙ্গলোজ্জ্বল’।
বঙ্গভঙ্গ পূর্ব পর্যন্ত কবির ৪৩ বছর বয়স অবধি রচিত গানের সংখ্যা যেখানে ৭৪১, সেখানে এ পর্যন্ত স্বদেশাত্মবোধের গান ২৩/২৪। ১৯০০ সালে সরলাদেবীর শতগান (স্বরলিপি) বইতে রবীন্দ্রনাথের ৫টি স্বদেশী গান ‘জাতীয়সঙ্গীত’ অংশে স্থান পেয়েছে। ১৯০৩ সালে মোহিতচন্দ্র সেন সম্পাদিত কাব্যগ্রন্থাবলীর গান (৪৪২) অংশে রবীন্দ্রনাথের ৯টি স্বদেশী গান আছে। ১৯০৪ সালে ‘রবীন্দ্র-গ্রন্থাবলী’ হিতবাদী সংস্করণে ‘গানের বহি’ (১৮৯৩)-এর স্বদেশী গানগুলোই মুদ্রিত।
বঙ্গ বিচ্ছেদ ঘোষণা (১৬ অক্টোবর ১৯০৫)-র পূর্ববর্তী বৎসর গুলিতে দেশব্যাপী স্বাদেশিকতার ভাববিপ্লব সৃষ্টিতে জাতীয় কংগ্রেস ও অন্যান্য সংগঠনের বিরাট ভূমিকা ছিল। ১৮৯৯ সালে ভারতে লর্ড কার্জন বড়লাট হয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে ব্রিটিশ দমন পীড়ন ও সাম্প্রদায়িক শত্রুতা সৃষ্টির ষড়যন্ত্র শুরু হয়ে যায়। সারা দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়তে থাকে। সাহিত্য সঙ্গীত সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বলিষ্ঠ গদ্য রচনা ও ভাষণের দ্বারা জাতীয় আন্দোলনে সামিল হন। প্রাচ্য জাতির প্রতি কার্জনের নিন্দার্হ ভাষণের দৃপ্ত প্রত্যুত্তর দেন( ১৯০২)। ছাত্রদের প্রতি তাঁর বাণী— ‘অতিমাত্রায় স্বদেশাচারের অনুগত হওয়া ভালো, তথাপি মুগ্ধভাবে বিদেশীর অনুকরণ করিয়া নিজেকে কৃতার্থ মনে করা কিছু নহে’। ১৯০৩ থেকে ষড়যন্ত্রী কার্জন হিন্দু মুসলমান বিভাজনের পরিকল্পনা শুরু করায় কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দ বিভিন্নভাবে দেশবাসীর ধূমায়িত ক্রোধকে উদ্দীপ্ত করতে থাকেন। রবীন্দ্রনাথও গদ্যে-ভাষণে-পদ্যে-গানে স্বদেশ প্রেমের চেতনা সমৃদ্ধ করলেন। উল্লেখিত স্বদেশী রবীন্দ্রসঙ্গীতগুলি পূর্ববর্তী রচনাগুলি অপেক্ষা অধিকতর তাৎপর্যবহ ও গুরুত্বপূর্ণ। ভাষায় ও সুরে গানগুলির স্বকীয়তা ফুটে উঠেছে।
১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর বঙ্গচ্ছেদ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই সারা বাংলা প্রতিবাদে উত্তাল হয়। বাংলার এই প্রত্যক্ষ প্রবল জাতীয় বিপ্লব সারা ভারতবর্ষকেও পরিপূর্ণ সংগ্রামী চেতনায় ও বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডে উদ্বুদ্ধ করে। রবীন্দ্রনাথ, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী ও জাতীয় নেতৃবৃন্দ স্বদেশী আন্দোলনকে প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্রীয় গণ আন্দোলনের পর্যায়ে গতিশীল করে তুললেন। ওই দিন রাখীবন্ধন উৎসব ও ক্রন্দন ব্রত পালিত হয়। সকালে ও সন্ধ্যায় বিশাল গণমিছিল ও সভানুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। বন্দেমাতরম ধ্বনি এবং রবীন্দ্রনাথের স্বদেশী গানের ব্যাপক প্রভাবে সমগ্র জাতি স্বাধীনতা চেতনায় ও আত্মোপলব্ধির মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়। প্রতিবাদে উদ্বুদ্ধ রবীন্দ্রনাথের তখন আর এক গগনচুম্বী রূপ। লেখায়, ভাষণে, নেতৃত্বে সঙ্গীতে তিনি একাই একশো। অসাধারণ স্বদেশী গণসঙ্গীতের সুরে সুরে মাতিয়ে দিলেন দেশকে। আমজনতার মিছিলের পুরোভাগে নেমে এসে দেশহিতব্রতী কবি বাউল সুসম্পন্ন করলেন যথার্থভাবেই তাঁর চারণ ধর্ম। সকলের সঙ্গে কন্ঠ মিলিয়ে উদাত্ত সুরে গাইলেন—
