শহর কলকাতায় ফের স্টিফেন কোর্টের স্মৃতি। মঙ্গলবার রাতে চিৎপুরে মেছুয়া বাজারের একটি হোটেলে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ১৪ জনের মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটল। আগুনে দগ্ধ হয়েছেন আরও প্রায় ১৩জন। প্রায় আট ঘন্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। এরপর এক এক করে মৃতদেহগুলি বের করে আনা সম্ভব হয়েছে। হোটেলে আগুন লাগার প্রকৃত কারণ খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে। এই ঘটনায় ওই হোটেলের দুই মালিক পলাতক। তাঁদের খোঁজে তল্লাশি শুরু হয়েছে। আটক করা হয়েছে হোটেলের এক ম্যানেজারকে। ঘটনার তদন্তে ইতিমধ্যেই সিট গঠন করেছে কলকাতা পুলিশ।
দমকল ও পুলিশের প্রাথমিক অনুমান, চার তলায় ইলেকট্রিক মিটার থেকে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। অগ্নিকাণ্ডের জেরে ওই হোটেল থেকে ধোঁয়া বেরতে থাকে। আর সেই ধোঁয়াতেই দমবন্ধ হয়ে মৃত্যু হয় ১৩ জনের। হোটেলের ছাদ থেকে ঝাঁপ দিয়ে মৃত্যু হয়েছে আরও একজনের। তদন্তে জানা গিয়েছে, ওই হোটেলে উপযুক্ত অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা ছিল না। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে যান কলকাতা পুরসভার মেয়র ফিরহাদ হাকিম এবং মন্ত্রী শশী পাঁজা। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই ঘটনার খবর নিয়েছেন। এবং দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি আহতদের উপযুক্ত চিকিৎসার জন্য গুরুত্ব আরোপ করেছেন। বড়বাজারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে দুঃখপ্রকাশ করে এক্স হ্যান্ডেলে পোস্ট করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি লিখলেন, “অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনা। রাতভর নজর রেখেছি। মৃতদের পরিবারের প্রতি আমাদের সমবেদনা, যাঁরা আহত, তাঁদের দ্রুত সুস্থতা কামনা করি।”
জানা গিয়েছে, মঙ্গলবার সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা নাগাদ জোড়াসাঁকোর চিৎপুর মোড়ের কাছে একটি ছ’তলা হোটেলে এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। মেছুয়ার ফল বাজার সংলগ্ন এলাকায় এই অগ্নিকাণ্ডের জেরে আগুন দ্রুত চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ওইসময় হোটেলে ৮৮ জন গেস্ট ছিলেন। আতঙ্কে তাঁদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। গোটা এলাকা ধোঁয়ায় ঢেকে যায়। হোটেলের ছাদে উঠে অনেকে ঝাঁপ দেন। একতলার ঘরে থাকা লোকজন প্রাণভয়ে রাস্তায় বেরিয়ে আসেন। হোটেলের ঘরে আটকে পড়েন আরও অনেকে।
এদিকে খবর পেয়ে দ্রুত ছুটে আসে দমকলবাহিনী। দমকলের ১১টি ইঞ্জিন যায় ঘটনাস্থলে। প্রথমে ঘটনাস্থলে যায় দমকলের পাঁচটি ইঞ্জিন। পরে দফায় দফায় আরও ছ’টি ইঞ্জিন পাঠানো হয়। চলে অগ্নিনির্বাপণের কাজ। সেই সঙ্গে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় শুরু হয় উদ্ধার কাজও। হাইড্রোলিক ল্যাডারের সাহায্যে ছাদে ওঠা প্রায় ২৫জন ব্যক্তিকে নামিয়ে আনা হয়। মৃত ১৪ জনের মধ্যে ১৩ জন আগুনের জেরে শ্বাস রুদ্ধ হয়ে মারা গিয়েছেন। আর প্রাণ বাঁচাতে দুই হোটেলকর্মী ঝাঁপ দিয়েছিলেন। আতঙ্কিত হয়ে চারতলা থেকে ঝাঁপ দিয়েছিলেন এই দুই ব্যক্তি। তাঁদের মধ্যে একজনের মৃত্যু হয়েছে। মৃতের নাম মনোজ পাসোয়ান। অপর কর্মী সঞ্জয় দাস গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তাঁর মাথায় যথেষ্ট আঘাত লেগেছে।
অগ্নিনির্বাপণের পর দমকলকর্মীরা দেখেন, ওই হোটেলের সিঁড়িতে অচৈতন্য অবস্থায় পড়ে রয়েছেন অনেকেই। এভাবে তিনতলা, চারতলা এবং পাঁচতলার সিঁড়ি থেকে অচৈতন্য অবস্থায় অনেককেই উদ্ধার করা হয়েছে। তাঁদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসকরা তাঁদের মৃত বলে ঘোষণা করেন। এইভাবে হোটেলের ভিতর থেকে মোট ১৩ জনের অগ্নিদগ্ধ দেহ উদ্ধার করে দমকল বিভাগ।
উল্লেখ্য, ছ’তলা ওই হোটেলের নীচে গ্যারেজ ও গুদাম ঘর, দোতালায় একটি ট্রান্সপোর্টের অফিস এবং তিনতলায় চলে একটি রেস্তরাঁ রয়েছে। চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ তলায় হোটেল রয়েছে। হোটেলের বাইরে থেকে ভিতরের দিকে ফায়ার ফাইটিং সিস্টেমের পাইপলাইন থাকলেও আগুন নেভানোর জন্য কোনও জলাধার প্রয়োজন, তার সঙ্গে পাইপলাইনের কোনও সংযোগ নেই। গোটা বিল্ডিংয়ে থাকা পাইপলাইনে স্প্রিং কলার সহ যাবতীয় মেশিনারি লাগানো নেই। স্বাভাবিকভাবেই অর্ধ-নির্মিত ফায়ার ফাইটিং ব্যবস্থা বিপদের সময় কাজে লাগেনি। পুলিশ গোটা ঘটনার তদন্ত শুরু করেছে।
কলকাতার বড় বাজার সংলগ্ন এলাকার এই ঘটনায় গভীর শোকপ্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তিনি মৃত ও আহতদের পরিবারের পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছেন। মৃতদের পরিবারকে ২ লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী। আহতদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করেছেন। আহতদের ৫০ হাজার টাকা করে আর্থিক সাহায্য দেওয়ার ঘোষণা করা হয়েছে। মৃতদের পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর জন্য প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী তথা রাজ্য বিজেপির সভাপতি সুকান্ত মজুমদার। তিনি দ্রুত এবং মানবিক পদক্ষেপের জন্য প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেছেন।