‘অপারেশন সিঁদুর’! পহেলগামে জঙ্গি হামলার প্রত্যাঘাতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অভিযানের শিরোনাম হিসেবে এই ‘শব্দবন্ধ’টি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। নৃশংস এই হামলার জেরে ভারতের বহু নারীর কপালের সিঁদুর মুছে গিয়েছে। আর তার বদলা হিসেবে ভারত সরকার মঙ্গলবার গভীর রাতে ‘অপারেশন সিঁদুর’ অভিযান মৃতদের আত্মাকেই শুধু শান্তি দিল না, সেই সঙ্গে তাঁদের স্ত্রীদের মুছে যাওয়া ‘সিঁদুর’-এর প্রকৃত মর্যাদা দেওয়া হল, যা ভারতীয় ও হিন্দু সংস্কৃতিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এই সফল ‘অপারেশন সিঁদুর’ কীভাবে সম্ভব হল, তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর দুই মহিলা সেনা আধিকারিক কর্নেল সোফিয়া কুরেশি ও উইং কমান্ডার ব্যোমিকা সিং।
তাঁরা বলেন, ‘দীর্ঘ দিন ধরে পাকিস্তান সন্ত্রাসবাদকে মদত দিচ্ছে। সেজন্য পাকিস্তানের মোট ন’টি ঘাঁটিকে নিশানা করা হয়। সেগুলিকে পুরো গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।’ এরপরই ব্যোমিকা ও সোফিয়ারা কোথায় কোথায় কেন হামলা চালানো হয়েছে, তার তালিকা দেন। তাঁরা জানিয়েছেন, ‘অপারেশন সিঁদুর’-এ পাক সেনাঘাঁটি বা সাধারণ কোনও নাগরিককে নিশানা করা হয়নি। তাঁরা বলেন, ‘এখনও পর্যন্ত কোনও সাধারণ নাগরিকের ক্ষতি করা হয়নি। নির্দিষ্ট ভাবে কিছু বিল্ডিংয়ে হামলা হয়েছে। পাকিস্তানের সেনা ঘাঁটিতে কোনও হামলা হয়নি। প্রযুক্তির সাহায্যে ওই ভবনগুলি ভাঙা হয়েছে।’ মঙ্গলবার গভীর রাতের এই নিঃশব্দ হামলায় একে একে পাকিস্তান ও পাক অধিকৃত কাশ্মীরের বিলাল, কোটলি, গুলপুর, বার্নালা ক্যাম্প, আব্বাস ক্যাম্প, সার্জাল ক্যাম্প- শিয়ালকোট, মেহমুনা ক্যাম্প- শিয়ালকোট, মার্কাজ তইবা মুরিদকে ও ভাওয়ালপুর- জইশ-ই মহম্মদের মূল কার্যালয় দুরমুশ করে দেওয়া হয়েছে।
জানা গিয়েছে, মাত্র ২৫ মিনিটে ৯টি জঙ্গি ঘাঁটিতে ২৪ বার আঘাত হানে ভারতীয় সেনাবাহিনী। পাক অধিকৃত কাশ্মীর ও পাক পাঞ্জাবের জঙ্গিঘাঁটি গুঁড়িয়ে দেয় ভারতীয় সেনা। মঙ্গলবার রাতে সেই ‘অপারেশন সিঁদুর’ অভিযানে অন্তত ৭০ জন জঙ্গির মৃত্যু হয়েছে বলে সূত্রের দাবি। ভারতীয় গোয়েন্দা সূত্রের খবর, বিভিন্ন প্রযুক্তির ব্যবহার ও প্রচুর সূত্র কাজে লাগিয়ে ন’টি জঙ্গি ঘাঁটি চিহ্নিত করে ভারতীয় গুপ্তচর সংস্থা। সেই ‘ইনপুট’ যায় সেনাবাহিনীর কাছে। এরপর ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর প্রস্তুতি শুরু হয়। মঙ্গলবার গভীর রাতে শুরু হয় প্রত্যাঘাত। আর এই অতর্কিত হামলায় ব্যবহার করা হয় স্ক্যাল্প ও হ্যামার মিসাইলের মতো বিশেষ গোলাবারুদ।
ব্যোমিকা ও সোফিয়াদের তালিকা অনুযায়ী, ভারতীয় সেনা বাহিনীর প্রথম নিশানা ছিল লস্কর-এ-তৈবার অন্যতম জঙ্গি শুভান আল্লাহ মসজিদ। সেখানে এই জঙ্গি গোষ্ঠীর ঘাঁটি ও প্রশিক্ষণ শিবির রয়েছে। এছাড়া বিলাল মসজিদেও ছিল আরও এক কুখ্যাত জঙ্গি গোষ্ঠী জইশ-ই-মহম্মদের প্রশিক্ষণ শিবির। আবার কোটলিতে যে মসজিদে হামলা হয়েছে, সেটাও লশকরের ঘাঁটি। এগুলি পাক অধিকৃত কাশ্মীরে রয়েছে। এই ঘাঁটিগুলি কাশ্মীরের পুঞ্চে সক্রিয় ছিল।
ব্যোমিকা, সোফিয়ারা জানান, পাকিস্তানের ভিতরে শিয়ালকোটের সার্জাল ক্যাম্পে হামলা চালানো হয়েছে। আন্তর্জাতিক সীমানা থেকে তা প্রায় ছয় কিলোমিটার দূরে। এ ছাড়া মেহমুনা জোয়া জঙ্গি শিবিরেও হামলা হয়েছে। সেখানে হিজ়বুলের শিবির ছিল। এখান থেকেই পঠানকোটে হামলা চালানো হয়। এছাড়া ভারতীয় সেনা বাহিনী বাহিনী মুরিদকের মারকাজ় তৈবায় হামলা চালিয়েছে। এখান থেকেই ২৬/১১ মুম্বই হামলায় জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। এখান থেকেই উঠে আসে আজ়মল কসাব।
উল্লেখ্য, বুধবার ভারতের বিদেশ সচিব বিক্রম মিস্রি বলেন, ‘পাকিস্তান সন্ত্রাসবাদে মদত দেয়। জেনে শুনে সেই দেশে লুকিয়ে রাখা হয় সন্ত্রাসবাদীদের। পহেলগামের হামলার পর দেশের নানা প্রান্তে বিক্ষোভ দেখা দিয়েছিল। স্বাভাবিক ভাবেই তার পর ভারত সরকার কিছু পদক্ষেপ করে। কিন্তু তারপরেও পহেলগামের ঘটনার জন্য পাকিস্তান সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ করেনি। উল্টে ঘটনার সঙ্গে পাক যোগ অস্বীকার করছে। আমাদের কাছে খবর ছিল, ভারতের বিরুদ্ধে আগামী দিনেও হামলা হতে পারে। তাই এই প্রত্যাঘাত আবশ্যক ছিল। ভারত নিজেদের অধিকার প্রয়োগ করেছে জবাব দিতে। সন্ত্রাসবাদের কাঠামোকে ধ্বংস করতেই এই হামলা। রাষ্ট্রপুঞ্জ গত ২৫ এপ্রিল পহেলগাঁওয়ের হামলার নিন্দা করে বলেছিল ন্যায়বিচার দরকার। ভারতের প্রত্যাঘাত তার ভিত্তিতেই।’