গুজরাতের আহমেদাবাদে ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনা। প্রায় ২৪২ জন যাত্রী নিয়ে লন্ডনে যাওয়ার পথে আচমকা আহমেদাবাদের মেঘানিনগরে ভেঙে পড়ে বিমানটি। সেখানে ছিল বিজে মেডিক্যাল কলেজের হস্টেল। হস্টেলের ক্যান্টিনে তখন দুপুরের খাবার খাচ্ছিলেন জুনিয়র চিকিৎসকরা। তার উপরেই ভেঙে পড়ে বিমানটি। দুর্ঘটনার সময় ঘটে ভয়াবহ বিস্ফোরণ। মুহূর্তে শূণ্যের দিকে আগুনের গোলা ভেসে উঠতে দেখা যায়। চারিদিক কালো ধোঁয়ায় ভরে যায়। এই দুর্ঘটনায় মৃতের সংখ্যা নিয়ে প্রথমে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম বিভিন্ন সংখ্যা প্রকাশ করলেও পরে জানা যায়, বিমানে থাকা ২৩০ জন যাত্রী এবং ২ পাইলট ও ১০ কেবিন ক্রু মিলিয়ে মোট ২৪১ জনের সকলেরই মৃত্যু হয়েছে। মৃতদের মধ্যে ১৬৯ জন ভারতীয়, ৫৩ জন ব্রিটিশ, ৭ জন পর্তুগিজ এবং ১জন কানাডিয়ান নাগরিক ছিলেন বলে জানা গিয়েছে। বিমানে ১১টি শিশুও যাত্রীদের তালিকায় ছিল। পাশাপাশি এই দুর্ঘটনার কবলে পড়ে হস্টেলের প্রায় ২০ জন জুনিয়র চিকিৎসকের মৃত্যু হয়েছে, এমনটাই আশঙ্কা করা হচ্ছে।
কপাল জোরে বেঁচে গিয়েছেন একজন যাত্রী। ১১এ আসনের ওই যাত্রী বর্তমানে হাসপাতালে ভর্তি। তাঁর চিকিৎসা চলছে। যাত্রী তালিকা ঘেঁটে দেখা গিয়েছে, ওই যাত্রীর নাম বিশ্বকুমার রমেশ। তাঁর থেকে ঘটনার বিস্তারিত তথ্য জানার চেষ্টা করছেন তদন্তকারীরা।
এদিকে আরও চাঞ্চল্যকর খবর হল, এই বিমানের যাত্রী তালিকায় ছিলেন গুজরাতের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বিজয় রূপাণী। বিমান দুর্ঘটনার পর রূপাণীর নাম সামনে আসতেই তাঁর খোঁজ শুরু হয়। তারপর জানা যায়, তিনি ওই বিমানেই সওয়ারি ছিলেন। পরে গুজরাত পুলিশের ডিজি রূপাণী ঘনিষ্ঠদের মৃত্যুর খবর জানিয়ে দিয়েছেন। যদিও রূপাণীর মৃত্যুর খবর বৃহস্পতিবার সন্ধ্যাতেও সরকারিভাবে ঘোষণা করা হয়নি। ঘনিষ্ঠ মহল সূ্ত্রে জানা গিয়েছে, রূপাণীর এক ছেলে এবং এক মেয়ে। ছেলে আমেরিকায় থাকেন। আর মেয়ে লন্ডনে। কয়েক দিন আগেই সেখানে গিয়েছিলেন রূপাণীর স্ত্রী। বৃহস্পতিবার রূপাণীর যাওয়ার কথা ছিল। আগামী ১ জুলাইয়ে স্বামী-স্ত্রীর একসঙ্গে লন্ডন থেকে ফেরার কথা ছিল।
গুজরাতে অহমদাবাদের সর্দার বল্লভভাই পটেল বিমানবন্দর থেকে যাত্রা শুরুর দু-তিন মিনিটের মধ্যেই ভেঙে পড়ে লন্ডনগামী বিমানটি। উপগ্রহ চিত্র পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, বিমানটি দুপুর ১টা ৩০ নাগাদ রানওয়েতেই ছিল। দুপুর ১টা ৩৮ মিনিট নাগাদ রানওয়ের শেষ প্রান্ত ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল ছিল বিমানটি। তখনও বিমানের সঙ্গে এয়ার ট্র্যাফিক কন্ট্রোল (এটিসি)-এর যোগাযোগ ছিল। এরপর দুপুর ১টা ৩৯ মিনিট নাগাদ বিমানবন্দর ছেড়ে বেরিয়ে যায় এআই ১৭১। তখনও বিমানের সঙ্গে এটিসির যোগাযোগ ছিল। পাইলট বিপদসঙ্কেত পাঠান এটিসি-কে। কয়েক সেকেন্ডে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। বিমান তখন ৬২৫ ফুট উপরে। মিনিটে ৪০০ ফুট গতিতে নিচে নামতে থাকে। দুপুর ১টা ৪০ মিনিটে মেঘানিনগরে বিমানটি ভেঙে পড়ে।
যদিও ফ্লাইটরাডার২৪-এর তথ্য অনুযায়ী, বিমানটি যখন সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৬৫০ ফুট উপরে ছিল, সেই সময়েই সেটি দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। এর পরেই বিমানটি মিনিটে ৪০০ ফুট গতিতে নীচে নেমে আসতে থাকে।
