বিমলকুমার শীট
“আমি সেনাপতি নই, রাজা নই, ধনী নই, কিছু নই— আমি শুধু সন্ন্যাসী, দরিদ্র ভিখারী সন্ন্যাসী। তা স্বত্ত্বেও সমাজের উচ্চ-পদস্থ ও সম্মানিত ব্যক্তিরা আমাকে সম্মান জানাতে এসেছেন। এক ভিখারী সন্ন্যাসীকে এই যে রাজোচিত সম্মান প্রদান হিন্দুদের আধ্যাত্মিক ভাবই তাতে প্রকাশিত হয়েছে। আমার প্রতি এই যে সংবর্ধনা – এ আমার জন্য নয়, আমি যে আদর্শের জন্য দাঁড়িয়ে আছি তার জন্য” ১৫ জানুয়ারি কলম্বোয় তাঁর পদার্পনের সন্ধিক্ষণে সংবর্ধনার উত্তরে এ কথা বলেছিলেন স্বামীজি। এ থেকে অনুমান করা যায় মাদ্রাজে তাঁর জন্য কেমন সংবর্ধনা অপেক্ষা করে আছে। কারণ মাদ্রাজে রামনাদের রাজাই স্বামীজিকে শিকাগো যাওয়ার জন্য বারংবার উত্তেজিত করে ছিলেন।
Advertisement
বাস্তবে যুগ প্রবর্তক স্বামী বিবেকানন্দ দুর্বল ভারতকে শক্তিশালী করতে চেয়ে তিনি আরও বলেছেনঃ “শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মানুষকে অধঃপতনের নীতিই শিক্ষা দেওয়া হয়েছে —পৃথিবীর সর্বত্র জনসাধারণকে বলা হয়েছে যে, তারা মানুষ নয় — তাঁদের আত্মবিশ্বাস আনতে দাও। কারণ একজন ইংরেজের সঙ্গে তোমাদের পার্থক্য কোথায়? –আমি সে পার্থক্য বের করেছি। পার্থক্য হল এই যে ইংরেজ নিজের ওপর বিশ্বাস রাখে। তোমরা তা রাখো না — আমরা চাই শক্তি –– অতএব আত্মবিশ্বাসী হও। –মানুষ হও। মানুষ তৈরির ধর্ম আমরা চাই”।
Advertisement
স্বামীজি স্বদেশে ফিরে আসছেন, এ সংবাদ প্রচার হওয়া মাত্র তাঁকে সাদর অভ্যর্থনা করবার জন্য নানা শহর প্রস্তুত হল। সিংহল ও মাদ্রাজ প্রদেশের প্রধান নগরের নাগরিকগণ সম্মিলিত হয়ে অভ্যর্থনা সমিতি গঠন করার জন্য প্রস্তুত হল। সিংহল ভ্রমণ শেষ হলে জাফনা হতে একখানি স্টিমার ভাড়া করে স্বামীজি তাঁর শিষ্যবর্গ ও গুরুভ্রাতা স্বামী নিরঞ্জনানন্দজিকে সঙ্গে নিয়ে ভারত অভিমুখে যাত্রা করলেন। আগে থেকে সংবাদ পেয়ে রামনাদাধিপ রাজা ভাস্করবর্মা সেতুপতি সদলবলে পাম্বানে উপস্থিত ছিলেন। স্বামীজি পাম্বানবাসীকে ধন্যবাদ প্রদান করে মর্মস্পর্শী ভাষায় একটি নাতিদীর্ঘ বক্তৃতা প্রদান করেন।
উপসংহারে তিনি বলেন, “রামনাদের রাজা আমার উপর যে ভালোবাসা দেখাইয়ছেন, তজ্জন্য তাঁহার প্রতি কৃতজ্ঞতার আবেগ আমি ভাষায় প্রকাশ করিতে অক্ষম। যদি আমার দ্বারা কিছু কিছু সৎকার্য হইয়া থাকে, তবে তাঁহার প্রত্যেকটির জন্য ভারত এই মহাপুরুষের নিকট ঋণী, কারণ আমাকে শিকাগো পাঠাইবার কল্পনা তাঁহার মনেই প্রথম উদিত হয়। তিনি আমার মাথায় ঐ ভাব প্রবেশ করাইয়া দেন এবং উহা কার্যে পরিণত করিবার জন্য আমাকে বার বার উত্তেজিত করেন। এক্ষণে তিনি আমার পার্শ্বে দাঁড়াইয়া তাঁহার স্বভাবসিদ্ধ উৎসাহে আরও অধিক কার্যের আশা করিতেছেন। যদি ইঁহার ন্যায় আরও কয়েকজন রাজা আমাদের প্রিয় মাতৃভূমির কল্যাণে আগ্রহাণ্বিত হইয়া জাতীয় উন্নতির চেষ্টা করেন। তবে বড়ই ভাল হয়”।
