• facebook
  • twitter
Saturday, 5 October, 2024

সম্পর্কে কাঁটা জালিয়ানওয়ালা

ক্ষমা নয়, এবারও শুধুই গতানুগতিক দুঃখপ্রকাশ। ১৯১৯ সালে অমৃতসরের জালিয়ানওয়ালাবাগের ইংরেজ সৈন্যদের সেই বর্বরতার, সেই অমানুষিকতার ১০০ বছর পূর্তি উপলক্ষে আশা করা গিয়েছিল বর্তমান ব্রিটিশ সরকার সেই ঘটনার জন্য ভারতবাসীর কাছে ক্ষমা চাইবে কিন্তু বর্বরতার সেই ১০০ বছর পরও, ব্রিটিশ সরকার ঘটনাকে 'দুঃখজনক' বলেই ছেড়ে দিলেন, যা সর্বস্তরের ভারতবাসীকে আঘাত দিয়েছে।

জালিয়ানওয়ালাবাগ স্মৃতিস্তম্ভ (Photo: IANS)

ক্ষমা নয়, এবারও শুধুই গতানুগতিক দুঃখপ্রকাশ। ১৯১৯ সালে অমৃতসরের জালিয়ানওয়ালাবাগের ইংরেজ সৈন্যদের সেই বর্বরতার, সেই অমানুষিকতার ১০০ বছর পূর্তি উপলক্ষে আশা করা গিয়েছিল বর্তমান ব্রিটিশ সরকার সেই ঘটনার জন্য ভারতবাসীর কাছে ক্ষমা চাইবে। এইদিনে এখানে রাউলাট আইন ও অমৃতসরবাসীর ওপর ইংরেজ সৈন্যের অকথ্য অত্যাচারের প্রতিবাদে প্রচুর মানুষ জড়াে হয়েছিলেন। তখন অতর্কিতে কোনও প্ররােচনা ছাড়াই ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর জেনারেল রেজিনাড ডায়ারের নির্দেশে নিরস্ত্র মানুষের উপর অবিরাম গুলিবর্ষণ করে গােরা ও বালুচ সৈন্যরা। মারা যান ১০০০-এর ওপর মানুষ, যা ইতিহাসের পাতায় ব্রিটিশ সেনাদের এক ‘বর্বরতম’ কাজের নিদর্শন বলে লেখা আছে।

কিছুদিন আগে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মে এক বিবৃতিতে জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডকে ব্রিটিশ ভারতের ইতিহাসে একটি ‘লজ্জাকর দাগ’ বলে অভিহিত করেছিলেন। হাউস অফ কমনসে কোনও কোনও বিরােধী সদস্য দাবি তুলেছিলেন, এবার সময় এসেছে এই হত্যাকাণ্ডের জন্য ক্ষমা চাওয়া। কিন্তু বর্বরতার সেই ১০০ বছর পরও, ব্রিটিশ সরকার ঘটনাকে ‘দুঃখজনক’ বলেই ছেড়ে দিলেন, যা সর্বস্তরের ভারতবাসীকে আঘাত দিয়েছে।

এইদিন অমৃতসরে ঘটনাস্থলে গিয়ে নিহতদের স্মরণে স্মারক সৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত শ্রদ্ধা জানান। দর্শনার্থীর খাতায় তিনি লেখেন, ‘জালিয়ানওয়ালাবাগে ১০০ বছর আগে যা ঘটেছিল তা ব্রিটিশ ভারতের ইতিহাসে এক লজ্জাজনক কাজের প্রতিফলন। এই ঘটনা এবং তাতে যে দুর্দশা তৈরি হয়েছিল, তার জন্য আমরা দুঃখিত।’ ভারত সহ পৃথিবীর অন্যান্য দেশ এই বর্বর কাজের জন্য ব্রিটিশ সেনাদের কঠোর ভাষায় নিন্দা করেন এবং এই অমানুষিক বর্বরতার শিকার হয়েছিলেন তাদের প্রতি দুঃখ ও সমবেদনা জানায়। ১৯২০ সালে জেনারেল ডায়ারের চাকরি যায়। কিন্তু তার কাজকে প্রশংসা করে ওই দেশের রক্ষণশীল কিছু সংবাদপত্র। এই নৃশংসতার প্রতিবাদে ভাইসরয়ের চেমসফোর্ডকে লেখা একটি চিঠিতে কবিণ্ডরু রবীন্দ্রনাথ ব্রিটিশের দেওয়া নাইট উপাধি ফিরিয়ে দিয়ে এক অভূতপূর্ব নজির সৃষ্টি করেন।

