লাদাখে মোদি

চিনকে কড়া বার্তা দিতেই রাজনাথের সফর বাতিল করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নিজেই পৌঁছলেন লাদাখে।

Written by SNS New Delhi | July 4, 2020 3:36 pm

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি (Photo: Twitter/BJP4India)

প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংয়ের শুক্রবার যাওয়ার কথা ছিল লাদাখ পরিদর্শনে। শেষ মুহূর্তে সেই কর্মসুচি বৃহস্পতিবার বাতিল হয়ে যায়। কিন্তু কেন শেষ মুহূর্তে রাজনাথ সিং’য়ের সফর বাতিল হল তা জানানো হয়নি। প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞরা মনে করেছিলেন, চিনের সঙ্গে আলোচনা প্রক্রিয়া এগোচ্ছে বলেই রাজনাথের সফর বাতিল করা হয়েছে।

ভারত সংঘাত চাইছে না বরং পরিস্থিতি যাতে প্রশমিত হয় এবং সামরিক তৎপরতা যাতে কমে, এই বার্তা দিতেই রাজনাথের সফর বাতিল করে দেওয়া হলে বলে কেউ কেউ ব্যাখ্যা করছিলেন। কিন্তু শুক্রবার সকালে এইসব ব্যাখ্যার আর কোনও প্রয়োজনীয়তা থাকল না। উল্টো চিনকে কড়া বার্তা দিতেই রাজনাথের সফর বাতিল করে প্রধানমন্ত্রী নিজেই পৌঁছলেন লাদাখে।

উল্লেখ্য, এলএসি’তে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হওয়ার পরে স্থলসেনা প্রধান মনোজ মুকুন্দ নারাভানে এবং বায়ুসেনা প্রধান আর কে এস ভদৌরিয়া আগেই লাদাখ ঘুরে এসেছিলেন। খতিয়ে দেখেছিলেন লাদাখের সামরিক প্রস্তুতি। আগ্রাসন হলে তার জবাব দিতে ভারত প্রস্তুত বলেও বাহিনীর তরফে জানানো হয়েছিল।

তবে, এর মধ্যে চিনের সঙ্গে আলোচনাও চলছিল, এমনই এক আবহের মধ্যে আচমকাই প্রধানমন্ত্রী লাদাখ পৌছনোয় ভারতের তরফে কৌশলগত বার্তাই অনেকখানি বদলে গেল, এমনটাই মনে করা হচ্ছে। প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশারদরা মনে করছেন, প্রধানমন্ত্রীর এই সীমান্ত সফর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ পরিস্থিতি অত্যন্ত গুরুতর না হলে কিংবা বড় কোনও পদক্ষেপের কথা ভানার মধ্যে না এলে প্রধানমন্ত্রী সাধারণত সীমান্ত চৌকিতে যাননি।

প্রধানমন্ত্রী এই আচমকা সীমান্ত সফর বাহিনীর মলে অনেকটা বাড়িয়ে দেবে বলে মনে করছেন প্রাক্তন সেনাকর্তারা। চিনের জন্যও এটা একটা কড়া বার্তা। একদিকে কৌশলগতভাবে আলোচনা চালিয়ে যাওয়া, অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রীর এই সফর জানান দিচ্ছে, আগ্রাসন হলে ভারত এবার যে কোনও পদক্ষেপের জন্য তৈরি।

এদিকে, প্রধানমন্ত্রীর দফতর বা প্রতিরক্ষা মন্ত্রক, কারও তরফ থেকে আগে থেকেই জানানো হয়নি যে প্রধানমন্ত্রী শুক্রবার লাদাখ যেতে পারেন। কিন্তু আচমকাই এদিন লাদাখে যান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। সেখানে গিয়ে তিনি বলেন, ‘দুর্বলরা নয়, শান্তির কথা বলতে পারে বীররাই।’

ভারতীয় সেনাদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আপনাদের রাগ এবং বীরত্ব শত্রুরা দেখে নিয়েছে।’ ভারতীয় সেনাদের এদিন প্রধানমন্ত্রী ‘দেশের মাটির বীর সেনা’ বলেও উল্লেখ করেন। ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রশংসা করে প্রধানমন্ত্রী আসলে চিনকে কড়া বার্তা পাঠালেন, এমনটাই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

গত ১৫ জুন লাদাখের গালোয়ান উপত্যকায় চিনের সঙ্গে সংঘর্ষে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ২০ জন জওয়ানের মৃত্যু হয়। এদিন ১১ হাজার ফুট উচ্চতায় লেহ-তে গিয়ে ভারতীয় সেনাবাহনী, বায়ুসেনা ও আইটিবিপি-র জওয়ানদের সঙ্গে কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। ভারতীয় সেনার সাহস ও দেশমাতৃকার প্রতি তাদের আত্মনিবেদনের কোনও তুলনা হয় না।

