• facebook
  • twitter
Saturday, 14 June, 2025

ঐতিহাসিক হাজরা ল কলেজের মুকুটে নতুন পালক

বর্তমানে এখানে বি এ (সাধারণ ডিগ্রি) ও আইনে ডিগ্রি যা এল এল বি একত্রে পাঁচ বছরের পাঠ্যক্রম চালু আছে। এরপর এখানে আইনে স্নাতকোত্তর বা এল এল এম পাঠ্যক্রমে পড়ানো যায়।

প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র

নিশীথ সিংহ রায়

১৯০৮ সালের ৪ জুলাই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেট অনুমোদন করে একটি আইন কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য। যা বৃটিশ পার্লামেন্ট আগেই অনুমোদন দিয়ে রেখেছিল। এক্ষেত্রে একটা কথা বলা খুব প্রয়োজন বৃটিশদের কল্যাণে সেসময় কলকাতা তথা বাংলা লেখাপড়ার ক্ষেত্রে একটা অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিল। তাঁরা এখানে শিক্ষার বিভিন্ন বিভাগ চালু করেন যা ছিল এশিয়া মহাদেশের মধ্যেই প্রথম। আধুনিক বা পাশ্চাত্য শিক্ষার ক্ষেত্র হিসেবে কলকাতাকে অগ্রণী ভূমিকা দিয়ে একের পর এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। এরই ফলস্বরূপ ১৮৫৭ সালের ২৪ জানুয়ারি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়। যা সুয়েজ খালের পূর্বে এশিয়া মহাদেশের মধ্যে আধুনিক বা পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রথম এবং প্রধান কেন্দ্র। ওই বছরেরই ১৮ জুলাই মুম্বাই ও ৫ সেপ্টেম্বর মাদ্রাস বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়। বৃটিশ পার্লামেন্টের অনুমোদন অনুসারে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তিনটি বিভাগ চালু করার সিদ্ধান্ত নেয়। লিগাল এডুকেশন, মেডিসিন এডুকেশন এবং ইঞ্জিনিয়ারিং বা টেকনোলজিক্যাল এডুকেশন চালু করার সিদ্ধান্ত হয়। ১৮৫৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তার যাত্রাপথ শুরু করলেও আইন বিভাগ চালু হয় ১৮৬৫ সালে। এব্যাপারে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন প্রসূন কুমার ঠাকুর। তখনকার দিনে তিনি আইন কলেজ তৈরির উদ্দেশ্যে পাঁচ লক্ষ টাকা দান করেন। তাঁর এই মহান কাজ স্বরূপ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় আইন বিভাগে ‘টেগর ল প্রফেসর’ বলে একটি সম্মান সূচক পদ তৈরি করে যা এখনও বিদ্যমান।

১৮৬৫ সালে আইন বিভাগ প্রতিষ্ঠা হলেও তা আনুষ্ঠানিক ভাবে পথ চলা শুরু করে ১৯০৯ সালে। ১৯০৮ সালের ৪ জুলাই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেটে ‘আইন’ কলেজ প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব পাশ হয়। স্যার সুরেন্দ্র নাথ ব্যানার্জী ওই সভায় উপস্থিত ছিলেন। সভায় সভাপতিত্ব করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেক্টর অ্যান্ড্রু হেন্ডারসন লেইথ ফ্লেজার। সে সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন ‘বাংলার বাঘ’ আশুতোষ মুখার্জী। তাঁর নেতৃত্বে ১৬ সদ্য বিশিষ্ট কমিটি ১৯০৯ সালের জুলাই মাসে বিশ্ববিদ্যালয়ে আনুষ্ঠানিক ভাবে আইন বিভাগ চালু করেন। কলেজের প্রথম অধ্যক্ষ ও উপাধ্য হন যথাক্রমে বিশিষ্ট আইনবিদ এস সি বাগচী ও বিরাজ মোহন মজুমদার। এইভাবেই চালু হল বর্তমানের কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে ইউ জি সি ১৯৮৩ সালে আইন কলেজটিকে Faculty of Law/ Department of Law of the University of Calcutta নামে আখ্যায়িত করেন যা আমাদের কাছে আজ হাজরা ল কলেজ হিসেবে বিবেচিত। বর্তমানে এখানে বি এ (সাধারণ ডিগ্রি) ও আইনে ডিগ্রি যা এল এল বি একত্রে পাঁচ বছরের পাঠ্যক্রম চালু আছে।

