শুভম বোস
উত্তর কলকাতার বনেদিয়ানার অন্যতম উজ্জ্বল নিদর্শন দর্জিপাড়ার মিত্র বাড়ির দুর্গাপুজো। প্রায় আড়াই শতাব্দী ধরে সাবেকি আভিজাত্য, প্রাচীন রীতিনীতি আর আন্তরিকতাকে সঙ্গী করে এই বাড়ি আজও বাঁচিয়ে রেখেছে কলকাতার বনেদি পুজোর ঐতিহ্য। রাধানাথ মিত্রের উদ্যোগে শুরু হওয়া এই পুজো আজও শহরবাসীর কাছে বিশেষ আকর্ষণ।
Advertisement
ইতিহাসের পাতায় চোখ বোলালে জানা যায়, মিত্র বাড়ির আদি পুরুষ জগন্নাথ প্রসাদ মিত্র ভাগ্যান্বেষণে আড়িয়াদহ থেকে সুতানুটি অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেন। পরিবারের উন্নতির সূচনা তাঁর নাতি দুর্গাচরণ মিত্রের হাত ধরে, যিনি নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার দরবারে জহরত ব্যবসায়ী ছিলেন। পরে রাধানাথ মিত্র এই পরিবারের প্রতিষ্ঠা করে শুরু করেন এই দুর্গোৎসবের।
Advertisement
কথিত আছে, এই পুজোর সাক্ষী ছিলেন লর্ড কর্নওয়ালিসও। কিংবদন্তি অনুযায়ী, এক সময় মা সারদা স্বয়ং এই পুজোর জন্য পরমান্ন রান্না করেছিলেন। সেই সূত্রে আজও সারদা মঠের সন্ন্যাসিনীরা নিয়মিত আসেন মিত্র বাড়ির পুজোয়। ব্যতিক্রমী রীতিনীতির আবেশ আজও মিত্র বাড়ির দুর্গাপুজো স্বাতন্ত্রতার দাবি রাখে।
মহিলাদের দ্বারা পরিচালিত এই বাড়ির সম্পূর্ণ পুজো। দুর্গা পুজোয় অন্যান্য জায়গায় সন্ধিপূজায় ১০৮ পদ্ম ব্যবহার হলেও এখানে ব্যবহৃত হয় ১০৮টি অপরাজিতা ফুল। অষ্টমীর সন্ধিপূজার সঙ্গে হয় কল্যাণী পুজোও।
এই বাড়ির পূজোর ইতিহাসে অন্যতম বস্তু হল ঝাঁড়খিলি পান। দেবীবরণের পর দেবীর হাতে ঝোলানো হয় ফুলের পাপড়ির আকারে সাজানো সুগন্ধি এই পান। দেবীর পাশাপাশি কার্তিক, গণেশ, লক্ষ্মী, সরস্বতীর হাতেও দেওয়া হয় এই পান।
এই বাড়ির ভোগের বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট রয়েছে। মিত্র বাড়ির খিচুড়ি প্রসাদ বিশেষভাবে বিখ্যাত। চালের উপরে থাকে রোদে শুকানো মুগডাল। নৈবেদ্যে থাকে মাখনের পদও।
সাবেকিয়ানায় আজও প্রতিমা নিরঞ্জন হয়। বিজয়া দশমীর প্রতিমা নিরঞ্জনেও পুরনো রীতি পালন করা হয়। এককালে প্রতিমা নিরঞ্জনের সময় নীলকণ্ঠ পাখি ওড়ানোর প্রথা ছিল। যদিও সময়ের সঙ্গে তা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। আজও বাড়ির পুরুষ সদস্যরা ধুতি পরে, ছড়ি হাতে দেবীকে কাঁধে করে নিয়ে গিয়ে গঙ্গায় নিরঞ্জন করেন, যা অতীতের স্মৃতিকে আজও প্রাণবন্ত করে তোলে।
আধুনিক থিমের মণ্ডপ ও আলোর ঝলকানির মাঝেও মিত্র বাড়ির ঠাকুরদালান জুড়ে প্রতি বছর শোনা যায় ঢাকের তালে উলুধ্বনি, দেখা মেলে ধুনুচি নাচ ও আন্তরিক অঞ্জলির আবেশ। পুরনো দিনের সেই বনেদিয়ানার গর্ব আজও মিত্র বাড়ির দুর্গোৎসবকে কলকাতার ঐতিহ্যমণ্ডিত পুজোগুলির মধ্যে এক স্বতন্ত্র মর্যাদা দেয়। দর্জিপাড়ার এই বনেদি বাড়ির পুজো কেবল উৎসব নয়, কলকাতার প্রাচীন সমাজ-সংস্কৃতি, সৌজন্য ও শ্রদ্ধার এক অমূল্য দলিল, যা প্রতি শরতে নতুন করে ছুঁয়ে যায় শহরবাসীর মন।
Advertisement



