শাশ্বত বোস
নতুন বর্ষার জলভরা মেঘের মিনারে যেন চাপা পড়ে গিয়েছিল একাদশীর চাঁদটা। অমাবস্যা কিংবা পূর্ণিমার কোটা, একাদশীর রাতে চাঁদটার চরিত্র কি একই থাকে বরাবর? অন্ধকারটা ক্রমশ জঙ্গলের ভেতর গাঢ় হচ্ছে যেন। বাঁধটার ওপর যে রাস্তাটা দিয়ে কিছুক্ষণ আগে হাঁটছিলাম, কিছুদূর গেলে তার গা থেকে ঝরনার মতন নদীর জল বেরিয়ে ওপর পাশে একটা খাঁড়ির মুখ তৈরি করেছে। চাঁদের আলো মাঝে মাঝে মোলায়েম কাদার ওপর পরে মোমের চাদরে লিথিয়াম কুচি ছড়িয়ে থাকার ভ্রম হচ্ছে। শুক্লা একাদশীর চাঁদের এখন ভরা মাস, কোটালের জল নেমে যাচ্ছে একটু একটু করে। ক্ষমাহীন ক্রূরতার সাক্ষী হয়ে চরাচর জুড়ে ফুটে উঠছে কাঁকড়া গাছের ভোঁতা শ্বাসমূলগুলো। আর জন্ম পাপের প্রলাপ নিয়ে চতুর্দিকে ছড়িয়ে আছে মরা জীবজন্তুর হাড়গোড়। জঙ্গলের ভেতরের কোনও নিরম্বু উপবাসী কোণ থেকে সমানে ভেসে আসছে আওয়াজটা ‘ওয়াউম’!
রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের হিমগর্জন। আমি এখন যে বিশাল গাছটার আড়ালে পিঠ লুকিয়েছি সেটার সাতপুরনো ডাল দেখে মনে হচ্ছে তার গা বেয়ে এক্ষুণি ঝরে পড়বে মৃত্যুর হিমশীতলতা। গাছটার গায়ে নাম না জানা একটা ছত্রাক এঁটে আছে আঠার মত। ইচ্ছে হচ্ছে গাছটার গা বেয়ে উঠে পড়ার। ডালটার একদম আগার দিকে একটা চাকে মৌমাছি ভোঁ ভোঁ করছে। আওয়াজটা ক্রমশ আমার দিকে এগিয়ে আসছে। রক্তমাংসের, ক্রোধ-ঘৃণার বোধ থেকে সরে যাওয়া অন্য একটা জীবন নিয়ে নির্জন একটা উপলব্ধি অনুভব করতে পারছি অলৌকিক হিমজ্যোৎস্নার হাত ধরে, যাতে মিশে আছে মৃত্যুর ঠিক আগের ব্যথা, বিষণ্ণতা।
ছেলেটার নাম বলেছিল ‘মুঈন মন্ডল’, গোসাবার ২ নম্বর আয়নপুর মালোপাড়ায় বাড়ি। আজকে সকালেই গদখালিতে আলাপ আমার সঙ্গে। দিব্য হাসিখুশি ছেলে। সুন্দরবনে তিন দিন দু-রাত ভ্রমণের প্যাকেজে, ট্যুর কোম্পানির হয়ে পান্থদর্শনের কাজ করার পাশাপাশি কথায় কথায় একেবারে মিশে গেছিল আমাদের সঙ্গে। চুপি চুপি বলেছিল আজ একাদশী গণ, ভোররাতে মাছ ধরতে নিয়ে যাবে। ওর কথাতেই পাখিরালয়ে নির্দিষ্ট করা লজে না থেকে ঠিক করেছিলাম অ্যাডভেঞ্চারের মাত্রাটা আরো নৈসর্গিক উচ্চতায় নিয়ে যাবার জন্য, রাত কাটাবো ওদের সঙ্গে বোটের ভিতর। রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর একটু বিশ্রাম করে নেব, ওদের ঠিক করে দেওয়া ক্যাম্প খাটে। তারপর রাতের শেষ প্রহরে কোটাল এলে নৌকো করে বেরিয়ে পড়বো, সুন্দরবনের গহীন মানচিত্রে স্পেকট্রামি জাল বোনা খাল-জোলাগুলোর