এনসিপি’র প্রশংসায় পঞ্চমুখ প্রধানমন্ত্রী মােদি

পােড় খাওয়া রাজনৈতিক মস্তিষ্কের ধার ফের প্রমাণ করে সংসদের শীতকালীন অধিবেশনে রীতিমতাে ঝড় তুলে এনসিপি দলের প্রশংসায় মুখর হলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মােদি।

Written by Supratik November 19, 2019 2:27 pm

শীতকালীন অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। (Photo: IANS/RSTV)

পােড় খাওয়া রাজনৈতিক মস্তিষ্কের ধার ফের প্রমাণ করে সংসদের শীতকালীন অধিবেশনে রীতিমতাে ঝড় তুলে এনসিপি দলের প্রশংসায় মুখর হলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মােদি- শুধু মস্তিষ্কের ধার নয়, টাইম ফ্যাক্টরকেও যথেষ্ট পর্যবেক্ষণ করে প্রধানমন্ত্রী ফের তাঁর বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন।

সংসদের শীতকালীন অধিবেশনের প্রথম দিনে রাজ্যসভার ২৫০তম অধিবেশন উপলক্ষ্যে বিশেষ বক্তব্য রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি দুটি রাজনৈতিক দলের প্রশংসা করতে চাই- এনসিপি ও বিজেডি। এই দুই দলের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা সংসদীয় নিয়মকানুনকে দারুণভাবে মেনে চলেছেন, যা শিক্ষণীয়। ন্যাশানালিস্ট কংগ্রেস পার্টি ও বিজেডি সাংসদরা কোনওদিন ওয়েলে নেমে প্রতিবাদ দেখাননি। তারা নিজেদের আসনে বসে মর্যাদা বজায় রেখে তাদের বক্তব্য স্পষ্ট করে জানিয়েছেন। বিজেপি সহ সবকটি রাজনৈতিক দলের এদের থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত’।

প্রধানমন্ত্রী মােদি এমন সময়ে এনসিপি’র প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলেন যখন খােদ এনসিপি নেতা শরদ পাওয়ার মহারাষ্ট্রে শিবসেনা ও কংগ্রেসকে নিয়ে সরকার গঠনের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। মহারাষ্ট্রে মুখ্যমন্ত্রী পদের সমানাধিকার নিয়ে শিবসেনা-বিজেপি ঠান্ডা যুদ্ধের মধ্যে ফায়দা তুলতে আসরে নেমে পড়েছিলেন শরদ পাওয়ার। হালে পানি টানতে সােনিয়া গান্ধির সঙ্গে বৈঠকও করেন। তবে শিবসেনাকে সমর্থন করার ব্যাপারে সােনিয়াকে তিনি বােঝাতে ব্যর্থ হওয়ায় মহারাষ্ট্রে সরকার গঠনের চেষ্টায় লাগাম টেনেছিলেন। কিন্তু ভারতীয় জনতা পার্টি সরকার গঠনে প্রয়ােজনীয় সংখ্যক সমর্থন না পাওয়ায় ব্যর্থতা স্বীকারের পর ফের প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠেন শরদ পাওয়ার।

দ্বিতীয় বার প্রাসঙ্গিকতার কেন্দ্রে এসে তিনি কংগ্রেস ও শিবসেনাকে নিয়ে অভিন্ন সাধারণ কর্মসূচীর ভিত্তিতে সরকার গঠনের লক্ষ্যে আলােচনা চালাচ্ছেন। শিবসেনা-বিজেপি জোট ভেঙে গেছে, এনডিএ থেকে সরে দাড়িয়েছে শিবসেনা- এই পরিস্থিতিতে সংসদের অধিবেশনের প্রথম দিনেই ন্যাশনালিস্ট কংগ্রেস পার্টির হয়ে গলা ফাটালেন খােদ প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলাের ওয়েলে নেমে প্রতিবাদ দেখানাের অভ্যেস থাকলেও ব্যতিক্রমও রয়েছে’।

