• facebook
  • twitter
Friday, 7 November, 2025

গুরুদেব

খোলা জানালার বিপরীতে অধীর বসলো। আলোচনা শুরু হলো। মাঝপথেই মন হারিয়ে গেলো অধীরের। এতো কথা গল্পের মধ্যেও তার অস্বস্তি হচ্ছে। অধীর বুঝতে পারছে, গ্রামটা বোধহয় থাকবে না।

কল্পিত চিত্র

তন্ময় কবিরাজ


‘দীক্ষা হলো?’ ঘর থেকে বেরোতেই অধীর প্রশ্ন করলো। ‘যা হোক করে দিলাম।’ সুকুমার বললো। বাপের দীক্ষা আগেই হয়েছিল। বউটা নাকি আগেই কোনও একটা আশ্রমে দীক্ষা নিয়েছিল। ছেলেটা আর বউটাকে দীক্ষা দিলাম।’
‘বউটা রাজি হলো?’ জানতে চাইলো অধীর।

‘প্রথমে রাজি ছিল না। কিন্তু কিন্তু করছিল। পরে চন্দন বললো। আমিও বোঝালাম। যাই হোক কাজটা হয়েছে। তবে ছেলেটাকে জোর করতে হয়েছে অনেক।’ বললো সুকুমার।
কৌতূহলী অধীর আবার প্রশ্ন করলো, ‘ওরা পালন করবে তো?’

সুকুমার একটু উত্তেজিত হয়ে পড়ল। ‘দেখ, আমার দীক্ষা দেওয়া কাজ, আমি করেছি। কে পালন করবে, কে পালনের করবে না সেটা তার ব্যাপার। এভাবে কি দীক্ষা হয়? লোকের কাছে ছোটো হওয়া।’ পাঞ্জাবির পকেট থেকে রুমালটা বার করে ঘাম মুছল সুকুমার। ‘আমার আর দুটো দীক্ষা বাকি আছে, তাহলেই কোটা শেষ। গুরুদেবকে বিল মিটিয়ে বুঝিয়ে দেবো। এবার গুরুদেব আর চন্দন বুঝবে। এতো ঝামেলা আর ভালো লাগে না।’

‘তোমার আর দুটো বাকি আছে। আমি এখনও একটা পার্টিও পেলাম না।’ চিন্তিত অধীর।
‘আগে বলতে পারতিস। তাহলে চন্দনের বউয়ের দীক্ষাটা আমি দিতাম আর তুই ছেলেটাকে করে দিতিস। আগে যে কেন না বলিস তুই? বেশ মোড়লদের চারজন আছে তুই নিয়ে নিস। আমার তো দুটো বাকি। যাহোক করে ম্যানেজ করে নেব।’ সমাধান বাতলে দিলেন সুকুমার।

‘বেশ তাই হবে।’ ঘাড় নাড়ল অধীর। ‘চাপ নিচ্ছি না। যদি জোগাড় হয় তো ভালো নাহলে গুরুদেবকে বলে দেব।’
‘গুরুদেব সব জানে। গুরুদেব তো সেদিন আমাকেও বললো, ‘এতো দিন চাপ ছিল না। এখন ধর্মের মধ্যেও প্রতিযোগিতা বাড়ছে। অনেক নতুন নতুন বাবা-মা এসে গেছে। সবাই নিজেদের এজেন্ট বাড়াতে চাইছে। তবে আমাদের সুবিধা হলো শাসক দল আমাদের পাশে আছে। নেতারা বলেছে বেশি বেশি করে দীক্ষা দিয়ে দলে লোক টানতে হবে, ফান্ড বাড়াতে হবে। গুরুদেব যেভাবে খাটছে তাতে মার্কেটিং খুব ভালো হচ্ছে। গুরুদেব এবার ভোটে টিকিট পাবে।’ বললো সুকুমার।
‘গুরুদেব মন্ত্রী হলে তোমার একটা পদ পাক্কা?’ অধীর বেশ আগ্রহী।