১৯৯৭ সালে রানি এলিজাবেথ, জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের স্থান পরিদর্শন করে আবেগমথিত কণ্ঠে বলেছিলেন, ব্রিটেনের সঙ্গে ভারতের ইতিহাসে একটি ‘ডিসট্রেসিং’ অধ্যায়। তিনিও এই ঘটনার জন্য দুঃখপ্রকাশ করে বলেছিলেন, এই লজ্জাকর ঘটনা সত্ত্বেও ভারতের সঙ্গে সম্পর্কে কোনও ছেদ পড়বে না। দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কে উন্নতি ঘটবে। সাংসদের মধ্যে যারা ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীকে ‘ফুল অ্যাপলজি’র জন্য চাপ দিচ্ছিলেন, তাদের মধ্যে শ্রমিক দলের ইলিং সাউথহল, বরেন্দ্র শর্মা রয়েছেন। তাঁরা বলেছে অ্যাপোলজিতে ‘অ্যাপােলজি ও দুঃখিত’ এই দুটি শব্দই থাকতে হবে। সাউথহল বলেছেন, তাঁর ইচ্ছে হাউসে এ ব্যাপারে একটি ‘মোশন’ তুলবেন, যা সমর্থন পাবে সদস্যদের।

অপরদিকে শ্রমিক দলের পিয়ার এবং খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ মেঘনাদ দেশাই জালিয়ানওয়ালাবাগের ওপর প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্যকে স্বতি জানিয়ে বলেছেন, তাঁর আশা ‘অ্যাপােলজি’ চাওয়ার ক্ষেত্রে অনেকটাই এগিয়েছেন তিনি। আশা করা যায় ‘ক্ষমা চাওয়া’ খুব দূরে নয়। তিনি মনে করেন ব্রিটিশ সরকার এ ব্যাপরে একধাপ এগােল।

একশাে বছর পরও দেশবাসী জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের কথা ভােলেননি। এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে ব্রিটেনে অনেক সরকার এসেছে গেছে- প্রতি বছরই এই ঘটনা নিয়ে অনেক চর্চা, অনেক কথা হয়েছে ইংরেজ মহলে। কিন্তু প্রতিটি ব্রিটিশ সরকার ওই পৈশাচিক ঘটনার নিন্দা করেছে, দুঃখপ্রকাশ করেছে গতানুগতিক কায়দায়। কিন্তু ভারতের কাছে এই অতি দুঃখজনক ঘটনার জন্য ক্ষমা চায়নি, যা ভারত সরকার চেয়েছিল। ভারতবাসীও চেয়েছিলেন। ইংরেজ সৈন্যরা নিরস্ত্র মানুষদের গুলি করে যেভাবে হত্যা করেছিল, তার নজির মেলা ভার। সেই ইতিহাসকে মুছে ফেলা যাবে না। ভারত-ব্রিটিশ সরকারের মধ্যে সম্পর্কে এই ঘটনা একটি কাটা হয়ে থাকবে। ব্রিটিশ সরকার জালিয়ানওয়ালাবাগের ঘটনা নিয়ে যদি ক্ষমা চাইত, তাহলে তাদের উদারতা ও মহত্বের প্রকাশই পেত। কিন্তু এখন সেই শুভ চেতনাবােধ জাগ্রত হল না ব্রিটিশ শাসককুলের।

ক্ষমা চাওয়া হলে কী কী অসুবিধে দেখা দিতে পারে তা নিয়েও বিশেষজ্ঞ মহলে অনেক কথা শােনা যায়। আইনি জটিলতা সৃষ্টি তাে হবেই, তাছাড়া নিহতদের পরিবার পিছু ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিষয়ও মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। তাই ব্রিটিশ সরকার ১০০ বছর পরও এই জালিয়ানওয়ালাবাগের কাণ্ডের জন্য দুঃখপ্রকাশ করেই কর্তব্য শেষ করতে চায়। মেঘনাদ দেশাই অবশ্য আশাবাদী যে প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মে শুধু দুঃখপ্রকাশ করেই স্বস্তি পাচ্ছেন না। সুতরাং তার আশা আপােলজি আসবে।