সংহিতা বন্দ্যোপাধ্যায়
‘কাজটা ঠিক হল না জানিস, মনে হচ্ছে এখন’। ফোনের ওপারে বর্ণিনীর গলাটা ঝনঝন করে বাজল। বর্ণিনী আমার প্রথম বর বৈভবের আত্মীয়, ওর বিয়ে হয়েছে আমার বন্ধুর দাদা তনয়ের সঙ্গে। এ ছাড়াও বর্ণিনীর আর একটা পরিচয় আছে। ও ছিল ছিয়াশির মাধ্যমিক ব্যাচের আমাদের সুবুদ্ধিপুর গার্লস হাই স্কুলের এক নম্বর সুন্দরী, আমরা সহপাঠী আর বন্ধুও বটে।
Advertisement
বর্ণিনী একটা প্রাইভেট ফার্মের কেমিক্যাল ল্যাবে বায়োলজিস্টের চাকরি করে, তনয় ইঞ্জিনিয়ার। ওদের এই ছিমছাম সংসারে আর একজন সদস্য বেড়েছে গত তিন বছর হল, তোর্ষা। তোর্ষা এখন ওদের মেয়ে। সাড়ে তিন মাস বয়সে ওকে দত্তক নিয়েছে ওরা।
Advertisement
‘মানে, কোন কাজের কথা বলছিস? আমি কিছু বুঝতে পারছি না।’
‘মানে আর কী? ও বাড়ি ছাড়াটা। অথচ দেখ, যতক্ষণ থেকেছি, কী না বলেছে মিঠাইকে নিয়ে। আয়ামাসি পর্যন্ত বলত, দিদি, তোমার শাশুড়ির বড় মুখ গো! মেয়েটার না শেষে নজর লেগে যায়!’
‘কেন রে, আবার কী বলেছেন?’
‘কী আর, তখন আমার ননদ ননদাইয়ের সঙ্গে খুব ভাব। বাড়ি বিক্রির তোড়জোড় চলছে। তনয়ের জামাইবাবু নাকি দেখাশোনা করবে তাই পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি চাইছে, মাকে বুঝিয়েছে, বুড়ো বয়সে একা পড়ে যাবেন, তনয়ের বদলির চাকরি, দেখাশোনা করতে পারবে না, এই সব।’
‘হুঁ, তনয়দা কী বলছে?’
‘গাল ফুলিয়ে বসে আছে। এদিকে তো মা-মা করে ওখানে থাকতে এতদিন কী না করত! বোঝো এবার!’
‘শোন, বিকেলে পারলে তোর ওখানে আসছি, তখন কথা হবে। চিন্তা করিস না। তোর্ষা ভাল আছে?’
‘হ্যাঁ, স্কুলে গিয়েছে।’
‘তুই?’
‘অফিসে।’
‘ওকে, বাই!’
ওদের বাড়ি গিয়ে সব শুনলাম। বছর চারেক হল, তনয়দা মুম্বাই থেকে বদলি হয়ে এই শহরে ফিরে এসে বেহালায় নিজেদের পুরনো বাড়িতেই প্রথমে উঠেছিল। তিনতলা বাড়ি, তনয়দার বাবার করা। ওপর তলায় ওর মা একাই থাকতেন, বর্ণিনীদের জন্য ওপর তলারই একটা দিক সাজানো গোছানো থাকত, ছুটিতে এলে থাকার জন্য। আলাদা শোয়ার ঘর, রান্নাঘর, স্নানঘর সব আছে। ওখানেই উঠেছিল ওরা।
তনয়দার বাবা ছোটবেলায় চলে যাওয়ার পর, মায়ের হাতেই মানুষ হয়েছে তনয়দা আর ওর দিদি, এ সব কথা বর্ণিনীর মুখে আগে শুনেছি। নিচে তানিয়াদি, মানে তনয়দার দিদি, তার ঘরজামাই বর আর ছেলে নিয়ে থাকে। মুখে বলে নাকি ভাড়া দিয়ে থাকে, কে জানে! তানিয়াদি তনয়ের আট বছরের বড় দিদি, ছোট থেকে তনয় নাকি ওর ন্যাওটা ছিল, দিদি গাছে চড়তে বললে চড়ে বসে থাকত, নামতে না বললে নামত না এইরকম, মারধরও খেয়েছে অনেক। তার প্রতি তনয়ের আনুগত্য আজও ছোটবেলার মতো।
জামাইবাবুটি তেমন কিছু করেন না, খুচরো টুকিটাকি ব্যবসা, আর জমির দালালি করে সংসার চালান। পালিয়ে বিয়ে করার পর ফিরে এসে দিদির আর তেমন পড়াশোনা হয়নি, কী একটা বিদেশি কোম্পানির দামী প্রসাধনী বিক্রির এজেন্সি ধরেছে আজকাল। ওদের একটাই ছেলে হোটেল ম্যানেজমেন্ট পড়ছে হলদিয়ায়।
বর্ণিনীরা আসার আগে থেকেই নাকি শুনেছিল, কোনও কারণে মনোমালিন্য হওয়ায় তানিয়াদিদের সঙ্গে কথা বন্ধ ছিল তনয়দার মায়ের, এখনও প্রায় তাই। তবে বর্ণিনীরা আসার পর ওদের সঙ্গে অবশ্য স্বাভাবিক ব্যবহার করেছে দিদিরা!
