তরুণ যােদ্ধা রাহুল গান্ধি

রাহুল গান্ধি যখন রাজনীতিতে ঢুকলেন, তখন একজন বড় রাজনীতিবিদ তাঁকে খুব হালকাভাবে নিয়ে বলেছিলেন, বসন্তের ককিল।

Written by SNS Kolkata | July 12, 2019 4:59 pm

রাহুল গান্ধি (File Photo: IANS/AICC)

রাহুল গান্ধি যখন রাজনীতিতে ঢুকলেন, তখন একজন বড় রাজনীতিবিদ তাঁকে খুব হালকাভাবে নিয়ে বলেছিলেন, বসন্তের ককিল। অর্থাৎ তিনি এসেছেন, আবার চলেও যাবেন।

কিন্তু যখন তিনি এই তরুণ বয়সে দেশের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী বৃহত্তম দল কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সভাপতি হিসেবে দলের হাল ধরলেন, তখন এই রাজনীতিবিদ কী মনে করেছিলেন তা জানা যায়নি। এখন কংগ্রেস সভাপতির পদ থেকে তাঁর সরে দাঁড়ানাে, অনেকের মতে ‘দল একজন তরুণ যােদ্ধাকে হারাল’।

গত লােকসভা নির্বাচনে তিনি নিজেকে ভালভাবেই মেলে ধরেছিলেন। তাঁর আগে মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড় এবং রাজস্থানে বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপিকে হারিয়ে কংগ্রেস যে ক্ষমতা দখল করল তার মূল কারিগর ছিলেন তিনিই। গুজরাতের নির্বাচনেও কংগ্রেস বিজেপির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ভাল ফল করল, যদিও ক্ষমতায় আসতে পারেনি।

তিনটি রাজ্যে কংগ্রেসের সাফল্যের পিছনে রাহুল গান্ধির অনলস পরিশ্রম, অনেকগুলি নির্বাচনী জনসভায় তিনি বিজেপি শাসনে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যর্থতা মানুষের সামনে তুলে ধরেছিলেন। কংগ্রেসকে ক্ষমতায় আনার জন্য তাদের আহ্বান জানিয়েছিলেন। এই তিনটি রাজ্যে রাহুলের দেওয়া উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি, কৃষকদের সমস্যা সমাধান, তাদের উন্নতির জন্য নানা প্রকল্প এবং ঋণ মকুবের আশ্বাসের কথায় মানুষ আস্থা রেখেছিলেন। এই সাফল্যে দলও উজ্জীবিত হয়েছিল।

আশা করা গিয়েছিল লােকসভা নির্বাচনেও কংগ্রেস ভাল ফল করবে এবং কংগ্রেস ক্ষমতায় আসবে। রাহুল গান্ধি নির্বাচনের প্রচার শুরু হওয়ার অনেক আগের থেকে সারা দেশ ঘুরে ঘুরে, মানুষের সঙ্গে কথা বলে, তাঁদের সঙ্গে আন্তরিকভাবে মিশে বুঝতে পারছিলেন মােদি সরকারের দেওয়া প্রতিশ্রুতিভঙ্গ এবং নানা ক্ষেত্রে ব্যর্থতায় তারা হতাশ। বিকল্প হিসেবে তারা কংগ্রেসকে চান।

মানুষের এই মনােভাব বুঝতে পেরেই লােকসভা নির্বাচনে তিনি ঝাপিয়ে পড়েছিলেন। দেশের প্রতিটি রাজ্যে একের অধিকবার এসে জনসভা করে মােদি শাসকের দুর্নীতি এবং নানা ক্ষেত্রে ব্যর্থতার কথা বলেছিলেন। যুদ্ধবিমান কেনা নিয়ে যে দুর্নীতি হয়েছিল এবং প্রধানমন্ত্রী দফাদার তথা দেশের মানুষের পাহারাদার হয়ে যে ‘চোর’ বনে গিয়েছিলেন, তাও তিনি অত্যন্ত দৃঢ়তা ও ক্ষিপ্রতার সঙ্গে প্রতিটি জনসভায় ফাস করে দেন।

নির্বাচন প্রচারকালে তিনি পাশে পেয়েছিলেন তাঁর বােন প্রিয়াঙ্কা গান্ধিকে, যিনি সর্বদা দাদার পাশে থেকে তাঁকে সাহস জুগিয়েছেন। রাহুল গান্ধি তাঁর বােনের ওপর উত্তরপ্রদেশে কংগ্রেসের ভাবমূর্তি তুলে ধরা এবং দলীয় সংগঠনকে মজবুত করার দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন, যা তিনি অত্যন্ত দক্ষতা ও একাগ্রতার সঙ্গে পালন করেছিলেন।