সভাশেষ হলে স্বামীজিকে তাঁর বাসের জন্য নির্দিষ্ট বাংলোয় নিয়ে যাওয়া হল। রাজার আদেশ অনুসারে ঘোড়ার গাড়ি থেকে ঘোড়াকে খুলে দিয়ে রাজা স্বয়ং সেই গাড়ি টেনে নিয়ে গেলেন। তারপর স্বামীজি প্রসিদ্ধ শ্রীশ্রী রামেশ্বরের মন্দির দর্শন করতে গেলেন। দেবদর্শন শেষ হলে জনতার অনুরোধে স্বামীজি ইংরেজিতে ভাষণ দিলেন। মি নাগলিঙ্গম তামিল ভাষায় তা অনুবাদ করে সাধারণকে বুঝিয়ে দিলেন। স্বামীজি ভারতের অন্যতম পবিত্রধামের মন্দির প্রাঙ্গনে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করলেন – যত্র জীব তত্র শিব। এই মহামন্ত্রে অনুপ্রাণিত হয়ে প্রতি নরনারীর সেবায় অগ্রসর হওয়া যথার্থ শিব ভক্তি। কেবল মাত্র বসে বসে তাঁর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, চক্ষু, কর্ণ, নাসিকার অপরূপ সৌন্দর্যের প্রশংসা করে স্তোত্রপাঠসহকারে যে প্রতিমা বিশেষের সেবায় নিযুক্ত থাকে, সে প্রবঞ্চক মাত্র। তার ভক্তি পরিপক্ক হয়নি।
সেদিন স্বামীজির শুভাগমন উপলক্ষে হাজার হাজার দরিদ্র নারায়ণকে ভোজন করানো হয়। বস্ত্র ও অর্থ বিতরণ করা হয়। ভারতের মাটিতে প্রথম স্বামীজি যেখানে পা রেখেছিলেন রামনাদাধিপের রাজা সেখানে ৪০ ফুট স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করেদিলেন। রামেশ্বর হতে স্বামীজি রামনাদাভিমুখে যাত্রা করলেন। রাজা, রাজভ্রাতা ও অন্যান্য বিশিষ্ট রাজকর্মচারীগণ পায়ে হেঁটে স্বামীজিকে অনুসরণ করল। রাজভ্রাতা দিনকরবর্মা সেতুপতি অভিনন্দনপত্র পাঠ করলেন। স্বামীজির বক্তৃতা দেওয়ার পর রাজাজি প্রস্তাব করলেন স্বামী বিবেকানন্দের শুভাগমন উপলক্ষে মাদ্রাজ দুর্ভিক্ষ ভাণ্ডারের জন্য সাধারণের নিকট হতে চাঁদা তুলে পাঠানর। উক্ত প্রস্তাব সাগ্রহে সমর্থিত হল। তারপরই সভা ভঙ্গ হল। তারপর স্বামী বিবেকানন্দ পরমকুড়ি, মনমদুরা, মদুরা, ত্রিচিনপল্লি ও তাঞ্জোর প্রভৃতি শহরে অভিনন্দিত হয়ে কুম্ভকোনমে গেলেন। তারপর সেখান থেকে তিনি মাদ্রাজ গেলেন। আগে থেকে তার আগমনের সংবাদ পেয়ে মাদ্রাজ নগরী সেজে উঠে ছিল। ৬ ফেব্রুয়ারি সকাল হওয়ার সাথে সাথে হাজার হাজার নর নারী স্টেশনের দিকে যাত্রা করল। স্বামীজি গাড়ি থেকে নামার পর অভ্যর্থনা সমিতি তাঁকে ফুলের মালা পরিয়ে দিলেন। স্বামীজি কয়েক মিনিট উপস্থিত ব্যক্তিদের সঙ্গে আলাপ করে ঘোড়ার গাড়িতে উঠলেন। তার পাশে বসলেন জাস্টিস সুব্রহ্মণ্য আয়ার, স্বামী নিরঞ্জনানন্দ ও স্বামী শিবানন্দ। পথে স্বামীজির মাথায় অনবরত পুষ্পবৃষ্টি হতে লাগল । উৎসাহী যুবকগণ গাড়ির ঘোড়া খুলে দিয়ে নিজেরাই গাড়ি টেনে নিয়ে গেলেন। কোনও কোনও পুরনারী রাজপথে দাঁড়িয়ে স্বামীজিকে পঞ্চপ্রদীপ দিয়ে আরতি করতে লাগল।
