শোভন মণ্ডল
রঙের উৎসব হোলি। যা ভারতীয় সংস্কৃতির অন্যতম প্রধান উৎসবগুলোর মধ্যে একটি। আনন্দ, উচ্ছ্বাস, রঙের ছটায় মাতোয়ারা হয়ে ওঠে চারপাশ। কিন্তু এই উৎসব যখন নারীদের জন্য আতঙ্কের কারণ হয়ে ওঠে, তখন প্রশ্ন ওঠে, এই আনন্দ কি সত্যিই সবার জন্য?
প্রতি বছর হোলির সময় অনেক নারী শারীরিক ও মানসিক হয়রানির শিকার হন। জনবহুল স্থানে কিংবা গলির মোড়ে, অনেক জায়গায়ই তাঁদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গায়ে রং মাখানোর ঘটনা ঘটে। অনেক সময় অচেনা বা পরিচিত পুরুষরা ‘উৎসবের মজা’ নেওয়ার নামে এমন আচরণ করেন, যা নারী-নিরাপত্তার পরিপন্থী। রাস্তার মোড়ে মোড়ে যুবকদের দল হুল্লোড় করে। কেউ মদ্যপ অবস্থায় নারীদের দিকে ছুটে যায়, কেউবা কাদা বা জোর করে রং লাগানোর চেষ্টা করে। অথচ সমাজের বড় অংশ এটাকেই ‘মজা’ বা ‘উৎসবের অংশ’ বলে ধরে নেয়।
শুধু রাস্তায় নয়, অনেক সময় পারিবারিক বা বন্ধুবান্ধবদের মধ্যেও নারীরা অস্বস্তিকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হন। বিশেষ করে, হোলির দিন অনেক জায়গায় ‘ভাং’ নামক এক ধরনের নেশাযুক্ত পানীয় পান করার প্রবণতা বাড়ে| নারীদের ওপর এই ধরনের নেশাগ্রস্ত আচরণ এবং ইচ্ছার বিরুদ্ধে শারীরিক স্পর্শের ঘটনা প্রায়শই ঘটে থাকে| যা অনেক ক্ষেত্রেই তাঁদের অপমানিত করে।
নারী অধিকার কর্মীরা বলছেন, হোলির দিন নারীদের ‘না’ বলার অধিকার যেন হারিয়ে যায়। অনেকেই মনে করেন, এই দিনটিতে কাউকে রং লাগানোর অনুমতি পাওয়া মানেই সবকিছু মান্যতা দেওয়া। অথচ সম্মতির গুরুত্ব যে সবক্ষেত্রেই সমান তা যেন সমাজ ভুলে যায়। নারীদের জন্য এই উৎসবের দিনটিই হয়ে ওঠে এক অস্বস্তির উৎস। কেউ প্রতিবাদ করলে শুনতে হয়, ‘হোলিতে এগুলো একটু-আধটু হয়ই।’ অথচ, প্রশ্ন ওঠে, নারীদের জন্য উৎসবের সংজ্ঞা কি আলাদা?
প্রশাসন প্রতিবছরই বিভিন্ন নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নেয়। শহর জুড়ে বিশেষ পুলিশ টহল, মহিলা পুলিশ মোতায়েন, হেল্পলাইন নম্বর চালু করা হয়। কিন্তু বাস্তবে অনেক ক্ষেত্রেই এই ব্যবস্থাগুলো যথেষ্ট কার্যকর হয় না। অনেক নারীই তাঁদের ওপর হওয়া অপ্রীতিকর ঘটনার প্রতিবাদ করতে ভয় পান। কারণ তাঁদের মনে হয়, সমাজ তাঁদেরই দোষ দেবে। অনেকে বলেন, ‘হোলির দিন একটু বেশি হয়ে গেছে, তাতে কী?’ ফলে, অভিযোগ জানানোর ক্ষেত্রেও দ্বিধা কাজ করে।
কিন্তু ভারতে নারীদের নিরাপত্তার জন্য কঠোর আইন থাকলেও অনেকেই সেই সম্পর্কে সচেতন নন। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অনিলকুমার সিং শ্রীনাতের মতে, কোনও নারীর অনুমতি ছাড়া তাঁর গায়ে রঙের বেলুন ছোড়া, জোর করে রং লাগানো বা তাঁকে স্পর্শ করাও অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়। এমন কোনও ঘটনা ঘটলে অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে ৭ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে।
আইডিয়াজ ফর ইন্ডিয়া ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক সমীক্ষা বলছে, হোলির সময় নারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতার ঘটনা সাধারণ দিনের তুলনায় ১৭০ শতাংশ বৃদ্ধি পায়।
শুধু তাই নয়, ২০২২ সালে মেঘালয় হাইকোর্ট এক ঐতিহাসিক রায়ে জানিয়েছিল, নারীর অনুমতি ছাড়া পোশাকের উপর দিয়ে তাঁকে স্পর্শ করা হলেও সেটি যৌন হয়রানির পর্যায়ে পড়ে এবং গুরুতর অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। এছাড়া, যদি কেউ কোনও নারীর গায়ে রঙের বেলুন ছোড়ে এবং তা বিপজ্জনক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে, তবে সেটি হামলা হিসেবে গণ্য হবে। এমনকি, যদি বেলুনের আঘাতে কেউ আহত হন বা প্রাণ হারান, তবে সেটিকে ভারতীয় দণ্ডবিধির ২২৩, ১১৫(২) ও ১১৭(২) ধারা অনুযায়ী খুনের অপরাধ হিসেবে ধরা হতে পারে।
আইন অনুযায়ী, নারীদের সঙ্গে অশালীন আচরণ, অনুমতি ছাড়া স্পর্শ করা বা এমন কিছু করা যাতে তাঁদের সম্মানহানি ঘটে, তার জন্য ন্যূনতম ১ বছরের কারাদণ্ড এবং জরিমানা হতে পারে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এই ধরনের অভিযোগ জামিন-অযোগ্য। অর্থাৎ অভিযুক্তকে পুলিশ বিনা সমনেই গ্রেফতার করতে পারে।
শুধুমাত্র প্রশাসনের ব্যবস্থা যথেষ্ট নয়, সমাজকেও এগিয়ে আসতে হবে। পরিবারের মধ্যে থেকেই সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। ছোট থেকেই ছেলেদের শেখাতে হবে যে, সম্মতি ছাড়া কারও গায়ে রং লাগানো বা স্পর্শ করা উৎসবের অংশ হতে পারে না।
হোলি যদি সত্যিকারের সম্প্রীতির উৎসব হয়, তাহলে তা সবার জন্য নিরাপদ হওয়া উচিত। নারীদের জন্য এটি আতঙ্কের উৎসবে পরিণত না হয়ে, আনন্দের রঙে রঙিন হয়ে উঠবে কি? সেই জবাব খোঁজার দায়িত্ব আমাদের সবার।