বরুণ দাস
সেই কতোকাল আগে উচ্চারণ করেছিলেন এক মানবতাবাদি কবি: ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।’ কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের, কবির সেই অমোঘ উচ্চারণে আমরা কেউ-ই কর্ণপাত করার কোনও প্রয়োজন বোধই করিনি। যদি সামান্যতম প্রয়োজন বোধ করতাম তো আমাদের সমাজ আরও সুন্দর, আরও সমৃদ্ধ, আরও উন্নত, আরও সমুজ্জ্বল হয়ে উঠত-এ বিষয়ে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই।
আমরা চৈতন্যদেবের কথায়ও কোনও কর্ণপাত করিনি। তাঁকে শ্রদ্ধা-ভক্তি করি। অবতার-জ্ঞানে পুজো করি। তাঁকে নিয়ে, তাঁর গণ-আন্দোলন নিয়ে জ্ঞানগর্ভ আলোচনাও করি; কিন্তু তাঁকে আমাদের যাপনচিত্রে মান্যতা দেওয়ার কথা কখনও ভাবিনি। আমরা কাজি নজরুল ইসলামকে নিয়ে মাতামাতি করি। ঘটা করে তাঁর জন্মদিন ও মৃত্যুদিন উদযাপন করি; গলায় মালা পরাই কিন্তু তাঁর কথায়ও আমরা আস্থা রাখিনি।
এমন উজ্জ্বল উদাহরণ হয়তো আরও অনেক আছে। হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের অনেক মনীষী-মহাপুরুষই যুগে যুগে মনুষ্যত্ব ও মানবতার সপক্ষে দীর্ঘ সওয়াল করে গেছেন। বিভেদ ভুলে, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সম্প্রীতির পক্ষে কথা বলে গেছেন। এঁদের নামের তালিকা বাড়িয়ে লাভ নেই। প্রিয়পাঠকের ধৈর্যচ্যূতি ঘটবে। এই নিবন্ধের লক্ষ্যও তা নয়। কাজেই যেকথা বলা প্রয়োজন তাতে মনোনিবেশ করাই বরং শ্রেয়।
জাতি-ধর্ম নির্বিবেশে প্রকৃত ধার্মিকেরাও মিলনের কথা, সম্প্রীতির কথা, ভালোবাসার কথা, মানুষে মানুষে সহমর্মিতার কথা বলে থাকেন। যাঁরা মনুষ্যত্ব ও মানবিকতাকে যাপনচিত্রের অন্যতম অঙ্গ হিসেবে মনে করেন। গভীরভাবে বিশ্বাস করেন। সেই বিশ্বাস থেকেই তাঁরা বিভেদ-বিদ্বেষ নয়, পারস্পারিক সদ্ভাবের কথা বলেন। এমনকি, অনেক ‘নাস্তিক’ ও জাতি-ধর্ম নির্বিবেশে পারস্পারিক সদ্ভাবের কথা বলেন।
এ প্রসঙ্গে কিছু ব্যক্তিগত কথা উল্লেখ করা হয়তো তেমন অপ্রাসংগিক হবেনা। তা প্রায় বছর পঞ্চাশেক আগের কথা। আমাদের গ্রামের বাড়িতে প্রতিদিন বিকেলে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে আশপাশের গ্রাম থেকে অনেকেই জড়ো হতেন। এই লেখকের শিক্ষাজীবী পিতৃদেব সমাজসেবিও ছিলেন। আইন সংক্রান্ত ব্যাপারে বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। ফলে আইনি বিষয়ে অনেকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ নিতেন পরোপকারি পিতৃদেবের কাছ থেকে।
অনেকেই কমবেশি জানেন, গ্রাম-গঞ্জে জমিজমা সংক্রান্ত বিষয়ে অনেক শরিকি বিবাদ লেগেই থাকে। গরিব গ্রামবাসীদের পক্ষে আইনজীবীর কাছে ছুটে যাওয়া সেসময়ে মোটেই সহজ ছিল না। তাছাড়া সে সময়ে গ্রামে কোনও আইনজীবীও ছিলেন না। যাঁরা ছিলেন তাঁরা শহরের দিকে। ফলে আইনি বিবাদে পিতৃদেবের কাছ থেকে পরামর্শ নেওয়াটাই সকলে শ্রেয় মনে করতেন। বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত গড়াত সে বৈঠক।
হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের অগ্রণি মানুষের সঙ্গে এই বৈকালিক বৈঠকে পাশের গ্রাম থেকে একজন বয়স্ক হাজি সাহেবও আসতেন। তাঁর নামটা আজ আর স্মরণে নেই। তিনি কথা কম বলতেন; কিন্তু মন দিয়ে সব আলোচনা শুনতেন। তারপর বৈঠক শেষে উঠে পড়তেন। ধর্মীয় আলোচনাও যে হতো না, তা নয়। বিশেষ করে রামায়ণ-মহাভারতের যুক্তিযুক্ত ব্যাখ্যাও করতেন পিতৃদেব। গীতা-পুরান-উপনিষদ নিয়েও।
ভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষেরা ধর্মীয় আলোচনায় কখনও বিরক্তি প্রকাশ করতেন না। এমনকি, পবিত্র কোরানের বিষয় নিয়েও আলোচনা চলতো। জাতি-ধর্ম নির্বিবেশে সহনশীলতার অনন্য নজির রেখেছিলেন গ্রামের মানুষেরা। আমরা সবাই হাজি সাহেবকে খুবই শ্রদ্ধার চোখে দেখতাম। সেসময়ে সুদূর মক্কা থেকে হজ করে আসা কম হ্যাপার ব্যাপার ছিল না। তাই সমাজে হাজি সাহেবদের কদর ও সম্মান দুই-ই ছিল অনেক বেশি।
আগে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সামাজিক বন্ধন বেশ অটুট ছিল। সাম্প্রদায়িক ঠোকাঠুকি যে একেবারেই হতো না; তা নয়। তবে সর্বত্র তা তেমন বড়ো আকার ধারণ করেনি কখনও। আজকের মতো সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ-বিভেদ মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়নি। অনেক সময় আবার একই সম্প্রদায়ের মধ্যেও বেশ ঠোকাঠুকি হতো। ওই ঠোকাঠুকি থেকে খুনোখুনি পর্যন্ত। দেখা গেছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জমিজমা সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য, পবিত্র কোরান তথা ইসলামধর্ম মতে, মূর্তিপুজো গুনাহ বা পাপ। অথচ গ্রামের দুর্গোৎসব কিম্বা কালীপুজোয় হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মানুষই উৎসবের আনন্দে অংশ নিতেন। তাঁরা ধর্মীয় বিধি-নিষেধ বা কড়া অনুশাসন নিয়ে তেমন একটা মাথা ঘামাতেন না। তাঁদের মাথায় কেউ তা ঢোকানোর অপ-চেষ্টাও বোধহয় সেভাবে করেননি। সেকালে ধর্মের চেয়েও পারস্পারিক সদ্ভাবটাই ছিল অনেক বড়ো।
পবিত্র কোরানের কথা ও কাহিনি গ্রামের গরিব মুসলমানেরা লোকমুখে শুনেছেন বটে; কিন্তু অনেকেই হয়তো ওই ধর্মগ্রন্থটি জীবনে একবার চোখেও দেখেননি। সারাগ্রাম খুঁজেও একখন্ড কোরান মিলতো কিনা সন্দেহ। একমাত্র আলেম-মৌলভি ছাড়া গ্রামে আরবি বা উর্দু জানা লোক কোথায়? মৌলভিরা যা বোঝাতেন, তাই সরল মনের মুসলমান মানুষেরা কায়মনোবাক্যে বিশ্বাস করতেন। এভাবেই অনেক প্রক্ষিপ্তকথা ঢুকে পড়তো।