‘বাঙালীর প্রাণ, বাঙালীর মন,বাঙালীর ঘরে যত ভাইবোন,/ এক হউক এক হউক এক হউক হে ভগবান’।
কবির বয়স তখন ৪৪ বৎসর, গিরিডিতে তিনি অবস্থান করছেন। পদ্মাতীরের আউল বাউল কীর্তনীয়াদের মেঠো সুরকে অবলম্বন করেই সহজ সরল বাণীর হৃদয়স্পর্শী গান লিখলেন আন্দোলন সূচনার প্রাক্কালেই। এই সময়ের তাঁর উল্লেখযোগ্য গানগুলি হল— ‘এবার তোর মরা গাঙে বান এসেছে’, ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে’, ‘আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি’, ‘ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা’… ইত্যাদি। সমকালীন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ও গীতসংকলনেও বাউল ও রাখী সঙ্গীতগুলি বার বার সংকলিত হয়ে ব্যাপক প্রচার পায়। গণ আন্দোলনের কালে গানগুলি কন্ঠে কন্ঠে গীত হয়েছে। বাউল ও রাখী সঙ্গীতগুলিতে সহজীয়া লোকায়ত সঙ্গীত বাউল কীর্তন সারি প্রভৃতির সুর। সহজ সুরের দ্বারা লোক সাধারণের মর্মমূলে নাড়া দিয়ে স্বদেশপ্রীতির আবেগ সৃষ্টি করা সহজ হবে— একথা রবীন্দ্রনাথ বুঝতে পারেন।
স্বদেশী আন্দোলনের বিরাট সাফল্যের পেছনে ছিল দেশাত্মবোধের চরম ও প্রবল উৎসাহ এবং কর্মশক্তির প্রবল প্রয়োগ— সুসংযত ও সুপরিকল্পিত নেতৃত্ব। রবীন্দ্রনাথের ৪৮ বছর বয়সের পর যে যে দেশাত্মবোধক গানগুলো পাই তার মধ্যে কয়েকটি হল— ‘হে মোর চিত্ত পুণ্য তীর্থে জাগো রে ধীরে’, ‘জনগণ মন অধিনায়ক জয় হে’, ‘নাই নাই ভয় হবে হবে জয়’, ‘সঙ্কোচের বিহ্বলতা নিজেরে অপমান’, ‘ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলে’, ‘ওরে নূতন যুগের ভোরে’।
দেশ ও বিশ্ব ভাবনার সঙ্গে ভারত জননীর মহিমা-কীর্তন ও ভারতবর্ষকে মহামিলনের তীর্থক্ষেত্র রূপে ভাবনা গানগুলিতে সুস্পষ্ট। কবিগুরুর পঞ্চাশ বছর বয়সের রচনা ‘জনগণ মন অধিনায়ক জয় হে’ বর্তমানে স্বাধীন ভারতের জাতীয় সঙ্গীত। স্বাধীন বাংলাদেশ কবিগুরুর ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটিকে রাষ্ট্রীয় সঙ্গীত হিসাবে গ্রহণ করেছে। একজন কবির দুটি গান দুই স্বাধীন দেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে স্বীকৃত হওয়ার দৃষ্টান্ত বিরল।
‘ভারততীর্থ’ কবিতার গীতরূপে ‘হে মোর চিত্ত পুণ্যতীর্থে’ গানে সর্বমানবের মিলন তীর্থ হিসেবে ভারত ভূমির বন্দনা এবং দেশ ভাবনা যে বিশ্ব ভাবনায় উন্নীত– তা ব্যক্ত হয়েছে। দেশপ্রেমিক শহিদের প্রতি কবির সহমর্মিতা কত গভীর ছিল তা এই গানগুলি প্রমাণ করে। ‘ওরে নূতন যুগের ভোরে’ গানটিকে কবিগুরুর দেশ ভাবনার শেষ গান ধরা যায়।