এরপর এখানে আইনে স্নাতকোত্তর বা এল এল এম পাঠ্যক্রমে পড়ানো যায়। আইনে আরও উচ্চতর গবেষণা করার জন্য এখানে ডক্টরেট ও পোস্ট ডক্টরেট প্রোগ্রাম চালু আছে। বর্তমান আইন বিভাগের ডিন ও বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডঃ যতীন্দ্র কুমার দাস এব্যাপারে বলেন, এবছর থেকে ত্রিশ আসন সংখ্যা বিশিষ্ট ‘হিউম্যান রাইটস’ কোর্স চালু হয়েছে। যা আগে নৃবিজ্ঞান (anthropology) বিভাগে পড়ানো হতো। ২০২৪ সালের চব্বিশে মে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট এব্যাপারে অনুমোদন করে যে এই বিভাগটি আইন বিভাগের অধীনে পড়ানো হবে। সেই মোতাবেক এবছর কোর্সটি চালু হলে আইন বিভাগের মাথায় আর একটি পালক যোগ হয়। যতীন্দ্রবাবু আরও বলেন, আমাদের একটা দুশ্চিন্তা ছিল এমনিতেই আইনে সব বিভাগ মিলিয়ে আটশোর ওপর শিক্ষার্থী। তার ওপর স্নাতকোত্তর বিভাগে হিউম্যান রাইটস-এর শিক্ষার্থী? কিন্ত বাস্তবে দেখা গেল উল্টো চিত্র। ফর্ম ফিলাপ, এন্ট্রান্স পরীক্ষা সব কিছুতেই যা ভীড় তাতে বোঝা যায় মানুষ এখন আইন সম্বন্ধে জানতে, পড়তে আগ্রহী। আইনি পেশায় যেটা সবথেকে প্রয়োজন বা জরুরী তা হল ‘argumentative skills’ বা উপযুক্ত যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করা।

এব্যাপারে ভারতীয়রা কিন্ত চিরকালই এগিয়ে আছেন। যেমন রাধাবিনোদ পাল আন্তর্জাতিক আইন কমিশনের সদস্য ছিলেন ও টোকিও ট্রায়ালস-এ তিন বিচারকের মধ্যে একজন ছিলেন এবং অনেক জাপানি যুদ্ধাপরাধীদের জীবন বাঁচিয়ে ছিলেন। সেকারণে জাপানিরা আজও তাকে স্মরণ করেন। এছাড়াও আরও অনেকে বিশ্বের দরবারে আইনি সহায়তা দিয়ে ভারতের মুখ উজ্জ্বল করেছেন। ডঃ দাসের কথায় এত কিছুর পরেও এককালে বাংলায় একটা প্রবাদ ছিল, ‘যার নেই কোনো গতি, সে পড়ে ওকালতি’। মানে তখন কারুর কোনো ক্ষেত্রে কিছু না করতে পারলে চলে আসত এই আইনি ক্ষেত্রে। আরও একটা কারণ ছিল এই কথা বলার তা হল তখন আইনি ব্যবসায় সাথে যারা জড়িত থাকতেন তাঁরা হলেন বড়লোক বা আভিজাত্য ঘরের। তাই সাধারণ মানুষের ধারণা হতো এদের আর অন্য কিছু করার ক্ষমতা নেই তাই এই ব্যবসায়। ওই ‘আলালের ঘরের দুলাল’, তার দ্বারা আর কি হবে? যাইহোক এখন আমরা দেখছি সমাজের উচ্চ মেধা সম্পন্ন শিক্ষার্থীরাও এই ক্ষেত্রে আসছেন। এটা খুবই ভাল লক্ষণ। মানুষ বা রাষ্ট্র যত উন্নত হবে তত সেখানে জটিলতা আসবে। তাই, সংবিধান বা আইন জানা মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে মানুষের সুবিচার পেতে সুবিধা হবে।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউ জি সি) ও ভারতীয় বার কাউন্সিল দ্বারা হাজরা ল কলেজ অনুমোদন প্রাপ্ত। সেকারণে এখান থেকে পাশ করার পরে কোনও শিক্ষার্থীকে আরও উচ্চতর শিক্ষা বা সরকারি, বেসরকারি চাকরির জন্য ভাবতে হয় না। আর নিয়ম মাফিক বিশ্বের যে কোনো আদালতে সে প্রাক্টিস করতে পারবে। এখানকার অনেক কৃতী ছাত্র আজ সারা বিশ্বে তাদের মেধার দ্বারা স্বীকৃত। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বর্তমানে মোট পনেরটি আইন কলেজ আছে।

কালের নিয়মে অনেক কিছু যেমন হারিয়ে যায় তেমন আবার অনেক কিছুই আবার সংযোজিত হয়। হাজরা ল কলেজ সেক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী বলা যায়। সময়ের তালে তালে সে যা জীর্ণ বা প্রাচীন যা সমাজের পক্ষে অনুপোযুক্ত তাকে পরিহার করে নতুনদের স্বাগত করে নিজেকে সমৃদ্ধ করেছে। তাই তো স্যার আশুতোষ মুখার্জী যা চেয়েছিলেন এই আইন বিভাগটি যেন ভারতীয় আইনি ক্ষেত্রে কলেজ হিসেবে উজ্জ্বল স্বাক্ষর রাখতে পারে ও আইন ব্যবস্থার ক্ষেত্রে একটি মডেল হিসেবে কাজ করে। তাঁর সেই স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করে হাজরা ল কলেজ কালের বিবর্তনে দাঁড়িয়ে এখনও তার গরীমাকে শুধু ধরেই রাখেনি বরঞ্চ তা শুধু বাংলার নয় ভারতের গর্ব হিসেবে বিবেচিত হয়।