অসামরিক বিমান পরিবহণ নিয়ন্ত্রক সংস্থা (ডিজিসিএ) জানিয়েছে, বিমানটিতে ২৪২ জন ছিলেন। তাঁদের মধ্যে ২৩০ জন যাত্রী এবং ১২ জন বিমানকর্মী। ঘটনার একটি ভিডিয়ো প্রকাশ্যে এসেছে (যদিও সেটির সত্যতা যাচাই করেনি দৈনিক স্টেটসম্যান)। ভাইরাল হওয়া সেই ভিডিও-তে দেখা যাচ্ছে, ওড়ার কিছুক্ষণ পরেই বিমানের লেজের অংশটি নীচের দিকে নামতে নামতে হঠাৎ মাটিতে ভেঙে পড়ে। উড়তে শুরু করার পর হঠাৎই বিমানটি বাঁ দিকে বাঁকতে শুরু করে। উপরে ওঠার পরিবর্তে তা নীচের দিকে নামতে শুরু করে। পরমুহূর্তেই তা ভেঙে পড়ে যায়। এর পরেই সেটির পিছনের দিকটি নীচের দিকে নেমে গিয়ে বিমানবন্দর চত্বরের ভিতরে ‘জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেন্টার’ নামক একটি বহুতলের উপর ভেঙে পড়ে। বিমানটি ভেঙে পড়েছে বিমানবন্দরের অদূরেই।
দেশের বেসামরিক বিমান পরিবহণ নিয়ন্ত্রক সংস্থা (ডিজিসিএ) জানিয়েছে, দুপুর ১টা ৩৯ মিনিটে বিমানটি রানওয়ে ছাড়ার পর পরই এটিসিকে ‘মে ডে কল’ করেন পাইলট। কিন্তু বিমানের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও আর জবাব পাওয়া যায়নি। ফ্লাইটরাডার২৪-এর তথ্য বলছে, যে বিমানটি ভেঙে পড়ছে সেটি ভিটি-এএনবি। বিমানটি এ দিনই দিল্লি থেকে আহমেদাবাদে আসে। তার পর সেটি লন্ডনের উদ্দেশে রওনা হয়। কিন্তু তার আগেই দুর্ঘটনার কবলে পড়ে।
কিন্তু কী এই ‘মে ডে কল’? বিমান পরিষেবার পরিভাষায় এই ‘মে ডে কল’-কে একটি ‘বিপদসঙ্কেত’ বলা হয়। আপৎকালীন পরিস্থিতিতে পাইলট যখন কোনও বিপদের আঁচ পান, তখন এই শব্দবন্ধটি ব্যবহার করেন। ফরাসি শব্দ ‘মেইডার’ থেকে ‘মে ডে’ শব্দটি এসেছে। যার অর্থ ‘আমাকে সাহায্য করুন’। সাধারণত এটিসি এবং ওই এটিসি-র আওতায় থাকা আকাশপথে কোনও বিমানের মধ্যে রেডিয়ো যোগাযোগকে ‘মে ডে কল’ বলে। এই শব্দবন্ধের মাধ্যমে দ্রুত সাহায্যের বার্তা পাঠানো হয়।
জানা গিয়েছে, এআই১৭১ নম্বরের এই বিমানটি দুপুর ১টা ১০ মিনিটে আহমেদাবাদের সর্দার বল্লভভাই পটেল বিমানবন্দর থেকে যাত্রা শুরু করে। বিমানটির মডেল বোয়িং ৭৮৭-৮ ড্রিমলাইনার বলে জানা গিয়েছে। সেটি লন্ডনে রওনা হওয়ার উদ্দেশ্যে আকাশে উড়তেই আহমেদাবাদ বিমানবন্দরের কাছেই লোকালয়ে ভেঙে পড়ে এয়ার ইন্ডিয়ার যাত্রিবাহী বিমানটি। ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে এলাকাটি কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলীতে ঢেকে যায়। দুর্ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে ঘটনাস্থলে যায় দমকলের ৭টি ইঞ্জিন। দ্রুত আগুন নেভানোর কাজ শুরু হয়। দুর্ঘটনায় আহতদের উদ্ধার করে চিকিৎসার জন্য স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। দুর্ঘটনার পর ঘটনাস্থল থেকে একের পর এক যাত্রীর ঝলসানো দেহ বের করে আনা হয়। এয়ার ইন্ডিয়া ও ডিরেক্টরেট জেনারেল অফ সিভিল এভিয়েশন (ডিজিসিএ) এই দুর্ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত শুরু করেছে। পাশাপাশি বিমানের ব্ল্যাকবক্স সংগ্রহের কাজও চলছে। দুর্ঘটনার পর আহমেদাবাদ বিমানবন্দর বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বাতিল করা হয়েছে একাধিক বিমান পরিষেবা।