সাম্প্রদায়িক ঐক্য রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক ভাবনায় বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছিল বলে তিনি সেই ঐক্য বাস্তবায়িত করতে চেয়েছিলেন জাতীয় জীবনের নানা খাতে। চেষ্টাও কম করেননি তাঁর লেখা ও কাজে। তিনি আজীবন ধর্মীয় উন্মাদনার বিরোধিতা করে এসেছেন। যে ধর্ম মানুষে মানুষে ঘৃণার বীজ রোপন করে, যে ধর্ম সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে সংঘাত প্রতিঘাতের বাতাবরণ সৃষ্টি করে, যে ধর্ম আমাদের সামাজিক ঐক্যকে খণ্ড বিখণ্ড করে, রবীন্দ্রনাথ বরাবর সেই ধর্মের বিরোধিতা করে এসেছেন। তাঁর এই দর্শন অখণ্ড মানবতাবাদের নিদর্শন।
রবীন্দ্রনাথ স্বদেশকে ক্ষুদ্র ভূখণ্ডের মধ্যে আবদ্ধ না রেখে বিশ্বচেতনায় তাকে দেখেছেন। তিনি সবদিক থেকে দেশকে পরিপূর্ণ দেখতে চেয়েছিলেন। তিনি বলেছেন, দেশ মাটিতে তৈরি নয়, দেশ মানুষের সৃষ্টি। দেশ মৃন্ময় নয়, চিন্ময়। মানুষ যদি প্রকাশমান হয়, তবেই দেশ প্রকাশিত। তাই দেশের প্রতি প্রেম হল মানুষের বিকাশ, পড়াশোনার মধ্য দিয়ে মানুষের ভাবনা চিন্তার উত্তরণ, শিক্ষা গবেষণা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান, খাওয়া পরা এবং পরিবহন যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন। কবিগুরুর স্বদেশ চেতনা ছিল বিশ্ব মানব চেতনা ও উদার ধর্ম চেতনার সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত। স্বদেশীী যুগে কবি বলেছেন, ‘স্বদেশের মধ্যে ভগবানের একটি বিশেষ আবির্ভাব উপলব্ধি করা ও স্বদেশের হিতসাধক ভগবানের সেবার একটি বিশেষ অঙ্গ বলিয়া গণ্য করাকে যদি আমরা ধর্ম বলিয়া স্বীকার করিতে আরম্ভ করিয়া থাকি, তবে সেই ধর্ম দেশের আবালবৃদ্ধবনিতার মধ্যে প্রচার করিবার স্বদেশি উপায়কে আমরা যেন উপেক্ষা না করি।’
এই অন্তর্লীন নিখুঁত স্বদেশপ্রীতি সুদীর্ঘ উত্তর জীবনের নানা অভিঘাতে মুক্ত বিশ্ব মানবপ্রীতিতে রূপান্তর লাভ করেছে। সেদিনের বিশ্বপথিকের যুদ্ধবিরোধী ও উৎকট ‘ন্যাশনালিজম’ বিরোধী ভূমিকা ও তাঁর কর্মতৎপরতা তাঁকে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ শান্তির দূত হিসেবে প্রতিপন্ন করে। তিনি এক আশ্চর্য মানবতাবাদী যাঁর পক্ষে বলা সম্ভব, মানুষকে মানুষ বলে দেখতে না পারার মত সর্বনেশে অন্ধতা আর নেই। এই বন্ধন এই অন্ধতা নিয়ে কোনও মুক্তিই আমরা পাব না। জীবনের শেষ নববর্ষে শেষ অভিভাষণে ‘সভ্যতার সঙ্কট’-এ বিশ্বমানুষের সংকট-মুক্তি এবং স্বদেশের প্রত্যাবর্তন স্বাধীনতার ভবিষ্যদ্বাণী করে যান ত্রিকালদর্শী ঋষির মত।
উদার ও মহৎ চিত্তে বিশ্বমানবতা বোধ জাগরূক ছিল। তাই তাঁর নিকট শুধু দেশবাসী নয়, গোটা বিশ্ববাসীর প্রতি ছিল অকৃত্রিম ভালোবাসা ও অপরিসীম দরদভরা প্রাণের আকুতি। তাই স্বদেশ, বিদেশ, আপন পরের সংকীর্ণ গন্ডী অতিক্রম করে গোটা বিশ্বকেই আপন ভেবে তাঁর নিজের ঘর খুঁজে বেড়িয়েছেন—
‘সব ঠাঁই মোর ঘর আছে/ আমি সেই ঘর মরি খুঁজিয়া।’ আর এখানেই তাঁর স্বদেশভাবনার মূল সুরটি আমরা খুঁজে পাই।
Advertisement