‘এখনি আমাদের পদ দেবে না। সবাই একসঙ্গে পদ পেলে লোকের চোখে লাগবে। তাই গুরুদেব বললো, পার্টি অফিসের পাশে একটা মন্দির হবে। আমরাই ওখানে বসবো। অফিস থাকবে। তখন আর বাড়ি বাড়ি ঘুরে দীক্ষা দিতে হবে না। অনলাইন করে দেবো। মন্দির থাকলে সবাই আসবে। সব তো পার্টি অফিস থেকেই হবে। মাসে দু-তিনটিও যদি হয় খারাপ কী!’
‘আইডিয়াটা খারাপ নয়।’ অধীর বললো। ‘আস্তে আস্তে বাড়বে।’ সুকুমারের দিকে তাকাল। ‘আমাদেরকেই তো চালাতে হবে।’

‘তুই এত তাড়াতাড়ি করিস না। আমি গুরুদেবকে আগে থেকেই বলে রেখেছি। আর অফিস হলে তোকেই তো চালাতে হবে। আমাকে হয়তো বাইরে দায়িত্ব দেবে। শোন অধীর, কোনো কাজ শুরু করতে হলে প্রথমে সমস্যা হয়। একটু অপেক্ষা কর।’ সুকুমার আশাবাদী।

‘তবে পড়াশোনা করা লোকেরা আমাদের পাত্তা দেয় না। হারাধনকে বলতে গেলাম, রেগে তেড়ে এলো। বললো, ঢপবাজি অন্য জায়গায় করবি।’ চিন্তায় অধীর।

‘শিক্ষিত লোকেরা বসন্তের কোকিল। সুবিধা পেলেই উড়ে যাবে। ওদের কাছে যাস না। পারলে ওদের ভয় দেখিয়ে ভাগাতে হবে।’ অধীরকে বললো সুকুমার।
‘কিন্তু তাড়াব কীকরে?’ প্রশ্ন অধীরের।

‘দলের পার্টি অফিসটা কীকরে তৈরি হলো? দেবুরা পার্টি অফিস করতে দেবে না। দেবুর বাবা তো বাড়ি বাড়ি গিয়ে মানুষকে বলে এসেছিল। আমরা পার্টি অফিস করলে নাকি গ্রামের শান্তি নষ্ট হবে? জেলার কোনো এক নেতা দলবল নিয়ে এসে ওর বাড়ি ফাঁকা করে দলের পতাকা পুঁতে দিল।’
‘পুলিশ কিছু বলেনি?’
‘পুলিশ উকিল সব সেটিং করা ছিল।’
‘তোমাকে এত সব কে বললো?’ হালকা হাসলো অধীর।
‘গুরুদেব বললো। গুরুদেবের সঙ্গে রাত পর্যন্ত আড্ডা চলে। জেলার নেতারাও আসে। এখন তো রাতেই গুরুদেব বেশি ব্যস্ত।’

সুকুমার অধীর একই গ্রামের ছেলে। বিয়ে করেনি। বাবাদের সামান্য জমি আছে। চাকরির চেষ্টা করেছিল। হয়নি। এখন বয়সও পেরিয়ে গেছে। জমির উপর ভরসা করেই পরিবার চলে। অধীরের পরে একটা ভাই আছে। জমি ভাগ হলে আর কিছুই থাকবে না। মনখারাপ হলে গুরুদেবের কাছে যেত। গুরুদেব তখন এতোটা ব্যস্ত ছিল না। সবার সঙ্গেই কথা বলত। বাড়ির কুলদেবতাকে পূজো করতো আর গ্রামের কেউ গেলে হাত দেখতো। পয়সা চাইত না। বেশির ভাগ সময়ই বই পড়ত। সব রকমের বই পড়ার অভ্যাস ছিল। গ্রামের সবাই খুব ভালোবাসত তখন। একাই থাকত গুরুদেব। বাবা মা অনেক আগেই মারা গেছে। গ্রামের কারো বাড়িতে ভালো-মন্দ রান্না হলে গুরুদেবকে দিয়ে যেত। খাবারে তিনি বাদ বিচার করতেন না। তিনি বলতেন, খাবারের ধর্ম হয়না। খেয়ে সইতে পারলেই চলবে। পেটে লোভ নিয়ে ধর্ম হবে না। গুরুদেব সবার সঙ্গে মিশে যেতে পারতেন। জেলার নেতারাও গুরুদেবকে পছন্দ করে। গতবার নির্বাচনের মিটিংয়ে বিশেষ অতিথির ডাক পেয়েছিল গুরুদেব। তাই মানুষেরও ঢল নেমেছিল। সেবার ভোটে ব্যাপক ফল করে। এবার তাই আরো জোর কদমে মাঠে নামছে জেলার নেতারা। গুরুদেব তার বাবার ধর্মকে প্রচার করতে চায়। তাই রাজনীতির মধ্যে দিয়ে যদি প্রচার হয় খারাপ কী? দলও বলেছে পাশে আছে। গুরুদেব আগের থেকে অনেক বদলে গেছে। সাহস নিয়ে অধীর একবার বলে ফেলেছিল, ‘গুরুদেব তুমি কিন্তু অনেক বদলে গেছো!’ গুরুদেব অধীরের দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলেছিল, ‘উপায় নেই। বাঁচতে গেলে রাজনীতির ছাতার তলায় আসতেই হবে। তুইও তো অনেক চেষ্টা করলি, তবু চাকরি পেলি না। অথচ দু-ক্লাস পাস করে নেতাদের পা চেটে দেখ বড়ো বড়ো অফিসের বাবু হয়ে বসে আছে। পেটে লাথি মরলে ক বেরোবে না। ওদের সঙ্গে থেকে যদি বাবার কথা প্রচার করতে পারি তাহলে আমার মরা বাবাও শান্তি পাবে। ওরা আমাকে ভালোবাসে। আর আমি না থাকলে ওদের চলবে না। আমি থাকলে তোদেরও কাল একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে।’
‘কিন্তু গুরুদেব, এটা তো অন্যায়।’ প্রতিবাদ করলো অধীর।

মৃদু হেসে গুরুদেব বললো, ‘ন্যায় অন্যায় বিচার এখন বড়ো কথা নয়। লড়াই করে বাঁচতে হবে। তোরা যে কতো কষ্ট করে দীক্ষা দিস সেটা আমি জানি। আমি আগে কখনও জোর করে দীক্ষা দিতাম না। কারণ আমার মনে হয়, মন থেকে ভগবানকে না চাইলে ভগবানকে পাওয়া যায় না। যদিও এখন এসব ভাবি না। যত লোক দলের কাছে দেখাতে পারবো ততো কমিশন। আর তোরা তো জানিস কমিশন আমি একা খাই না। ওরা কমিশন না দিলে পুকুরপাড়ের পরিবারটা বাঁচবে না। তাছাড়া দেখবি কিছু মানুষ আছে যাদের অনেক থাকলেও এক টাকাও বার করতে চায় না। তখন তাদের ভয় দেখিয়ে টাকা বার করতে হয়। এবার তুই বল, আমি ভুল না ঠিক?’

এ প্রশ্নের উত্তর অধীরের জানা নেই। তাই চুপ করে রইল। তবে গুরুদেবের কথার সঙ্গে পুরোপুরি সহমত হতে পারলো না।


অমিত বিরক্ত হয়ে বেরিয়ে গেলো। অমিত চন্দনের একমাত্র ছেলে। এ বছর সিভিল সার্ভিস পরীক্ষাতে পাশ করেছে। ইন্টারভিউ হয়ে গেছে। চাকরিটা হয়ে যেতে পারে। গ্রামে একটা কোচিং সেন্টার চালায়। সুকুমার আসায় সকালটা একেবারে মাটি হয়ে গেল। সকালের দিকে অমিত নোটস রেডি করে। রাস্তায় বিলুর সঙ্গে দেখা। অমিতকে বিরক্ত লাগছে দেখে সাইকেল থেকে নেমে পড়লো বিলু। পিছন থেকে ডাক দিল, ‘অমিত।’ মুখ ঘোরালো অমিত। এগিয়ে এলো বিলু। ‘কিরে কিছু হয়েছে?’

