লোকসভায় মঙ্গলবার পেশ হল গ্রামীণ রোজগার প্রকল্পের কাঠামোগত পরিবর্তন সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ বিল। কেন্দ্রের কৃষি ও গ্রামোন্নয়নমন্ত্রী শিবরাজ সিংহ চৌহান বিলটি পেশ করার সঙ্গে সঙ্গেই সংসদে শুরু হয় তুমুল হইচই। এত দিন যে প্রকল্পটি মহাত্মা গান্ধীর নামে পরিচিত ছিল, সেই নাম সরিয়ে নতুন পরিচয় দেওয়ার প্রস্তাব ঘিরেই মূলত বিরোধিতার ঝড় ওঠে সংসদে।
বিলে প্রস্তাব করা হয়েছে, এত দিনের ‘মহাত্মা গান্ধী জাতীয় গ্রামীণ রোজগার নিশ্চয়তা আইন, ২০০৫’-এর নাম বদলে রাখা হবে ‘বিকশিত ভারত— গ্যারান্টি ফর এমপ্লয়মেন্ট এন্ড লিভলিহুড মিশন (গ্রামীণ) বিল, ২০২৫ অর্থাৎ সংক্ষেপে ‘ভিবি-জিরামজি বিল’। একই সঙ্গে প্রকল্পে কাজের ন্যূনতম মেয়াদ বছরে ১০০ দিন থেকে বাড়িয়ে ১২৫ দিন করার কথাও বলা হয়েছে। কেন্দ্রের দাবি, ‘বিকশিত ভারত’-এর লক্ষ্যে পৌঁছনোর রূপরেখা মাথায় রেখেই গ্রামীণ উন্নয়নের এই নতুন কাঠামো তৈরির পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
Advertisement
কিন্তু প্রকল্পের নাম থেকে মহাত্মা গান্ধীর বাদ দেওয়াকে কেন্দ্র করেই বিরোধী শিবির বিষয়টিকে ‘নৈতিক ও আদর্শগত আঘাত’ বলে আখ্যা দিয়েছে। বিল পেশ হতেই বিরোধী সাংসদদের একাংশের হাতে গান্ধীর ছবি নিয়ে লোকসভার ওয়েলে নেমে বিক্ষোভ দেখান। সংসদ ভবনের বাইরে মকর দ্বারে কংগ্রেস সাংসদ প্রিয়ঙ্কা গান্ধীর নেতৃত্বে প্রতিবাদে শামিল হন একাধিক বিরোধী দলের সাংসদরা। সংসদ চত্বরে গান্ধীমূর্তির সামনেও চলতে থাকে অবস্থান বিক্ষোভ।
Advertisement
এদিকে তিরুঅনন্তপুরমের কংগ্রেস সাংসদ শশী থারুর এই নামবদলের তীব্র সমালোচনা করে বলেন, ‘এটা কেবল প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নয়। গ্রামীণ উন্নয়নের যে নৈতিক দর্শন মহাত্মা গান্ধী তুলে ধরেছিলেন, এই পরিবর্তনে তার ভিত্তিই নড়ে যাচ্ছে।’ তাঁর মতে, গান্ধীর নাম সরালে প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য ও ভাবনাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
বিরোধীদের অভিযোগ খারিজ করে শিবরাজ সিংহ চৌহানের বক্তব্য, সরকার গান্ধীর আদর্শ মেনেই কাজ করছে। তাঁর দাবি, ‘মোদী সরকার মহাত্মা গান্ধীর পথ অনুসরণ করেই গ্রামীণ উন্নয়নে আগের যে কোনও সরকারের তুলনায় বেশি কাজ করেছে।’ বিরোধীদের উদ্দেশে তাঁর প্রশ্ন, ‘রামের নামে যদি আপত্তি না থাকে, তা হলে উন্নয়নমূলক প্রকল্পের নতুন নাম নিয়ে এত সমস্যা কোথায়?’
বিলে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, দেশের প্রতিটি গ্রামীণ পরিবারের সাবালক স্বেচ্ছাসেবককে এই প্রকল্পের আওতায় কাজ দেওয়ার লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। প্রতি অর্থবর্ষে প্রত্যেকে ১২৫ দিনের কাজ পাবেন বলে প্রস্তাব রাখা হয়েছে। তবে সবচেয়ে বড় বিতর্ক তৈরি হয়েছে অর্থ বরাদ্দের পদ্ধতি নিয়ে। এত দিন রাজ্য সরকার গ্রামে কাজের চাহিদা অনুযায়ী কেন্দ্রের কাছে অর্থ চাইত। নতুন বিলে সেই প্রক্রিয়া বদলে কেন্দ্র নিজস্ব মাপকাঠিতে রাজ্যভিত্তিক বরাদ্দ নির্ধারণ করবে। ফলে নতুন আইনে কাজের নিশ্চয়তা আদৌ আগের মতো থাকবে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বিরোধীরা।
এ ছাড়া নতুন কাঠামোয় মজুরির খরচের ৪০ শতাংশ রাজ্য সরকারকে বহন করতে হবে বলে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এত দিন যেখানে প্রকল্পের আর্থিক দায়ভার মূলত কেন্দ্রের উপর ছিল, সেখানে এই পরিবর্তনে রাজ্যগুলির উপর অতিরিক্ত চাপ বাড়বে বলেই আশঙ্কা। বিষয়টি নিয়ে বিরোধী দলগুলির পাশাপাশি মোদী সরকারের শরিক তেলুগু দেশমও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
তৃণমূল কংগ্রেসের দমদমের সাংসদ সৌগত রায় সংসদে বলেন, ‘দেশগঠনের ইতিহাসে মহাত্মা গান্ধীর অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই। তাঁর নাম মুছে ফেলা মানে সেই ইতিহাসকে ছোট করা।’ তিনি আরও অভিযোগ করেন, কেন্দ্রীয় বরাদ্দ ৯০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৬০ শতাংশে নামানো হচ্ছে, যার ফলে রাজ্যগুলির আর্থিক বোঝা বাড়বে। তাঁর সঙ্গে সুর মিলিয়ে একাধিক বিরোধী সাংসদ বিলটি সিলেক্ট কমিটিতে পাঠানোর দাবি তুলেছেন।
কংগ্রেস সাংসদ প্রিয়ঙ্কা গান্ধীর বক্তব্য, ‘এই আইন দেশের প্রান্তিকতম মানুষের জন্য। সর্বসম্মতিতে এই আইন পাশ হয়েছিল বলেই তার শক্তি ছিল। সব প্রকল্পের নাম বদলানোর এই প্রবণতার পিছনে আসলে কী উদ্দেশ্য কাজ করছে, তা প্রশ্নের মুখে।’ বিরোধীদের পক্ষ থেকে স্পষ্ট করে জানানো হয়, ‘রামের নামে কোনও আপত্তি নেই, কিন্তু মহাত্মা গান্ধীকে অপমান করার অধিকার এই সরকারের নেই।’
তীব্র প্রতিবাদের মধ্যেই সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী কিরেন রিজিজু জানিয়ে দেন, বিরোধীরা যতই বিক্ষোভ দেখাক, সরকার এই বিল পাশ করানোর ব্যাপারে অনড়। এদিন এই বিতর্কিত বিল পেশের পর ওয়েলে নেমে বিক্ষোভ ও ওয়াকআউটের মধ্য দিয়ে লোকসভায় দিনভর উত্তেজনা লক্ষ্য করা যায়।
Advertisement



