বিশ্বজিৎ সরকার
বর্ধমানের শাঁখারী গ্রামের ছেলে মানস সরকার, ১৯৭৮ সালে যাদবপুরে মাস্টার ডিগ্রী সম্পন্ন করে পেশা হিসেবে বেছে নিলেন সাংবাদিকতা। সংবাদপত্র থেকে টিভি, প্রসার ভারতী সহ বেশ কিছু সংস্থায় দক্ষতার সঙ্গে কাজ করেও কর্মক্ষেত্রের শেষের দিনগুলিতে খুঁজে পাচ্ছিলেন না জীবন- জীবিকা সম্পৃক্ত আনন্দবোধ। সবকিছুই অর্থহীন মনে করে কামাখ্যা তারাপীঠ ঘুরে আধ্যাত্ম্য সাধনার নিমগ্নচর্চায় বসে গেলেন। জমানো পয়সা, পৌত্রিক সম্পত্তি বিক্রি করে এবং পূর্ব পরিচিতির সুত্র থেকে স্থানীয় ব্যানার্জী পরিবারের সহায়তায় গড়ে তুললেন আশ্রম –ব্রক্ষময়ী সেবা মন্দির। মশাগ্রাম বাঁকুড়া রেল লাইনের অন্যতম রেল স্টেশন ধানশিমলা। শাল, মহুয়া, আকাশমনী, ছাতিমের বুক চিরে ধানশিমলা রেলষ্টেশন। এই ধানশিমলা স্টেশনে নেমে বাঁদিকের বাঁকুড়া বর্ধমান রোড ধরে একটু পিছলেই চোখে পড়বে এই ছোট আশ্রম। আশ্রমের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে নদী। আশ্রমের লাগোয়া শ্মশান। চারধারে শাল, ছাতিম, ইউক্যালিপটাসের ঘন অবস্থান। সেই ঘন অরন্যের স্তুপে দেখা মেলে দু একটা মাংশাসী উদ্ভিদ সূর্যশিশির।এমন শান্ত নিরিবিলি জায়গা একক সাধনার উপযুক্ত ক্ষেত্র স্থল। নিভৃতের এককী গায়নের সাধন ক্ষ্রেত্র কিংবা ঈশ্বর সাধনায় সঁপে দেওয়া হৃদয়ের উপাসনা স্থল। এই জায়গায় বাকি দিনগুলি ঈশ্বর সাধারনায় কাটিয়ে দিতে চেয়েছিলেন এই প্রাক্তন সাংবাদিক। এমন নির্জন জায়গা নির্বাচনের আরো দুটি বাহ্যিক কারণ ছিল।
Advertisement
ঢিল ছোড়া দূরত্বে আছে ভারত বিখ্যাত কুসুম হরনাথের মন্দির, অন্যদিকে পাশের সোনামুখিতে সাধক মনোহর দাসের অকুস্থল, যেখানে অনবরত আধ্যাত্মিক জগতের মানুষ সহ সাধুসঙ্গের নিত্য সমাবেশ। কিন্তু কিছুদিন এখানে থাকার পরেই তার ভাবনায় জণ্ম নেয় অন্য বোধ। এখানকার আর্থ-সামাজিক পরিবেশ তার চেতনায় ঘা দেয়।উপলব্ধি করেন এখানকার দারিদ্র অশিক্ষা, কুসংস্কার ঘেরা জীবন। বনের পাতা কুড়িয়ে কিম্বা মাঠে কাজ করেও যে প্রাথমিক পড়াশোনা শুরু হয় তা শেষ হতে সময় লাগে না বিশেষ। বাল্যবিবাহ, কিম্বা চটজলদি দু পয়সার লোভে পরিযায়ী শ্রমিক হওয়ার হাতছানিতে ছেদ ঘটে পড়াশোনা। অন্যদিকে অনেক মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীরা বঞ্চিত হয় নানান সরকারি সু্যোগ সুবিধায়।
Advertisement
আবার অপসংস্কৃতি আর লঘু আনন্দের বেড়াজালে ছিন্ন হয় শিশুমন। এ সব দেখে শুনে বদলে গেল তাঁর আত্ম অনুসন্ধানের অঙ্ক। ছোটখাট সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, কুসংস্কারমুক্ত আলোচনা সভার মধ্য দিয়ে শুরু করলেন আশ্রমের কাজ, চেতনার দ্বার খুলে দেয় এমন অনুষ্ঠান। অভিজ্ঞতা থেকে উপলব্ধি করলেন যে সব ছাত্রছাত্রীরা পড়াশোনা করছেন তারা ন্যূনতম বাংলা রিডিং ও পড়তে পারছে না সেখানে