উদ্দেশে, যেখানে ভাঁটার সময় হাত-জালে প্রচুর খয়রা, চিংড়ি এসব পাওয়া যায়। তখন গভীর রাত, খাটে শুয়ে এপাশ ওপাশ করছিলাম। উত্তেজনার বশে কাটাচ্ছিলাম অনিদ্রাবিলাসী ত্রিযামা প্রহর। হঠাৎ যেন বোটের মেঝে থেকে উঠে এল আওয়াজটা। সরসর করে কিছু একটা টানার শব্দ। ঠিক তখনই কেবিনের কাঠের দরজাটায় টোকা পড়লো, ‘দাদা চলেন, নৌকা রেডি!’ লম্বা চোঙার মত মুখটা দরজার একটা পাল্লার আড়াল থেকে আধখানা বার করে ডাক দিল মুঈন। ঘরটার টিমটিমে আলোয় তখন শুধু তার চোখদুটো দেখা যাচ্ছে। ওই দুটো চোখের আড়ালে কী ভীষণ বলিষ্ঠ সম্মোহন লুকিয়ে ছিল তা তখন ধরতে পারিনি। নদীর বাস্তুতন্ত্রের বুক চিরে ভেসে আসা ওর ওই একটা ডাকেই ওর সঙ্গে বেরিয়ে পড়েছিলাম।
কোটালের জল তখন সবে খালে উঠতে শুরু করেছে। আমাদের বোটটা নোঙর করা ছিল গুমতী নদীর ঠিক মাঝ বরাবর। বেশ কিছুটা নৌকা বেয়ে পিছিয়ে গিয়ে আমরা ধরলাম সরু খাঁড়ির পথ। মুঈনকে জিজ্ঞাসা করায় বললো, আমরা যাচ্ছি মুইপীঠ কোস্টাল থানার অন্তর্গত হাতামারির জঙ্গলের ভিতর দিয়ে। আর কিছুদূর গেলেই বৈঠামারির জঙ্গল, এগুলো সুন্দরবনের রেস্ট্রিক্টেড এরিয়া। রাতের শরীর জুড়ে তখন নিশ্ছিদ্র রক্তাল্পতা। শর্বরী মেঘের ছবি বুকে নিয়ে নৌকোটার গা বেয়ে যেন ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে গুঁড়ো চাঁদের আলেখ্য। নৌকো জুড়ে বঁড়শির সারি। নৌকার অন্যান্য ছেলেগুলো মিলে সন্ধের জালে ধরা পুঁটি মাছ, খয়রা মাছগুলো কাটতে বসে গেল। এরা সবাই বিধবা গ্রামের ছেলে। আধ আঙুল সমান টুকরো করা মাছগুলোকে বঁড়শিতে গিঁথে কাঁটাগুলো জলে ফেলতে শুরু করে দিল ওরা। জঙ্গল তখন আমাদের থেকে ৫০ মিটার মত হবে। হঠাৎ মুঈন বলে, ‘দাদা, নদীর চরে চেতলা হরিণের ঝাঁক আসিছে, জল খাবার জন্যি। যাইবেন নাকি দেখতি?’
এ রাতের রাসায়নিক মিথস্ক্রিয়ায় মুঈনের মসৃণ স্বরকে অস্বীকার করার ক্ষমতা আমার নেই। নৌকোটাকে পারের দিকে ভেড়ালো ও। একটা ছোট বাণী গাছের ডাল ধরে নৌকো থেকে নেমে পড়লাম। আমার হাতের টর্চটাকে অন করতে গেলে মুঈন বাঁধা দিল, ওতে নাকি হরিণের ঝাঁক পালাবে। তখন আমি যেন আমিতে নেই, মুঈনের মন্ত্রমুগ্ধ দাসে পর্যবসিত হয়েছি। এদিকটায় লাইলন ফেন্সিং নেই। হাঁটুজল ঠেলে জঙ্গলের ভেতরের দিকে এগোতে এগোতে আমি যেন শুধু ওকেই দেখছি। অনেকটা ভেতরে ঢুকে এই বড় গাছটার কাছে এসে মুঈন বললো, ‘এইখানে চুপটি করে দাঁড়িয়ে থাকেন দাদা, আমি একটু মুতে আসি। সাইবধান লইড়বেন না যেন, জঙ্গলি বাঘ আছে লিচ্চয়!’