যাই হোক, ফেরার পর প্রথমে ভালোই ছিল ওরা, কিন্তু তোর্ষাকে দত্তক নেওয়া নিয়ে তনয়দার মায়ের আপত্তি শুরু হয়। বারো বছরের বিবাহিত জীবনে অনেক চিকিৎসা করিয়েছিল ওরা, অবশেষে সন্তান দত্তক নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় দু’জনে। সাত মাসের তোর্ষাকে হোমে দেখেই মায়া পড়ে গিয়েছিল, মনে আছে বর্ণিনীর অনুরোধে, আমিও প্রথম দিন ওদের সঙ্গে হোমে গিয়েছিলাম। তোর্ষা তখন ভীষণ প্রাণবন্ত! ওকে নিয়ে আসার আগে, বর্ণিনীই শাশুড়িকে ওর কথা জানায়। উনি কিছুতেই মন থেকে ব্যাপারটা মেনে নিতে পারেননি। প্রথমে বারণ, অজাত-কুজাতের প্রসঙ্গ, তারপর ভয়ও দেখান তিনি! বংশ মর্যাদার ভয়, জন্মগত কঠিন অসুখ বিসুখের ভয়!
কিন্তু সে সব অগ্রাহ্য করে, ওরা যখন অবশেষে মেয়েকে বাড়ি নিয়ে এল, তখন বর্ণিনীর নামে নানা কথা, ওর সন্তান ধারণের অক্ষমতা নিয়ে কথা শোনানো, কান্নাকাটি এই সব ওঁর নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।
‘মেয়ের জন্য ঘরে আমাদের ঢোকেন না জানিস! কোলে নেওয়া তো দূরের কথা, ছোঁবেন না পর্যন্ত! তবু আমি কিছুই বলিনি। কাজের লোক, আয়াদের বকাবকি, ওদের সঙ্গে তোর্ষাকে নিয়ে কুৎসা, ওর জন্ম নিয়ে, চেহারা নিয়ে, শেষে বাধ্য হয়েই ওখান থেকে বেরিয়ে এলাম! অবশেষে এই ফ্ল্যাট। আসার সময় তনয় তো কেঁদেই ফেলেছিল। চেষ্টা করে নিজের শহরে বদলি নিয়েছিল, ভেবেছিল বাড়ি ফিরবে, মায়ের কাছে থাকবে। মায়ের আধুনিক মানসিকতা নিয়ে মনে মনে খুব গর্ব ছিল ওর, সেই বিশ্বাস ভেঙে যেতে আঘাত পেয়েছে খুব!’
কথাগুলো বলতে বলতে চোখ মুছছিল বর্ণিনী।
নতুন ফ্ল্যাটে একটু একটু করে গুছিয়ে এখন সংসার করছে ওরা। তোর্ষাও ডালপালা ছড়াচ্ছে তরতর করে, কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই আবার আর এক ঘটনা!
এখন নাকি তানিয়াদিদের সঙ্গে খুব ভাব হয়ে গেছে তনয়দার মায়ের! এতটাই, যে, জামাইবাবুর কথায় মাসিমা এখন বাড়ি বিক্রি করতে চাইছেন প্রমোটারকে, উকিল ডেকে, কাগজপত্র সব তৈরি করে তারপর তনয়দাকে জানানো হয়েছে, শুধু একটা সই চাই ওর, ব্যস!
কথায় কথায় রাত হয়ে গেল। অনেকদিন পর বর্ণিনীর বাড়ি হয়ে অফিস থেকে ফিরেছি, যা হয়! ফিরে দেখি, জকি যথারীতি উপুড় হয়ে পড়ার টেবিলে ঘুমোচ্ছে, বই খোলা, পরীক্ষা সামনে!