ইংরাজি তো দূর অস্ত। অন্যদিকে পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়ের ছেলেদের শৈশব বলে কিছু নেই। ব্রক্ষ্মময়ী সেবা মন্দিরের চরিত্র পরিনত হল জন কল্যানমুলক সংগঠন ও শিক্ষার সাবেকি মূল্যবোধ বিকাশে। প্রথমে ছাত্রছাত্রী দের নিয়ে শুরু করলেন রিডিং পড়ানোর পাঠ। সাথে সাথে তাদের হৃদয়বৃত্তির প্রকাশে নাচ, গান, যোগ চর্চার অনুশীলন। একেবারে ভিন্ন পরিবেশে এমন হৃদয় বৃত্তির চর্চায় ছাত্র ছাত্রীরা পেল শিক্ষার আনন্দ।ক্রমে স্কুল শিক্ষার পরিপুরক বা সাপ্লিমেণ্ট হিসেবেই শুরু হল শিক্ষা দান ও কর্মসুচী। ছাত্রদের উদ্যোগের দবার খোলার এখানে বিপুল আয়োজন। একেবারে নিখরচায় প্রথমে শুরু হ ল এই শিক্ষার ক্লাস। এই পাঠশালায় এখন পুঁথিগত পড়াশোনার সাথে সাথে সেখানে সাংস্কৃতিক চর্চা কম্পিউটার শিক্ষা যোগ শিক্ষা এবং নৃত্য শিক্ষা। ছাত্রছাত্রীরা নিজেরাই গড়ে তুলেছে দেবোদ্যান –নানান ফুলের উদ্যান। এরকম একটি সংগঠন চালাতে গেলে দরকার অর্থের। নিজের পুঁজিপাটা শেষ তবে তবে সাধ্যমত কলকাতার বন্ধুবান্ধবদের সহায়তায় এ গিয়ে চলে এই পাঠশালা।
স্থানীয় মানুষরাও অবশ্য এগিয়ে আসছেন। প্রথম শ্রেণী থেকে দশম শ্রেণির ছাত্র ছাত্রীদের অবারিত দ্বার। এই প্রতিষ্ঠানটিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে এগিয়ে এসেছে অনেক শিক্ষিত যুবক-যুবতী প্রায় বিনা পারিশ্রমিকে। কেউ নিয়েছে নাচের দায়িতব, কেউ কম্পিউটারের, কেউ বা আবার পড়ানোর। কম্পিউটার গান ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠাণের জন্য ছাত্রছাত্রীরা অবশ্য এখন পঞ্চাশ টাকা দিয়ে এই প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্যকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে। আধ্যাত্মিক পরিমণ্ডল অতিক্রম করে যৌথ জীবন শিক্ষার এই দৃষ্টান্ত এক বিরল ব্যাপারই। এখন ৭০ জনের মত ছাত্র ছাত্রীরা যুক্ত এই প্রতিষ্ঠানে। এর বেশির ভাগই পিছিয়ে পড়া শ্রেণির। এই শ্রেণির প্রায় সকলেই প্রকৃতির এই পাঠশালায় এসে জেনেছে শৈশবের মাহাত্ম্য এই ভিন্ন পাঠের অনুশীলনে গ্রামের শিক্ষিত ছেলেমেয়েদের আগ্রহ বেড়ে চলেছে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান টির প্রতি। এই মহাযজ্ঞে পার্শ্ববর্তী দুই মাইল দূর থেকে এসেছে আমাদের সকলের পরিচিত এক যুবক। তাকে অনেকেই চেনেন। সে এলাকার সকলের প্রিয় হামিদ। যুব একাডেমী সাহিত্য প্রাপ্ত হামিরুদ্দিন মিদ্দা । প্রিয় হামিদ ছেলেমেয়েদের গল্প শোনায়, গল্প বলে, শোনে আর তাদের অনুভুতির মগজে একটু করে সঞ্চারিত করে সাহিত্য বোধ। না কোন প্রথাগত গল্পের কর্মশালা নয় উন্মুক্ত প্রাঙ্গনে শিশু ও যৌবন মনে কল্পনার ভাব বিনিময়। এ রকম একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত হতে পরে গর্বিত হামিদও।
Advertisement