কেন আমি এই কথাটা শুনে ওকে জাপটে ধরে বলিনি, ‘আমায় বোটে নিয়ে চল। আমার আর কিচ্ছু চাইনা’, জানিনা। চোখের সামনে থেকে সে সরে যাবার বেশ কিছুক্ষণ পর বুঝলাম, সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবেই সে এবং তারা আমাকে এত রাতে জঙ্গলে এনেছে এবং একা আমাকে এখানে ফেলে রেখে পালিয়েছে। রাতের নির্লিপ্ত ষড়যন্ত্রে এই সমাধিস্থ জঙ্গলে আমি এখন সম্পূর্ণ একা ও বেওয়ারিশ! একটা ভীষণ মৃত্যুকালীন খিদে আমায় দোমড়াচ্ছে অথচ উদ্বৃত্ত আতঙ্কে আমার জিহ্বায় কুলকুচি দিচ্ছে এক গভীর আরণ্যক বিষাদ! একজোড়া জ্বলন্ত চোখ, হেঁতাল পাতার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছে আমার দিকে। প্রচন্ড ধূর্ত সে চাহনি। সমস্ত শরীরটা ছোট করে একটা বিশাল লাফ দিলে আমাদের মাঝের ভৌগোলিক দূরত্ব মুছে যাবে। হঠাৎই অশরীরী বিস্ময়ে পলকহীন দৃষ্টিতে দেখলাম, ঘাঘরা পরা একটি মুসলমানী মেয়ে এগিয়ে যাচ্ছে সেই চোখ জোড়ার দিকে। তার সর্বাঙ্গ স্বর্ণালঙ্কার ভূষিতা। এই নিকষ অন্ধকারেও একটা তির্যক দ্যুতি বেরিয়ে আসছে তার কর্ণকুণ্ডল থেকে। বাঘটার সামনে গিয়ে মেয়েটি কিছুক্ষণ স্থির চোখে তাকিয়ে রইলো, তার পর ওপরের দিকে মুখ উঁচু করে খোলা আকাশের দিকে চেয়ে বিড়বিড় করে কিছু বললো। বাঘটা ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে একটা বিশাল হুঙ্কার ছেড়ে নদীর চরে চিতল হরিণের ঝাঁকটার দিকে এগিয়ে গেল।
মুঈন শুদ্ধ পুরো দলটা ধরা পড়েছিল। পুলিশের জেরার মুখে মুঈন স্বীকার করেছিল, স্বপ্নে দক্ষিণরায় ওর বোনের সদ্য বিবাহিত স্বামীর জীবনের বিনিময়ে নরমাংস চেয়েছিল ওর কাছে। সেই মহাজাগতিক ইচ্ছেপূরণের বলি হিসেবেই আমাকে ও গভীর জঙ্গলে বাঘের মুখে রেখে এসেছিল। কোনো এক স্থানীয় তন্ত্রচর্চ্চায় ও হিপ্নোটিজম শিখেছিল এবং সেটারই নিদাঘী প্রয়োগ ঘটিয়েছিল আমার ওপর, একেবারে শুরু থেকেই আস্তে আস্তে। সেদিন রাতে জঙ্গলে হয়তো আমি জ্ঞান হারিয়েছিলাম। পরদিন দুপুরবেলার দিকে গদখালিতে আমাকে আমার পরিবারের হাতে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের লোকজন যখন পৌঁছে দেয়, তখন আমার কানে ভাসছে গত সন্ধেয় পাখিরালয়ে বনবিবির মন্দিরের সামনে বসে শোনা দেবীর পাঁচালির কটা লাইন,
‘কাঙালের ও মাতা তুমি বিপদনাশিনী।।
আমারও দুঃখেরও মাঝে তরাবে আপনি।।
বনবিবি গো।।
বনবিবি গো।।
বনবিবি মাগো তোমার ভরসাতে এলাম।।
দুধেভাতে থাকবো সুখে, সেলাম দিলাম।।
যেন বাঘে ছুঁয়ে না।।
যেন বাঘে ছুঁয়ে না।।’
ফুরিয়ে যাবার সন্ধিক্ষণে মৃত্যুকে অস্বীকার করে ফিরে এসে আমিময় এই সকালটাতে মনে পড়ে যায়, বিগত কালের শেষ বিকেলের কনে-দেখা আলোয় দেখেছিলাম মন্দিরের অধিষ্ঠাত্রী দেবী মা বনবিবিকে। বাহনহীন মুসলমান কিশোরীর বেশ, কানে কুণ্ডল, গলায় হার, মাথায় মুকুট। সেই সন্ধেয় নাচ দেখতে আসা রমণীরা তাহলে ঠিকই বলেছিল, জঙ্গলে মা বনবিবি সত্যিই আছেন!