সুব্রত সরকার
স্কুলের মিডটার্ম পরীক্ষার রেজাল্ট আজ বেরিয়েছে। অবন সব বিষয়ে দারুণ মার্কস পেয়েছে, কিন্তু বাংলায় খুব কম! মা তো রেজাল্ট দেখেই চেঁচিয়ে উঠলো, ‘ছিঃ ছিঃ তুই বাংলায় সবচেয়ে কম পেয়েছিস!.. এত কম নাম্বার কীকরে পেলি?’
Advertisement
ঠাম্মা মায়ের রাগী মুখটার দিকে চেয়ে বলল, ‘খুব খারাপ করেছে?’
মা আরও রেগে বলল, ‘রেজাল্টে লিখে দিয়েছে, ভেরি পুওর ইন বেঙ্গলি। টেক কেয়ার।’
Advertisement
অবন চুপ করে আছে। ভীষণ ভয় পায় মাকে। বাবাও বকবে অফিস থেকে এসে। তবে আজকে নয়। বাবার বাড়ি আসতে আসতে অনেক রাত হয়ে যায়। অবন তখন ঘুমিয়ে পড়ে। বাবার সঙ্গে ভালো করে দেখা ও কথা হয় শুধু রবিবার।
দাদু বলল, ‘বৌমা চিন্তা কোরো না। ও ঠিক হয়ে যাবে। বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। শিখতে দেরি হবে না।’
মা বলল, ‘এবার তোর জন্য একজন বাংলার টিচারও আমাকে খুঁজে বের করতে হবে!’
আজ নতুন টিচার পড়াতে এসেছেন। অবন এবার থেকে সপ্তাহে দু’দিন এই নতুন স্যারের কাছে বাংলা পড়বে। অবনের আরও দু’জন স্যার বাড়িতে এসে পড়ান। একজন অঙ্ক, অন্যজন ইংরেজি। অবন গিয়ে শেখে আঁকা ও সাঁতার। বাবা বলেছে, পরের বছর অগ্রণীর ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে ভর্তি করে দেবে।
নতুন স্যার আজ অবনের সঙ্গে অনেক গল্প করেছেন। একটা কবিতা পড়িয়েছেন। বাক্যরচনা শিখিয়েছেন। নতুন স্যারকে অবনের খুব পছন্দ হয়েছে। স্যার বলেছেন, ‘বাংলা তো আমাদের মাতৃভাষা। এ ভাষা কত মিষ্টি। নিজের ভাষা শিখতে কষ্ট হবে কেন? ভাষাকে ভালোবাসতে হবে। একটু মন দিয়ে পড়লেই তুমি বাংলায়ও অনেক নাম্বার পাবে।’
দাদুর সঙ্গে ডিনার করতে করতে অবন অনেক গল্প জুড়ে দিল। মা রান্নাঘরে ছিল। ফিসফিস করে অবন বলল, ‘দাদু তুমি বাংলা পরীক্ষায় অনেক নাম্বার পেতে?’
দাদু মুচকি হেসে বলল, ‘সে কি আর মনে আছে! তবে আমার ভালো লাগত ইতিহাস পড়তে। দেশ-বিদেশের কত কথা-কাহিনি ইতিহাস বই থেকে জেনেছি। ইতিহাসে আমি অনেক নাম্বার পেতাম।’
‘দিদার ফেভারিট সাবজেক্ট কী ছিল তুমি জানো?’
‘দিদার কিন্তু বাংলা ছিল প্রিয় বিষয়। দিদা বাংলায় এমএ।’
মা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে বলল, ‘খেয়ে উঠে লিখতে বসবি রচনাটা। এখনই ঘুমোতে যাবি না।’
অবন ভেবেছিল দাদুর সঙ্গে বসে আইপিএলের ম্যাচ দেখবে। আজ কেকেআরের খেলা আছে। রাসেলের ব্যাটিং দেখবে। কিন্তু ভয়ে আর সে আবদার করতে পারল না।
অবন এখন বাংলা পড়তে খুব ভালোবাসে। ভয় কেটে গেছে। স্যার ভীষণ খুশি। স্যার শুধু বইয়ের পড়াই পড়ান না। অন্য অনেক কিছু গল্প করে করে শোনান। লিখতে দেন। আগের ক্লাসে স্যার একটা রচনা লিখতে বলে গিয়েছিলেন, দশ লাইনের ছোট্ট রচনা— ‘আমাদের বাড়ি’। হোমওয়ার্কটা স্যার এসে প্রথমেই দেখতে চান। তারপর নতুন পড়া শুরু করেন।
আজ স্যার এসেই হোমওয়ার্কে ‘আমাদের বাড়ি’ রচনাটা দেখছেন, অবন লিখেছে— ‘আমাদের বাড়িটা খুব বড়। আমাদের বাড়িতে মা, বাবা, দাদু, দিদা থাকে। একটা পুশি ক্যাটও আছে। বাবা অনেক বড় অফিসে কাজ করে। বাড়িতে একদম থাকে না। আমার সঙ্গে কথাই বলে না। মাকে আমার খুব ভয় লাগে। রেগে গেলে মা ইংরাজিতে বকা দেয়। বাবাও ইংরাজিতে মায়ের সঙ্গে ঝগড়া করে। আমার দিদা খুব ভালো। আমাকে ভীষণ আদর করে। দাদু আমাকে অনেক গল্প বলে। বেড়াতে নিয়ে যায় বিকেলে। আইপিএল দেখি দাদুর সঙ্গে। দাদু আমার প্রিয় বন্ধু। আমি মাকে সি দেব। বাবাকে ডি। দিদাকে বি। দাদুকে এ।’
বাংলার স্যার অবনকে দশে দশ দিয়ে বললেন, ‘খুব ভালো হয়েছে। কী সুন্দর লিখেছো ছোট্ট রচনাটা।’
অবন আনন্দে লাফিয়ে উঠে বলল, ‘থ্যাঙ্ক ইউ স্যার।’ তারপর স্যারের হাত থেকে খাতাটা ছিনিয়ে নিয়ে বলল, ‘মাকে দেখিয়ে আসি, আমি দশে দশ পেয়েছি।’
অবন ছুটছে বারান্দা দিয়ে। স্যার বুঝতেই পারেননি, ও যে হঠাৎ এমন আনন্দে খাতাটা কেড়ে নিয়ে দৌড়ে চলে যাবে মায়ের কাছে!
Advertisement