উচ্চকক্ষে শিবসেনা সাংসদকে বিরােধী আসনে বসতে দেখা গেছে। প্রধানমন্ত্রীর এই ধরণের ব্যবহারে সন্দিহান এনসিপি নেতারা কানাঘুষাে জল্পনা শুরু করেছেন- শিবসেনার সঙ্গে জোট না করার জন্য কেন্দ্রের চাপের মুখে পড়েছেন শরদ পাওয়ার। তাছাড়া এনসিপি নেতা অজিত পাওয়ার ও প্রফুল্ল প্যাটেল ইডি’র মামলায় ফেঁসে রয়েছেন।

পূর্ব প্রত্যাশামতােই আজ শীতকালীন অধিবেশন শুরুর দিনেই সংসদের উভয় কক্ষে সরকার পক্ষকে সম্পূর্ণ কোণঠাসা করে তুললেন সম্মিলিত বিরােধী পক্ষ। বিরােধী দলগুলি বলতে এতদিন যে দলগুলি ছিল তার সঙ্গে দোসর সুগ্রীবের মতাে যুক্ত হয় শিবসেনা। জোরালাে কানাঘুষাে- বিহারের লােক জনশক্তি পার্টিও শামিল হতে পারে নব কলেবরে বলিয়ান বিরােধী শিবিরে। আর এনডিএ শরিক বলতে বাদবাকি যে দলগুলি আছে, তারাও প্রায় প্রত্যেকে শাসক-কর্ণদার বিজেপির ওপরে নানাভাবে ক্ষুব্ধ এবং সেই কারণে আজ অধিবেশনের প্রথম দিনেই তাদের দেহজ ভাষা থেকে যথেষ্ট স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে শিবসেনা কিংবা লােক জনশক্তি পার্টির মতাে তারা এখনই প্রকাশ্য বিদ্রোহে শামিল না হলেও বিজেপির, বিশেষ করে নরেন্দ্র মােদি ও অমিত শাহ জুটির একটার পর একটা বিতর্কিত পদক্ষেপের ব্যাপারে বিরােধী পক্ষের আক্রমণ থেকে সরকার পক্ষকে বাঁচাতে তারা আর আগের মতাে ঝাপিয়ে পড়তে রাজি নন।

তাই আজ যখন লােকসভা ও রাজ্যসভা উভয় কক্ষেই বিরােধী পক্ষের তুখােড় বক্তারা আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে সরকারকে তুলােধনা করতে থাকেন, তখন একবারের জন্যও সেই পুরনাে পরিচিত দৃশ্যের দেখা মেলেনি, যেখানে শাসক দলের সাংসদরা প্রবল চিৎকার চেঁচামেচি করে বিরােধী পক্ষের বক্তার বক্তব্যকে নস্যাৎ করে দিচ্ছেন।

এদিন কাশ্মীর নিয়ে মােদি সরকারকে নিশানা করেন লােকসভায় কংগ্রেস তাে অধীর চৌধুরি। পাশাপশি তিনি গান্ধি পরিবারের নিরাপত্তা কমিয়ে দেওয়া নিয়েও সরকার পক্ষের তুমুল সমালােচনা করেন। তাঁর বক্তব্যের সময় একদিকে যেমন বিরােধী পক্ষের সদস্যরা টেবিল চাপড়ে তাঁকে অভিনন্দন জানিয়েছেন, অন্যদিকে সরকার পক্ষের নেতাদেরও দিশেহারা অবস্থায় চুপ করেই বসে থাকতে দেখা গিয়েছে। অধিবেশনের শুরু থেকেই কাশ্মীর ইস্যু নিয়ে সােচ্চার হন এনসিপি-ডিএমকে নেতারাও।

অধিবেশনের শুরুতেই অধীর সরকারকে নিশানা করে বলেন, ১০৮ দিন বন্দি হয়ে রয়েছেন ফারুক আবদুল্লাহ। অথচ আগস্টে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেছিলেন, তাঁকে গ্রেফতারই করা হয়নি। এখন ফারুক আবদুল্লাকে মুক্তি দেওয়া হােক, এটা ওঁর সাংবিধানিক অধিকার। একই সঙ্গে পি চিদম্বরমের মুক্তির দাবিও তুলেছেন তিনি। শুধু অধীরই নন, অধিবেশনের শুরু থেকে ফারুক আবদুল্লাহর মুক্তির দাবিতে শুরু থেকেই সােচ্চার হন এনসিপি এবং ডিএমকে নেতারাও। তাঁরা বলেন, বিরােধীদের ওপর হামলা বন্ধ হােক, আমরা বিচার চাই। এই দাবিতে স্পিকারের সামনে বসে বিক্ষোভও দেখান বিরােধী সাংসদরা।

জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা খারিজ করে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল ঘােষণা করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। এই ঘােষণার সময় থেকেই গৃহবন্দি রয়েছেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ফারুক আবদুল্লাহ। একই দাবিতে লােকসভা ত্যাগ করেন কংগ্রেস ও ন্যাশনাল কনফারেন্স সাংসদরা। পাশাপাশি, কাশ্মীর নিয়েও বিজেপিকে নিশানা করেছেন অধীর।

ইউরােপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি দলের উপত্যকা সফরের বিরুদ্ধে সােচ্চার কংগ্রেস সাংসদ বলেন, রাহুল গান্ধিকে পর্যন্ত শ্রীনগর থেকে ফেরত পঠিয়ে দেওয়া হল। তখন বিদেশি প্রতিনিধিদের আমন্ত্রণ করে কাশ্মীর ঘুরিয়ে আনছে সরকার। কাশ্মীর তাে আভ্যন্তরীণ বিষয় ছিল, এই সরকারই তাকে আন্তর্জাতিক বানিয়ে দিয়েছে।

এছাড়াও সােনিয়া-রাহুল-প্রিয়াঙ্কা গান্ধিকে এসপিজি কম্যান্ডাের পরিবর্তে জেড প্লাস নিরাপত্তা নিয়েও সরব হয়েছেন অধীর। অতীতে নিরাপত্তার ফাঁকের কারণেই যে ইন্দিরা ও রাজীব গান্ধির মৃত্যু হয়েছে, সে প্রসঙ্গ মনে করিয়ে দিয়ে সােনিয়া-রাহুলদের প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে লােকসভায় আশঙ্কা প্রকাশ করেন সংসদের নিম্নকক্ষে কংগ্রেসের দলনেতা। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ড. মনমােহন সিংয়ের নিরাপত্তা থেকেও এসপিজি কম্যান্ডাে সরিয়ে নিয়েছে কেন্দ্র। এদিন তা নিয়েও সরব হন অধীর।

তৃণমূলের সাংসদ সৌগত রায়ও এদিন বলেন, হয় সরকার ৮৩ বছরের ফারুক আবদুল্লাকে মুক্তি দিক, আর না হয় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সংসদে এসে সে ব্যাপারে বিবৃতি দিন। বিরােধিতায় পিছিয়ে নেই শিবসেনাও। মহারাষ্ট্রে সরকার গঠন নিয়ে বিজেপির সঙ্গে তাদের বিরােধিতা তুঙ্গে পৌঁছেছে। রাজ্যসভায় শিবসেনা সাংসদরা বিরােধী আসনে বসেছেন। সংসদে এবার মহারাষ্ট্রের কৃষকদের স্বার্থে সরকারের বিরােধিতায় সরব হয়েছেন তারা। প্রবল বর্ষণে মহারাষ্ট্রের কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, অথচ তারা পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ পাননি, এই অ্যাডজর্নমেন্ট মােশনের নােটিশ দিয়েছে শিবসেনা।

সংসদের শীতকালীন অধিবেশন চলবে ১৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত। এই অধিবেশনেই নাগরিকত্ব বিল আনতে চলেছে মােদি সরকার। আলােচ্য সূচিতে রাখা হযেছে নাগরিকত্ব বিল। এই বিলে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে আসা অমুসলিম অভিবাসীদের ভারতীয় নাগরিকত্ব দেওয়ার ব্যবস্থা করার কথা বলা হয়েছে। ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব বিল সংশােধন করে হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পার্সি, খ্রিস্টান বেআইনি অভিবাসীদের ভারতীয় নাগরিকত্ব পাওয়ার শর্ত শিথিল করা হচ্ছে।