মাথাটা গরম হয়ে গেল আমার। খুব বকলাম, অশান্তি হল এক চোট। ছেলে বড় হয়েছে, চুপ করে থাকার পাত্র নয়, বেশি বললে গোঁজ হয়ে বসে থাকে, খাওয়া দাওয়া বন্ধ! আমি আর কত বলব, রাজেন বাড়ি ফিরবে আগামী কাল, মাসে অর্ধেক দিন ট্যুর থাকে, বড় কোম্পানি, দায়িত্ব অনেক, জীবন ফাস্টট্র্যাক, ওকে বলে লাভ নেই। ছেলেকে প্রশ্রয় দিয়ে হাল্কা ধমক দেবে, তারপর বাপ বেটায় গেম খেলতে বসে যাবে। কী যে হবে ছেলেটার!
মাঝখানে বছরদুয়েক কেটে গেছে, চাকরিতে পদোন্নতির সঙ্গে দায়িত্ব বেড়েছে আমার। বর্ণিনীর সঙ্গে আর ফোনেও কথা হয়নি বিশেষ, দেখা তো নয়ই। সবাই ব্যস্ত আমরা যে যার কক্ষপথে ছুটছি নিরন্তর।
ইতিমধ্যে রাজেনেরও পদোন্নতি হয়েছে, আমার আবার বদলি। জকি স্কুল ছেড়ে কলেজে ঢুকেছে। আমাদের সব আশা চূর্ণ করে শেষে ইংরেজি অনার্স পড়ছে ও।
ট্রাপিজের খেলার মতো এক কোম্পানি থেকে অন্য কোম্পানির মই ধরে, রাজেন একটা বিদেশি কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজার এখন, আমি পদার্থবিদ্যায়, সায়েন্স কলেজের অধ্যাপক থেকে বিভাগীয় প্রধান, অথচ আমাদের একমাত্র ছেলে জকি শেষে ইংরাজি অনার্স পড়ছে!
শুধু তাই নয়, রেজাল্টের ভিত্তিতে এত কলেজ থাকতে বিশ্ববন্ধু কলেজের মতো একটা মামুলি কলেজে চান্স পেয়েছে সে!
এই সত্যিটা আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। কিছুতেই মেনে নিতে পারি না। কোথাও কি ভুল হয়ে গেল? সব গোলমাল হয়ে যায়। তবে কি জিনের কোনও ভূমিকাই নেই? রাজেনের বাবা স্কুলশিক্ষক ছিলেন, আমার বাবা সরকারি উকিল! আমাদের দু’জনের পরিবারের দুই প্রজন্মের মেধা, আর আমাদের ছেলে কিনা…! কোনটা প্রভাবশালী— বংশ, পরিবেশ, মেধা, টিউশন, কোনটা? আমি তো ওর পিছনে আমার সবটাই দিয়েছিলাম! কিছুই বুঝতে পারি না, একটা চাপা হতাশা আমাকে ঘিরে থাকে সর্বক্ষণ। শুধু মনে হয়, আজকের সমাজে চকচকে বিলাসবহুল জীবনযাপনে অভ্যস্ত আমাদের মেধা, বুদ্ধিমত্তা, শ্রম আর কূটনীতির মাল্টিফ্যাক্টরিয়াল আউটপুট আমাদের সন্তান, অসফল! আমাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী কিছুই করতে পারেনি সে। তিলে তিলে তাকে গড়ে তোলায় প্রযুক্তিগত ভুল ছিল, না জিনের গঠনগত দোষ, তা এখন ভেবে লাভ নেই। প্রথম বিয়ে ভেঙে যাওয়ার পর নতুন করে জীবন শুরু করেছিলাম আমরা, আমাদের এই সুখী দাম্পত্যের সন্তানের এই সাধারণ হয়ে যাওয়া, ঝাঁ-চকচকে জীবনে ক্রমশ আমাদের দু’জনের মধ্যে এক অদৃশ্য দেওয়াল তুলে দিচ্ছে!