প্রায় সব গ্রাম-গঞ্জেই একে অপরের বিপদে-আপদে সবাই ঝাঁপিয়ে পড়তেন। জাতপাত বিচার করতেন না। সামাজিক পরিবেশটাই ছিল তখন বেশ অন্যরকম। কবির কথায়, ‘আবাদ করে বিবাদ করে সুবাদ করে তারা।’ কিন্তু ভ্রষ্ট রাজনীতির উত্থান সবকিছুকে বদলে দিয়েছে। মানুষের সঙ্গে মানুষের বিভেদ-বিদ্বেষ এনে দিয়েছে। বিশেষ করে ভোটের কুটিল ও নোংরা রাজনীতির বিষফল এই অনাকাঙ্ক্ষিত বিভেদ-বিদ্বেষ।
বলতে কোনও দ্বিধা নেই, আমরা যতোই দুর্গোৎসবকে ‘বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব’ বলে প্রমাণ করার [অপ]চেষ্টা করি না কেন, এপাড় ওপাড় দুই বাংলা মিলিয়ে বাঙালিদের একটা মোটা অংশই তো সম্প্রদায়গত ভাবে মুসলমান। সুতরাং দুর্গোৎসবকে কখনই ‘বাঙালির উৎসব’ বলাটা বোধহয় ঠিক নয়। ভাবলে অবাক লাগে, আজও অনেক শিক্ষিত হিন্দু বাঙালি বাংলা ভাষাভাষি মুসলমানদের বাঙালি মনে করেন না।
তাদের কাছে, মুসলমান মানেই অবাঙালি। সমস্ত বাংলা ভাষাভাষি মানুষই যে বাঙালি- তা এদের শিক্ষিত-মস্তিষ্কে ঢোকেনা। অথচ এরাই আবার অনেক বড়ো বড়ো বিষয় নিয়ে কথাবার্তা বলেন। বিশ্বের তাবড় তাবড় বিষয় জানেন। না জানলেও জানার ভান করেন। জানেন না শুধু নিজেদের ভিতরের সহজ-সরল কথাটি। এই উদাসীনতা, এই নির্লিপ্ততা কোনও ভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। কিন্তু মেনে নিতে হয়।
যেমন মাদ্রাসা সম্বন্ধেও অনেকে ভুল জানেন। মাদ্রাসার সঙ্গে প্রাচীন টোলের মিল খুঁজে বেড়ান। মাদ্রাসা শব্দটির অর্থ যে স্কুল বা বিদ্যায়তন- তাও অনেকে জানেন না। ৩ভাগে বিভক্ত মাদ্রাসার একটা ভাগ যে রাজ্যের স্কুলশিক্ষা বোর্ডের অনুমোদিত এবং সেখানে বোর্ড অনুমোদিত পাঠ্যসূচি অনুসরণ করেই পড়ানো হয়- তাও জানেন না৷ না জেনে, না বুঝেই অনেকে নানা বিভ্রান্তিকর মন্তব্য করেন। যা সমাজের পক্ষে ক্ষতিকর।
ওইসব মাদ্রাসায় যে অন্য সম্প্রদায়ের ছাত্রছাত্রীরাও পড়াশোনা করে এবং সেখানে শিক্ষাদানের সঙ্গেও যে অনেক অ- আসলে জানার চেষ্টাও করেন না। মুসলমান শিক্ষক-শিক্ষিকা নিযুক্ত আছেন- তাও বোধহয় অনেকের অজানা। আমরা একটা নির্দিষ্ট গন্ডির মধ্যে সত্যিকথা বলতে কি, জানার চেষ্টাটাই বোধহয় আমাদের হারিয়ে গেছে। নিজেদেরকে বন্দি করে রেখেছি। যেখান থেকে বেরনোর সাধ্য থাকলেও সাধ নেই। আমাদের ভিন্ন সম্প্রদায়ের প্রতিবেশিদের উৎসব-অনুষ্ঠান সম্বন্ধেও আমরা প্রায় কিছুই জানিনা; জানার চেষ্টাও করি না। কারণ জানার আগ্রহই তো নেই। ঈদের যে রকমভেদ [ঈদ-উদ-জোহা ও ঈদ-উল-ফিতর] আছে তা জানিনা। ফতেহা-দোয়াজ-দাহাম কিম্বা মহরম সম্বন্ধেও কোনও ধারণা নেই। মুসলমান সম্প্রদায়ের অন্যান্য পার্বণ সম্বন্ধেও একেবারেই অজ্ঞ। এই অজ্ঞতাই আমাদেরকে পরস্পর পরস্পরকে দূরে সরিয়ে রেখেছে।
অস্বীকার করার উপায় নেই, একে অপরের থেকে দূরে থাকার দরুন নানাবিধ বিভ্রান্তি ও ভুল বোঝাবোঝি তৈরি হয় পরস্পরের মধ্যে। এই বিভ্রান্তি ও ভুল বোