প্রথমে এক সপ্তাহ আগে দুই ভাইয়ের মৃত্যুর পরিকল্পনা। বাড়িতে জানালে, স্ত্রীদেরও সহমরণে যাওয়ার আর্জি। বিষ পায়েস খেয়ে কাজ না হলেও মৃত্যু নিশ্চিত করতে ছুরির ‘নিখুঁত’ কাট। বিলাসবহুল ‘চিত্তনিবাস’ আপাদমস্তক ক্যামেরার নজরদারিতে মোড়া থাকলেও ঘটনার দিন দুয়েক আগে থেকে নিষ্ক্রিয় সব ক্যামেরা। বাড়ি বন্ধক, একাধিক সংস্থা থেকে ৫ কোটির ঋণ থাকা সত্ত্বেও অভাবের ছাপ স্পষ্ট নয় সদস্যদের বৈভবে। তিনজনের খুনি কে? দুই ভাইয়ের অসংলগ্ন জবাব। সব মিলিয়ে ট্যাংরা কাণ্ডের জট খুলতে গিয়ে রহস্যের অতলে তলিয়ে যাচ্ছেন তদন্তকারী আধিকারিকেরা। তাই এবার দুই ভাইকে মুখোমুখি বসিয়ে জেরার করার পথে হাঁটতে চাইছে লালবাজার।
এই ঘটনায় প্রণয়ের নাবালক পুত্র যে খুন করেনি, তা পুলিশের কাছে স্পষ্ট। সুতরাং খুনের পিছনে তদন্তকারীদের মাথায় দুটি সম্ভাব্য মোটিভ ঘুরপাক খাচ্ছে। প্রথমত কোনও একজন ওই তিনজনকে খুন করেছেন। দ্বিতীয়ত, দুই ভাই নিজেদের স্ত্রীদের নিজেরাই একে একে খুন করেছেন। আর নাবালিকা মেয়ে ঘুমের ওষুধ মেশানো পায়েস খেয়ে আধমরা হয়ে যায়। তাকে শ্বাসরোধ করে মারা হয়েছে বলে অনুমান করা হচ্ছে। তিনজনকে খুনের পর তাঁরা গাড়ি নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান।
তদন্তে জানা গিয়েছে, সোমবার রাতে খাওয়া হয়েছিল ওষুধ মিশ্রিত পায়েস। ওষুধের গন্ধ দূর করতে ব্যবহার করা হয়েছিল তুলসি পাতা। তাহলে কি বাড়ির মহিলা সদস্যরা পায়েস খেতে রাজি ছিলেন না? প্রশ্ন এখানেও। অন্যদিকে জেরার মুখে দুই ভাই সকলে মিলে পায়েস খাওয়ার কথা জানালেও তাঁরা আদৌ পায়েস খেয়েছিলেন কিনা, তা এখনও পরিষ্কার নয় তদন্তকারীদের কাছে। যদিও ময়নাতদন্তের প্রাথমিক রিপোর্টে দে বাড়ির দুই বধূর পেটে পায়েসের অস্তিত্ব মেলেনি বলেই জানিয়েছে পুলিশ। তাহলে কি দুই বউ পায়েস খাননি? প্রশ্ন এখানেও।
অন্যদিকে তদন্তে উঠে এসেছে প্রমাণ লোপাটের মতো গুরুতর অভিযোগও।
সূত্রের খবর, দে বাড়ির পায়েসে সেদিন কী ধরনের ওষুধ মিশিয়েছিলেন দুই ভাই তার প্রমাণ লোপাট করতে গিয়ে দেওয়া হয়েছিল ওষুধের পুরো পাতা। আরও জানা গিয়েছে, খুনের পর রক্তমাখা পোশাক বদলে জল দিয়ে ধুয়েও ফেলেছিলেন দুই ভাই। গত বুধবার ট্যাংরার ২১/সি অতুল শূর লেনের চারতলা বাড়ি ‘চিত্তনিবাস’ থেকে উদ্ধার হয়েছিল রোমি দে, সুদেষ্ণা দে এবং প্রসূণ দে-র বছর চোদ্দর নাবালিকা কন্যার দেহ। ময়নাতদন্তের প্রাথমিক রিপোর্ট অনুযায়ী, বাড়ির তিন সদস্যের মৃত্যু ঘটেছিল মঙ্গলবার দুপুর থেকে বিকেলের মধ্যে। অর্থাৎ সেই সময় বাড়িতেই ছিলেন দে ভাইয়েরা। রাতে বাড়ি থেকে গাড়ি নিয়ে বেরোলেও মোবাইল রাখা ছিল বাড়িতেই। কিন্তু কেন? সেই প্রশ্নও দানা বাঁধছে পুলিশকর্তাদের মনে। তদন্তে আরও জানা গিয়েছে, শুধু পিলারে ধাক্কা মেরেই আত্মহত্যা করবেন সকলে শুধু এমন পরিকল্পনা ছিল না তাঁদের। একাধিকবার আত্মহত্যার পরিকল্পনা পরিবর্তনও করেন দুই ভাই।
উল্লেখ্য, বুধবার ভোর রাত থেকেই রুবির এক বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন দে বাড়ির দুই ভাই প্রসূন, প্রণয় এবং কিশোর। শনিবার বেসরকারি হাসপাতাল থেকে ছাড়া পান প্রণয় এবং তাঁর নাবালক পুত্র। যদিও ছোট ভাই প্রসূণের অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় তাঁকে বেসরকারি হাসপাতালেই রাখা হয়। এ দিকে পুলিশি জেরার মুখে রোমি এবং সুদেষ্ণার খুনি হিসেবে ভাই প্রসূণকেই দায়ী করেছেন দাদা প্রণয়। বাবার বয়ানের সঙ্গে সামঞ্জ্য রেখে কাকা প্রসূণকেই বাড়ির তিন সদস্যের মৃত্যুর জন্য দায়ী করেছে নাবালক। যদিও বাবা ছেলের কথা আদৌ সত্যি কিনা, তা যাচাই করে দেখা প্রয়োজন বলেই মনে করছেন তদন্তকারীরা।