‘আর বলিস না। সুকুমার এসে জোর করে দীক্ষা দিয়ে গেল।’
‘তোদের বাড়িও গিয়েছিল? কাল তো আমাদের বাড়ি এসেছিল। বাবা মুখের উপর না বলে দিয়েছে।’ বললো বিলু।
‘কী বলি বল তো। চাকরি নিয়ে এমনিতেই টেনশনে আছি। এসব ফালতু ঝামেলা ভালো লাগে না।’
‘ছাড় তো ওদের কথা।’

‘কী বলে জানিস? বলছে দীক্ষা নাও, ঠাকুরকে ডেইলি দু চার টাকা করে দাও, তাতেই নাকি আমার চাকরি হয়ে যাবে।’ অমিত হালকা হাসলো।

পুকুরের দিকে হেঁটে গেল দু’জন। বড়ো কুল- গাছটার নিচে বসার জায়গা আছে। অমিত বসলো। ‘বিড়ি এনেছিস?’ বিলু তারা থেকে একটা বিড়ি বার করে অমিতকে দিল, আর একটা নিজে ধরালো। দু-তিনটে টান দেবার পরে অমিত বললো, ‘জানিস ভাই, আমার কী মনে হয়? ধর্ম এখন অর্থনীতির পরিকাঠামো। সরকারের বাজেটে তো পরিকাঠামো নিয়ে কথা নেই, তাই ধর্মকে এগিয়ে দিচ্ছে। এখানে সরকারের বিনিয়োগ নেই। বিশ্বাস তৈরি করতে পারলে মানুষই বিনিয়োগ করবে আর সরকারের পেট ভরবে।’

‘খুব খারাপ। ধর্ম চাহিদা কমাবে। ওরা তোকে ত্যাগ শেখাবে।’
‘ঠিক কথা। বাবা আগেই দীক্ষা নিয়েছিল। যাই হোক, মা আমি মাছ ডিম খেতাম। কাল থেকে তো তাও বন্ধ। আমার বাবার তো কোনো চাহিদাই নেই। কথা বললেই বলে ভগবানের কাছে দাবি রাখতে নেই।’
‘আসলে সরকার যখন চাহিদা পূরণ করতে পারে না তখন ধর্মকে চাপিয়ে দেয়। ধর্ম মনের প্রলেপ দেবে। তোমার না পাওয়াকে ভুলিয়ে দেবে।’ বললো বিলু।

‘বিশ্বায়নের যুগে চাহিদা যদি কমে যায়, তাহলে উৎপাদনে হবে কী করে?’
‘দেখ অমিত, লাইফে ধর্ম দরকার। সেটা একটা প্রিন্সিপাল। যাদের আমরা গুরু বলছি তারা তো ধর্মকে চাপিয়ে দিচ্ছে, আমাদের বোঝার সময় দিচ্ছে না।’
‘এখানেই তো সমস্যা বিলু। সকালে ওকে আমি এটাই বোঝাতে গেলাম যে, আমার মনের বিরুদ্ধ কেন জোর করবে? আমি বললাম বলে আবার বাবা রাগ করলো।’

‘পালন করতে পারবি তো?’ বিলু প্রশ্ন করলো।
‘পাগল নাকি। যাকে মন থেকে মানিনি তাকে পালন করব কী করে?’ সহজ কথা অমিতের।
‘জানিস ভাই, আমার মনে হয়, সবার ধর্ম পালনের দরকার নেই। আমার বুদ্ধিতে বলে, ধর্ম তো একটা নীতি। যে নিজে সৎ ভাবে চলে, মা বাবাকে সন্মান করে তাকে আর আলাদা করে ধর্মাচরণ করতে হয়না।’