মাদ্রাজে স্বামীজির শুভ পদার্পন উপলক্ষে যে উৎসাহ দেখা দিয়ে ছিল সে সম্বন্ধে ‘হিন্দু’ পত্রিকা মন্তব্য করে ছিল- “আদ্য স্বামী বিবেকানন্দকে রেলওয়ে স্টেশনে অভ্যর্থনা করিবার জন্য সম্মিলিত বিরাট জনসঙ্ঘের উৎসাহোচ্ছাস ও ধর্মানুরাগ অতিরঞ্জিত করিয়া বর্ননা করা অসম্ভব। মাদ্রাজের শ্রেষ্ঠতম ব্যক্তিগণ উপস্থিত থাকিয়া বিশ্ববিখ্যাত সন্ন্যাসীকে যে গৌরবময় অভ্যর্থনা প্রদান করিয়াছেন, তাহাতে এই মহাদেশের অন্তনির্হিত ধর্মশক্তি সুস্পষ্টরূপে ফুটিয়া উঠিয়াছে । ধর্ম সংস্কারকগণ ভারতে চিরদিনই এইরূপ অভ্যর্থনা পাইয়া আসিতেছেন। গোঁড়ামিই হিন্দুর জাতীয় চরিত্রের বৈশিষ্ট্য নহে, বর্তমান আচার ব্যবহারগুলি পরিবর্তনও যে অবাঞ্ছনীয় তাহা নহে, যদি কোনও সুপ্রতিষ্ঠিত প্রথা দূর করিয়া নূতন কোনও নিয়ম প্রবর্তন করিতে হয়, তাহা হইলে স্বামী বিবেকানন্দের মতো ব্যক্তিরই কর্তৃস্থানীয় হইয়া উহা সমাধান করা উচিত। যখন কোনও ধীর হৃদয়, পবিত্র মানস, প্রকৃত সংস্কারক নিষ্কাম ও ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য সাধন-স্পৃহাবিমুক্ত-কল্যাণেচ্ছা লইয়া দৃঢ় পদে দণ্ডায়মান হন, তখন আচার নিয়ম শূন্যে মিলাইয়া যায়, চিরপোষিত ধারণা ও আদর্শ দূরে নিক্ষিপ্ত হয়, প্রতিষ্ঠিত রীতি নীতি ও মতসমূহ বিলীন হইয়া যায়। স্বাজীজির প্রচারকার্যের সাফল্যের ইহাই একমাত্র রহস্য”।
পরের দিন স্বামীজিকে প্রথা মতো অভ্যর্থনা সমিতির পক্ষ হতে অভিনন্দন পত্র প্রদান করা হল। খেতরির মহারাজা কর্তৃক পাঠান অভিনন্দন দেওয়ার পর ক্রমে বিভিন্ন সম্প্রদায়, সভা ও সমিতির পক্ষ হতে সংস্কৃত, ইংরেজি, তামিল, তেলেগু প্রভৃতি ভাষায় প্রায় কুড়িখানি অভিনন্দন পত্র পাঠ করা হয়। মাদ্রাজ ‘ভিক্টোরিয়া হলে’ পঞ্চাশ হাজার শ্রোতার সম্মুখে ‘আমার সমরনীতি’ নামক সুপ্রসিদ্ধ বক্তৃতা প্রদান করলেন। এরপর ক্রমে ক্রমে আরও চারটি বক্তৃতা প্রদান করলেন। স্বামীজি মাদ্রাজে নয় দিন আনন্দের সঙ্গে শিষ্য ও ভক্তমণ্ডলীর সঙ্গে কাটালেন।
স্বামীজির কলম্বো হতে মাদ্রাজের বক্তৃতাগুলিতে নূতন তত্ত্ব, নূতন ভাব, নূতন কর্মপদ্ধতির পরিচয় পেয়ে দেশের অল্প সংখ্যক মণীষী ও হৃদয়বান ব্যক্তিরা বুঝলেন, নবযুগের সূচনা করবার মতো অনুপম প্রতিভা ও অসামান্য হৃদয় নিয়ে সন্ন্যাসী স্বদেশের কর্মক্ষেত্রে ফিরে এসেছেন। তিনি ভারতবর্ষের সেবার জন্য আহ্বান জানিয়ে ছিলেন – চরিত্রবান, হৃদয়বান এবং বুদ্ধিমান যুবকদেরকে। কারণ যুবরাই দেশের ভবিষ্যৎ, তাঁরাই দেশকে গড়বে।
Advertisement