মােদি সরকারের ব্যর্থতা তুলে ধরে রাহুল গান্ধি যে প্রচারে ঝড় তুলেছিলেন তার ফলে হাওয়াটা অনেকটাই কংগ্রেসের দিকে বইতে শুরু করেছিল। কিন্তু মােদি ঝড়ের ক্ষিপ্রতা যে অনেক বেশি ছিল তা তখন বােঝ যায়নি।

তাছাড়া মােদির সঙ্গে প্রচারে আরও বিজেপি নেতা অংশগ্রহণ করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে অবশ্যই বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ, দলের নির্বাচন স্ট্রাটেজি নিরূপণের মস্তিষ্ক, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং এবং উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যােগী আদিত্যনাথ। সে তুলনায় রাহুল একাই লড়েছেন কংগ্রেসের হয়ে। যে রাজ্যে কংগ্রেস সাংগঠনিক দিক থেকে অপেক্ষাকৃত দুর্বল, সেখানেই তিনি ছুটে গিয়েছেন। একবার নয়, দুই, তিনবার।

ভােটের ফল বের হলে দেখা গেল, কংগ্রেসের শােচনীয় পরাজয়। যে ফলের আশা করা গিয়েছিল, তার ধারেকাছেও নেই। রাহুল নিজে রায়বেরিলি আসনে বিজেপি প্রার্থী এবং মন্ত্রী স্মৃতি ইরানির কাছে হেরে গেলেন, কেরল থেকে জিতলেন। ভাগ্যিস দুটি আসন থেকে লড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। চরম হতাশা এবং আক্ষেপ এল রাহুলের মনে। কারণ কংগ্রেসকে জয়ী করার মূল দায়িত্ব তিনিই একা কাধে তুলে নিয়েছিলেন। এই পরাজয়ে তিনি ব্যথিত, মর্মাহত। নিজে এই দায় মেনে নিয়ে কংগ্রেস সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগ করলেন।
তারপরই কংগ্রেসের মধ্যে শুরু হল তাঁকে একাজ থেকে নিরস্ত করার কাজ। কিন্তু তিনি সিদ্ধান্তে অনড় রইলেন। কংগ্রেসের বেশিরভাগ নেতাই চাইলেন তাঁকে। মাতা ঠাকুরানি সােনিয়া গান্ধি, নীরবতা ভেঙে বললেন ও সিদ্ধান্ত রাহুলের। সে যা ভাল মনে করেছে, তাই করেছে। তাঁকে সভাপতির পদে রাখার জন্য যখন মাসাধিককাল ধরে ঢানাটানি চলল, রাহুল তা নিয়ে বীতশ্রদ্ধ হয়ে পদত্যাগ চুড়ান্ত জানিয়ে দিলেন। কিন্তু তিনি দলে থাকবেন, দলের হয়ে কাজ করবেন। তার চাইতেও বড় কথা যা বললেন তা হল, তিনি একাই লড়েছেন, পাশে কাউকে পাননি কেউ এগিয়ে এসে তাঁর পাশে দাঁড়াননি।
কংগ্রেসের অভ্যন্তরে যে দ্বন্দ্ব ছিল তা তাঁর কথায় বের হয়ে এল। এখন কংগ্রেসকে কে নেতৃত্ব দেবেন, তাঁকে বাছতে হিমশিম খেতে হচ্ছে দলের অন্যদের। কংগ্রেসের বেশিরভাগ শীর্ষ নেতাই বয়সের ভারে ক্লান্ত, অবসন্ন। দলকে টেনে তােলার যে শক্তি এবং বুদ্ধি থাকার প্রয়ােজন, তা তাঁরা অনেকেই হারিয়ে ফেলেছেন।
রাহুল দলের জন্য যে খাটাখাটনি, এবং লড়তে পারতেন, তা অনেকেই এখন পারবেন না। তিনি আস্তে আস্তে রাজনৈতিক কুশলতার পরিচয় দিচ্ছিলেন। বয়স কম, সুতরাং তাঁর সামনে দীর্ঘ পথ ও সময় পড়ে ছিল, রাজনীতিতে ধুরন্ধর হওয়ার। কিন্তু অনেকটা মনের দুঃখে, পাশে কাউকে না পেয়ে চরম হতাশায় ভুগে, দায়িত্ব থেকে সরে এলেন। তাকে সমর্থন জানালেন বােন প্রিয়াঙ্কা। এতে দলের ক্ষতিই হল কারণ রাহুলের মতাে যুব নেতাদেরই প্রয়ােজন বেশি বিজেপির অগ্রগতিকে রুখে দলকে এগিয়ে নিয়ে যেতে, আবার স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত করতে।