‘আমি সংসার পরিবার ছেড়ে ধর্ম করার বিরোধী। তবে কী জানিস, ধর্ম আবেগ কেড়ে নেবার অস্ত্র। সবার আবেগ এক হলে ভোট পেতে সুবিধা হয়।’ বোঝালো অমিত।

‘দেখছিস তো আগে উত্তরপাড়ার মাঠে কতো বড়ো হাট বসত। এখন শুধু ফলের কিছু দোকান আসে। কে কিনবে?’
‘আরে বিলু, কিনলে তো ফালতু খরচা। তখন দলের ফান্ড ভরবে কে? দল বলছে তোমরা দীক্ষা নিয়ে শুকিয়ে মরো আর মাসে মাসে টাকা দাও। আজ এই তো কাল ওই। খরচ তো কতো করে। আগে তবু খিচুড়ি খাওয়াতো। এখন তাও বন্ধ। গত বছরের বাবার কাছ থেকে পাঁচ হাজার টাকা আদায় করেছে।’

‘তোর বাবা দিল কেন?’
‘না দিলে উপায় নেই। বাবার মাথাটা খেয়ে নিয়েছে। কতবার বাবাকে বারণ করলাম। বাবার সেই কথা, মানুষই তো খাবে, না দিলে হয়। আর বাড়িতে মা এক কেজি বেশি তেল আনতে বললে বাড়িতে ঝামেলা করবে। আসলে গুরুদেব বাবাকে খাতির করে, তেল মারে, বাবাও গলে যায়। ওরা এইভাবেই তো মানুষ ধরে। ‘কথা শেষ করে উঠে দাঁড়াল অমিত। ‘দুপুর ব্যাচ আছে রে। চলি। ম্যাটার রেডি করতে হবে।’


রাতে রঞ্জনদা আসবে গুরুদেবের বাড়ি। সুকুমারের কাছেই খবরটা পেল অধীর। কোনোদিন যাবার সুযোগ হয়নি। তাই সুকুমারের কাছে আবদার করে বসল, ‘আজ রাতে কিন্ত আমি থাকবো।’ সুকুমার পিঠ চাপড়ে বললো, ‘থাকবি, সে আর বলার কী আছে, রঞ্জনদার সঙ্গেও তোর আলাপ হয়ে যাবে। তাছাড়া আজ রাতে এলাহি আয়োজন। হোটেলে বলা আছে। রুটি, মাংস।’

রাত গভীর হতেই গোটা ছয়েক বাইক নিয়ে রঞ্জনদা এলো। গুরুদেব বসার ঘরটা খুলে দিল। রঞ্জনদা ঘরে ঢুকে বলে দিল, ‘আমি খাবো না। তোরা সব খেয়ে নে তাড়াতাড়ি। তারপর বসবো।’ বাকি লোকেরা খেতে বসে গেলো। সুকুমারও বসে গেল। ইশারায় অধীরকে ডাকলো। অধীর এলো। খাবার ফাঁকেই মাথা ঘুরিয়ে চারপাশ বোঝার চেষ্টা করলো। খানিক পরে গুরুদেব দিনের কালেকশন নিয়ে রঞ্জনদার ঘরে যাবার আগেই রঞ্জনদা বাইরে বেরিয়ে এলো। টাকার নোট গুনতে গুনতেই গুরুদেবকে বললো, ‘এসবের দরকার নেই। আমরা যা কাজ করেছি তাতেই ভোট পাবো।’ গুরুদেব কোনো উত্তর দিলো না। অধীর হঠাৎ বলে উঠলো, ‘তাহলে এসবের কী দরকার?’ রঞ্জনদা তাকালো। গুরুদেব পরিচয় করিয়ে দিল। ‘শোন ভাই, শুধু উন্নয়ন দিয়ে ভোট হয় না। মানুষের এত বিচিত্র চাহিদা, তা পূরণ করতে গেলে আমাদের পার্টি আর থাকবে না। তার থেকে ভালো প্রাথমিক চাহিদাটুকু পূরণ করে দাও।’