চলতি নাগরিকত্ব আইনে ভারতীয় নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করলে আবেদনকারীদের ১৪ বছরের মধ্যে ১১ বছর ভারতে থাকতে হবে। তার মধ্যে শেষ ১২ মাস একটানা থাকতে হবে। সংশােধনীতে ১১ বছর কমিয়ে ৬ বছর করা হচ্ছে। তবে তিন প্রতিবেশী দেশ থেকে এলেই একমাত্র শর্ত কার্যকর হবে। তেমনই নির্দিষ্টভাবে মুসলিম অভিবাসীরা এই সুযােগ পাবেন না। বর্তমান নিযমে ভারতে জন্ম, পিতামাতা ভারতীয় অথবা নির্দিষ্ট সময় ভারতে থাকা আবেদনকারীরা ভারতের নাগরিকত্ব পেতে পারেন। তবে বেআইনিভাবে আসা অভিবাসীরা এই সুযােগ পান না। বেআইনি বলতে বােঝানাে হয়, যাঁরা পাসপাের্ট-ভিসার মতাে বৈধ নথি ছাড়াই ভারতে ঢুকেছেন। অথবা বৈধ নথি নিয় ঢুকলেও নির্দিষ্ট সময়ের বেশি ভারতে থেকে গেছেন।

এদিকে বিরােধীরা সরব হবেন আর্থিক ঝিমনি, বেকারত্ব, কৃষি সংকটের মতাে বিষয়গুলি নিয়ে। অধিবেশনের আগে সর্বদলীয় বৈঠকেই তার ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছেন বিরােধী নেতারা। তাদের দাবি, এ নিয়ে আলােচনায় সরকারকে জবাবদিহি করতে হবে। সেখানেই না থেমে আগামী বছরের গােড়ার দিকে বিরােধী দলগুলি দেশজুড়ে ধমর্ঘটের ডাকও দিতে পারে। এ নিয়ে বাম-কংগ্রেসের সঙ্গে অন্যান্য দলগুলির আলােচনা শুরু হয়েছে। সূত্রধরের ভূমিকায় রয়েছে সিপিআই (এম)। সংঘ পরিবারের শ্রমিক সংগঠন বিএমএস বাদে বাকি ১০টি কেন্দ্রীয় শ্রমিক সংগঠন আগামী ৮ জানুয়ারি দেশে ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে। এর মধ্যে কংগ্রেস, বাম সহ সব শ্রমিকসংগঠন আছে। সিপিআই (এম) চাইছে ওই ধর্মঘটকে শ্রমিক ধর্মঘঁটের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে রাজনৈতিক দলের ধর্মঘটে রূপান্তরিত করতে। ফলে আজ থেকে সংসদের শীতকালীন অধিবেশনে রুটি রুজির সমস্যাকেই মােদি সরকারের বিরুদ্ধে প্রধান হাতিয়ার করেছে বিরােধী দলগুলি।

বিরােধীদের যুক্তি- জাতীয়তাবাদ, সাম্প্রদায়িকতাবাদের মতাে বিষয়গুলিকে সামনে এনে অর্থনীতি, রুটি রুজির সমস্যাকে আড়াল করার কৌশল নিয়েছে বিজেপি। নাগরিকত্ব বিল এর আগেও লােকসভায় পেশ হয়েছে। ২০১৬-র ১৯ জুলাই বিলটি লােকসভায় পেশ হয়েছিল। বিল যৌথ সংসদীয় কমিটির কাছে পাঠানাে হয়। ২০১৯-র জানুয়ারি কমিটি তাদের রিপাের্ট দেয়। পরদিনই ওই বিল লােকসভায় পেশ করিয়ে গরিষ্ঠতার জেরে পাশ করিয়ে নিয়েছিল বিজেপি সরকার। কিন্তু রাজ্যসভায় বিলটি পাশ করানাে যায়নি। সংসদে বিরােধিতা ছাড়াও উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলিতে এই বিলের বিরুদ্ধে বড় বিক্ষোভ হওয়ায় সরকার গতি শ্লথ করতে বাধ্য হয়েছিল।