দেশের মধ্যে এবং দেশের বাইরে বসবাসকারী প্রত্যেক ভারতীয় একথা বিশ্বাস করেন যে, আপনারা দেশকে সুরক্ষিত রাখতে সক্ষম। আপনারা যে উচ্চতায় রয়েছেন, আপনাদের সাহসের উচ্চতা তার চেয়েও অনেক বেশি। যে পাহাড় আপনাদেরকে ঘিরে রেখেছে, আপনাদের হাত তার থেকেও শক্ত। আপনাদের আত্মবিশ্বাস ও আত্মনিবেদন অটল হয়ে বিরাজ করছে।

সেই সঙ্গে মোদি আরও বলেন, ‘যে প্রাকৃতিক পরিবেশে আপনারা এই অসম সাহসিকতার পরিচয় দিচ্ছেন তা সারা বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে কঠিন। আপনারা বারবার প্রমাণ করেছেন যে, ভারতীয় সেনাবাহিনীই পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে সাহসী এবং ক্ষমতাশালী।

এদিন সকালে যখন প্রধানমন্ত্রী নিমু পৌছন তখন প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানাতে ‘বন্দেমাতরম’ এবং ‘ভারত মাতা কি জয়’ স্লোগান ওঠে। এদিন প্রধানমন্ত্রীকে ঘিরে সেনাদের উচ্ছাসের একটি ভিডিও প্রকাশ করা হয়েছে। মোদির সঙ্গে চিফ অফ ডিফেন্স স্টাফ জেনারেল বিপিন রাওয়াত এবং স্থলবাহিনীর প্রধান মনোজ মুকুন্দ নারাভানে লাদাখ পৌছন।

এদিন প্রধানমন্ত্রী চপারে করে ১১ হাজার ফুট উচ্চতায় নিমুতে পৌঁছন। সেখানে একটি ক্যামোফ্লেজ টেন্টে বসে সেনাদের সঙ্গে কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। আর্মি ছাড়াও ভারতীয় বায়ুসেনা এবং ইন্দো-টিবেটান বর্ডার পুলিশও ছিল। সীমান্ত চৌকি থেকে সেনা হাসপাতাল, বাহিনীর কর্তা ও জওয়ানদের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে কথা বলা পরে নিমু’তে সামরিক সমাবেশে দাঁড়িয়ে চিনের নাম করে হুঁশিয়ারি, এই কিছুই ছিল এদিন প্রধানমন্ত্রীর কর্মসুচিরই অঙ্গ।

লাদাখ থেকে দেওয়া ভাষণে এদিন প্রধানমন্ত্রী বলেন গোটা পৃথিবীতে যখন ‘বিকাশবাদ’ প্রাসঙ্গিক তখন ‘বিস্তারবাদী’ চিন শান্তিভঙ্গ করছে। সব দেশ বিস্তারবাদের বিরুদ্ধে একজোট হয়েছে বলে মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী। ইতিহাস সাক্ষী, বিস্তারবাদীরা মুছে গিয়েছে পৃথিবী থেকে।

এদিন এমনও মন্তব্য শোনা গিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে। এই প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘যার মাথায় বিস্তারবাদের ভুত চাপে, সে শান্তি নষ্ট করে। বিস্তারবাদীরা শান্তির পক্ষে বিপজ্জনক। বিস্তারবাদের যুগ শেষ হয়ে গিয়েছে। ইতিহাস সাক্ষী এইসব শক্তি মুছে গিয়েছে অথবা নত হতে বাধ্য হয়েছে। আমরা হলাম সেই লোক, যারা বংশীধারী শ্রীকৃষ্ণের ধ্বজা ধরি। আবার সুদর্শনচক্রধারী শ্রীকৃষ্ণকেও আদর্শ মানি।’

গালওয়ান উপত্যকায় শহিদ ভারতীয় জওয়ানদের প্রতি এদিন শ্রদ্ধা জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘১৪ কোরের বীরত্বকাহিনী সবাই জানে। আপনাদের সঙ্কল্প এই উপত্যকার চেয়েও শক্ত।’ প্রধানমন্ত্রী এদিন আরও বার্তা দেন, ‘আমরা সবাই মিলে আত্মনির্ভর ভারত গড়ে তুলব। ভারতের স্বপ্ন পূরণে ১৩০ কোটি ভারতবাসীও পিছিয়ে থাকবে না। আপনারা সবাই মিলে, বিশেষ করে আপনারাই সীমান্তে দেশকে রক্ষা করছেন। আপনাদের কাছ থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে আমরা আরও কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করব।’

এদিন লাদাখে প্রধানমন্ত্রী পা রাখার পরেই চিনের তরফে সতর্ক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে চিন। সরাসরি মোদির লাদাখ সফর নিয়ে কিছু না বললেও এদিন চিনের বিদেশ মন্ত্রকে মুখপাত্র ঝাও লিজিয়ান জানান, ভারতের এমন কোনও পদক্ষেপ করা উচিত নয়, যাতে উত্তেজনা আরও বাড়ে।

লিজিয়ান বলেছেন, সেনাবাহিনী ও কুটনৈতিক পর্যায়ে সমঝোতা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাপমাত্রার পারদ কমানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। ভারত ও চিন কোনও পক্ষের এমন কোনও পদক্ষেপ করা উচিত হবে না, যাতে করে উত্তেজনা বাড়তে পারে।