‘সেটাই তো আপনারা করছেন। বাড়তি এসবের কী দরকার?’ অধীর আবার প্রশ্ন করলো।
‘উন্নয়নে সঙ্গে আবেগ উত্তেজনা মিশিয়ে দিতে হয়। আর সেটা ধর্মের থেকে ভালো কেউ করতে পারে না। মানুষ সহজে অ-আ শিখতে পারবে না কিন্তু সে সহজেই রাধা-কৃষ্ণ শিখতে পারবে। তাই আমরা ধর্ম দিয়েই প্রচার সারি। আমরা ধর্মের সঙ্গে নিজের কথা মিশিয়ে দিই।’

‘তাতে তোমাদের লাভ?’
‘আসল নকলের মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি হলে আমাদের লাভ। অস্থির মনে আমরা যা বোঝাবো তারা তাই বুঝবে। সমস্যা কোনোদিন পুরো সমাধান করতে নেই। দশ টাকার দরকার হলে পাঁচ টাকা দাও। বাকি পাঁচ টাকার প্রতিশ্রুতি দাও। স্বপ্ন দেখাও— দেবে, দেখবি মানুষও বিশ্বাস করবে। মানুষ বেশি কিছু মনে রাখতে পারে না।’
‘পাঁচ টাকা পেলেই ওদের জীবন পাল্টে যাবে?’ গলায় আবেগ ধরে এলো অধীরের।

‘টাকা যখন দেবো জিনিসের দাম বাড়িয়ে দেব। টাকার দাম পরে যাবে। সে কোনোদিন জিনিসটা কিনতে পারবে না। কিন্তু আমরা আমাদের কথা রাখলাম। খুব কষ্ট হলে জীবনে ধর্ম ঢুকিয়ে দাও। দেখবি তখন মানুষ সারাদিন জল খেয়ে উপোস করছে, শান্তির আশায়।’

‘মানুষ কী বোকা!’ মনে মনে ভাবলো অধীর। রঞ্জনদা প্রশ্ন করলো, ‘কী ভাবছিস?’ অধীর উত্তর দিলো, ‘যদি লোকেরা একদিন সব জেনে যায়?’

রঞ্জনদা জবাব দিলো, ‘সেদিন আর আসবে না। সমস্যায় থাকলে মানুষ শুধু নিজের কথাই ভাববে। নতুন কিছু ভাবার আগে আমরা আবার সমস্যা চাপিয়ে দেব। যাদের খাওয়া পরার অভাব নেই তারা আমাদের সঙ্গে থাকে না, আমরাও তাদের গুরুত্ব দিই না। পারলে চারটে ফলস কেস দিয়ে থানায় ঢুকিয়ে দাও। এভাবেই চলবে ভাই। আর এভাবেই চালাতে হবে। এতো না ভেবে দলে চলে এসো, জীবন গড়ে যাবে।’

গুরুদেব ডাকলো রঞ্জনদাকে। আজ রাতেই ঠাকুর ফেলবে ময়রাদের বাড়িতে। পুকুরের জমিটা রঞ্জনদার লাগবে। তাই সবাই এসেছে। খাওয়া শেষ হতেই সবাই রঞ্জনদার ঘরে চলে গেল। কোলে বালিশ নিয়ে খাটের উপর রঞ্জনদা বসে। বাকিরা মেঝেতে বসলো। খোলা জানালার বিপরীতে অধীর বসলো। আলোচনা শুরু হলো। মাঝপথেই মন হারিয়ে গেলো অধীরের। এতো কথা গল্পের মধ্যেও তার অস্বস্তি হচ্ছে। অধীর বুঝতে পারছে, গ্রামটা বোধহয় থাকবে না। সব জমি বেদখল হয়ে যাবে। অশান্তির আগুন হয়তো ধর্মের ভগবানও নেভাতে আসবে না। অধীর অন্ধকার রাতে সেই ধ্বংসের শব্দই শুনতে পাচ্ছে।