জকি এমনিতে বাধ্য ছেলে, সিগারেটও খেত না, বা এখন বোধহয় খায়। তর্ক করে না, প্রেমও নয়, শুধু ও খুব সাধারণ। ওর এই সাধারণত্বটা আমি মেনে নিতে পারিনি, চেষ্টা করেও পারছি না। এখন মনে হয়, অনেকগুলো ছেলেমেয়ে থাকলে আমার একটা অপশন থাকত, একটা সুযোগ, মাল্টিপল চয়েস। এক এক সময় মনে হয়, শুভ্র, আমার প্রথম স্বামীর কথা। ভীষণ মেধাবী ছিল শুভ্র, দিল্লি আইআইটির টপার, দারুণ বুদ্ধিমত্তা, কিন্তু শীতল, নিষ্ঠুর! কেরিয়ার ছাড়া কিছু বুঝত না। রাজেন অত মেধাবী নয়, ও পরিশ্রমী। তবে কি শুভ্রর সন্তান হলে… নিজের অবচেতনের এলোমেলো চিন্তার মুখোমুখি দাঁড়াতে অপরাধবোধ হয় আমার।
নিজেকে বোঝাই, এ সব ভাবা অবান্তর, নিজেকে কাজের মধ্যে ডুবিয়ে দিতে থাকি ক্রমশ আরও কাজ, বেশি রাত পর্যন্ত, সিগারেট, পার্টি, মদ, ইঁদুরদৌড়, আমারা দু’জনেই একে অন্যের কাছ থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছি কি? নাকি নিজেদের কাছ থেকেই! জকি একটু একটু করে নিজস্ব বৃত্ত গড়ে নিয়ে কখন আমাদের কাছ থেকে অনেক দূরে সরে যেতে থাকে আমরা লক্ষ্য করি না।
অনেকদিন পর বর্ণিনীর ফোনটা এসেছিল গতকাল। প্রাথমিক কুশল বিনিময়ের পর নিজেই বলল,
‘কাল তোদের অসুবিধে না থাকলে, ভাবছি তোর ওখানে যাব বুঝলি, তোর্ষার স্কুলের এক্সকারশন আছে, ও থাকবে না, খুব জরুরি দরকার আছে, গিয়ে কথা হচ্ছে!’
ওর গলার স্বরে উদ্বেগ স্পষ্ট ছিল, আমি বললাম, ‘চলে আয়।’
আজ রবিবার, ওর সঙ্গে তনয়দাও এসেছে, রাজেন বাড়িতেই আছে আজ, বহু-প্রতীক্ষিত ছুটির দিন আমাদের দু’জনের, অনেকদিন পর! একটু বেলায় দামী হুইস্কি দিয়ে ককটেল বানাল রাজেন, আমি স্মোকড প্রন।
‘ভীষণ সমস্যায় পড়েছি রে—’
বর্ণিনীকে বেশ চিন্তিত মনে হল।
‘আবার কী হল? শাশুড়ি বাড়ি বিক্রি করে দিয়েছেন?’
আমি তনয়দাকে এড়িয়ে প্রশ্ন করলাম।
‘আরে, না, না, সে তো এখন অন্যরকম। ওখানে দিদিদের কাছে টাইট খেয়েছেন, কান্নাকাটি, জামাই সব নিয়ে নিতে চাইছে, এই সব। এখন তো তোর্ষাকে চোখে হারান, দিদু-দিদু করে ডাকেন! এই তো আমাদের সঙ্গে থেকে গেলেন এক মাস। তনয় গিয়ে ছানি অপারেশন করিয়ে আনল।’
‘তাহলে?’
‘তোর্ষা! সমস্যা এখন তোর্ষাকে নিয়ে।’
‘ও কি জেনে গেছে?’
‘নাহ, মনে তো হয় না, কিন্তু পড়াশোনা কিছুই করছে না, ক্লাসে কারোর সঙ্গে মেশে না, বাড়িতেও একগুঁয়ে। নাচ, গান, আঁকা, কোনও কিছুতে আগ্রহ নেই। কথাও ঠিকমত বলে না, সব কিছুতেই ভীষণ স্লো, পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়ছে, পরীক্ষায় সময়ের মধ্যে লেখা শেষ করতে পারছে না, এই সব!’
‘সে কী, ডাক্তার দেখিয়েছিস? রোগাও তো হয়ে গেছে খুব, দেখলাম ফেসবুকে সেদিন।’
‘হ্যাঁ, কিচ্ছু খায় না জানিস, কিন্তু খেলাধুলা করছে, স্কুলের বাস্কেটবল টিমে আছে। ডাক্তার বললেন, ইন্টেলিজেন্স কোশেন্টের পরীক্ষা করতে আর ইমোশনাল কোশেন্ট, মনোবিদের কাছে আরও কিছু পরীক্ষা করাতে লিখেও দিয়েছেন। আবার তাই নিয়ে তনয়ের সঙ্গে আমার ঝগড়া।’
‘কেন? তনয়দা কী বলছে?’