সংবাদ সংস্থা এএনআই-এর খবর অনুযায়ী, ফ্লাইটটিতে ২৪২ জন যাত্রী ছিলেন। এ ছাড়া বহু মানুষের মৃত্যুর আশঙ্কা করা হচ্ছে। স্থানীয় সূত্রে খবর, বিমানটি ওড়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই সেটি ভেঙে পড়ে। ফলে সেটি বেশি উচ্চতায় পৌঁছতে পারেনি। অনেকেরই আশঙ্কা, লোকালয়ে থাকা অনেকেরই প্রাণহানি হতে পারে। আপাতত দুর্ঘটনাস্থলের আশপাশের সমস্ত রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। চলছে উদ্ধার কাজ। গান্ধিনগর থেকে জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর ৯০ জন সদস্যকে ইতিমধ্যেই পাঠানো হয়েছে দুর্ঘটনাস্থলে। ভদোদরা থেকে আরও ৯০ জনকে ঘটনাস্থলে পাঠানো হচ্ছে।
২ পাইলট, ১০ কেবিন ক্রু-সহ মোট ২৪২ জন ছিলেন ওই বিমানে। ডিজিসিএ-র তরফে জানানো হয়েছে, বিমান চালানোর দায়িত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন সুমিত সভরওয়াল। ঘটনার পর গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী ভূপেন্দ্র প্যাটেলকে ফোন করেছিলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। গুজরাট সরকারকে প্রয়োজনীয় সব ধরনের সাহায্য করার আশ্বাস দেন তিনি। এরপর সন্ধ্যার দিকে শাহ নিজেই আহমেদাবাদের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী ভূপেন্দ্র সিং প্যাটেল সামাজিক মাধ্যমে লেখেন, “অহমদাবাদে এয়ার ইন্ডিয়ার বিমান দুর্ঘটনায় আমি শোকাহত। আমি প্রশাসনিক আধিকারিকদের দ্রুত উদ্ধারকাজ শুরু করার নির্দেশ দিয়েছি। যুদ্ধকালীন তৎপরতায় আহতদের চিকিৎসা করারও নির্দেশ দিয়েছি।”
আমদাবাদের ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনায় দুঃখপ্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ইতিমধ্যেই গুজরাত সরকারের সঙ্গে কথা বলেছে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর। অমিত শাহের পর প্রধানমন্ত্রীও রওনা দেন আহমেদাবাদের উদ্দেশে। ভারতের বিমান দুর্ঘটনায় বিশ্বজুড়ে উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে। পাশে থাকার বার্তা দিয়েছে প্রতিবেশী চিনও।
এছাড়াও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় , তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়, লোকসভার বিরোধী দলনেতা তথা কংগ্রেস সাংসদ রাহুল গান্ধী, রাজ্যসভার সাংসদ সনিয়া গান্ধী-সহ অনেকেই এই দুর্ঘটনা নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেছেন।
তৃণমূলের সর্ব ভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এই ঘটনার স্বচ্ছ তদন্তের দাবি জানিয়েছেন। সামাজিক মাধ্যমে অভিষেক লিখেছেন, ‘আহমেদাবাদে এয়ার ইন্ডিয়া বিমানের মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় আমি গভীরভাবে শোকাহত। এই হৃদয়বিদারক ঘটনায় যারা প্রিয়জনকে হারিয়েছেন, তাঁদের পরিবারের প্রতি আমার আন্তরিক সমবেদনা।’
আবার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘দুর্ঘটনার খবরে আমার অন্তরাত্মা পর্যন্ত কেঁপে গিয়েছে। হতাহতের স্পষ্ট খবর নেই, এই মুহূর্তে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করা ছাড়া আর কিছু করার নেই।’
বৃহস্পতিবার এক্স হ্যান্ডলে লিখেছেন, ‘আহমেদাবাদে এয়ার ইন্ডিয়ার ভয়াবহতম দুর্ঘটনার খবরে শোকাহত এবং স্তম্ভিত। এটা অত্যন্ত দুঃখের ঘটনা। দুর্ঘটনাগ্রস্তদের পরিবারের পাশে রয়েছি এবং তাঁদের সমবেদনা জানাচ্ছি। যদিও সকলের জীবিত থাকার খবরের আশায় রয়েছি। বিমানের সকলের জীবিত থাকার প্রার্থনা করছি।’