বলছে, ‘ওর ইন্টেলিজেন্স আর ইমোশানাল কোশেন্ট সব ভাল, তুমি পড়া নিয়ে চাপ দিয়ে দিচ্ছ, তাই ভয় পেয়ে গেছে।’
‘তোর কী মনে হয়?’
‘দেখ, একটু পড়তে না বসলে স্কুলে তো শুনবে না। যদি ক্লাসে পড়া না পারে, যেটা প্রায়ই হচ্ছে, কমপ্লেক্স হয়ে যাবে। পাশ না করলে ইয়ার লস হবে, আরও সমস্যা। সেটা ও নিজেই নিতে পারবে না। ভীষণ সেন্সিটিভ।’
‘ডাক্তারকে ব্যাপারটা বলেছিলি?’
‘হ্যাঁ, প্রথমেই।
উনি বললেন,
‘অনেক সময় এরকম হয়, ওর ইন্টেলিজেন্স আর ইমোশানাল কোশেন্ট কম হলে সেটা তো মেনে নিতেই হবে আপনাদের। তবে সাইকোমেট্রি পরীক্ষা করে তারপর কাউন্সেলিংয়ের কথা ভাবা যেতে পারে।’
‘আমার মনে হয় করিয়েই নে।’
‘তনয় তো কিছুতেই মানতেই চাইছে না!’
ওরা চলে গেছে বিকেলে। তনয়দা সত্যি বিষয়টাকে কিছুতেই গুরুত্ব দিচ্ছে না। আমি বোঝালাম, রাজেনও বোঝালো আলগাভাবে। তনয়দা এড়িয়ে গেল। অবশেষে রাজেন ওর স্টাইলে বলল, ‘আসলে ব্রাদার, যা হবার তা হবেই, টেক ইট ইজি, আমরা ক্রীড়নক মাত্র! এই দুঃখে এক এক পেগ হয়ে যাক—’
তারপর কর্পোরেট কালচারের গল্পে মেতে গেল।
ওরা চলে গেলে আমি ভাবছিলাম, তোর্ষার আই কিউ, মানে ইন্টেলিজেন্স কোশেন্ট, অর্থাৎ বুদ্ধিমত্তার সূচক কম হতে পারে, হয়তো আবেগের সূচকও কম, সাধারণের চেয়ে। সেটাকে জন্মগত বা জিনগত খামতি ভেবে বর্ণিনী কি সান্ত্বনা পাবে? মানতে পারবে তনয়দা? জানি না। তখন মনে হবে না তো, আরও বাচ্চা ছিল, আরও অপশন, ওকে নেওয়ার আগে, পারিবারিক ইতিহাস আর একটু জেনে নিতে পারত ওরা?
আবার এ কথা তো বলার অপেক্ষা রাখে না, ওকে সবরকম সুযোগ দিয়েছে ওরা! তবে কি মেধার ওপর পরিবেশের কোনও প্রভাব থাকে না? পরিজনের স্নেহ সাহচর্যেরও নয়? আবার জিনের প্রভাব থাকেই, তা বলি কী করে? তাহলে আমাদের জকির কী হল! আচ্ছা, বর্ণিনী কি সত্যি নিজের উচ্চাশার বোঝা ওর ওপরে চাপিয়ে দিয়ে ওর পড়াশোনায় অনীহা তৈরি করে ফেলেছে? নিজের অপূর্ণ উচ্চাকাঙক্ষা আমিও কি চাপিয়ে দিয়েছি জকির ওপর ছোটবেলা থেকে?
রাত এখন একটা বাজে, রাজেন ঘুমিয়ে পড়েছে অনেকক্ষণ, আমার ঘুম আসছে না। চোখ বুজলেই আমি দেখতে পাচ্ছি একটা বিশাল দাবার বোর্ডে খেলেতে বসেছি আমরা সবাই, ওরা আমাদের গুটি, আমাদের বোড়ে। আমরা প্রত্যেকে, কিস্তিমাত করার খেলায় মেতেছি। আমাদের ঠাকুমা-দিদিমারা বলতেন, তালগাছে বেল হয় না। সত্যি কি তাই? তালগাছে তালই যে হবে সেটা বলা যায় কি! হয়তো, এখন উদ্ভিদবিদরা সংকর প্রজাতির সৃষ্টি করছেন বীজ বেছে বেছে, বৃহত্তর গবেষণাগারে গবেষণা চলছে সফলতম উদ্ভিদের প্রজাতি তৈরির! কিন্তু মানুষের সাফল্যের কি কোনও মাপকাঠি আছে? উন্নততর মানুষের সংজ্ঞা কী?
Advertisement



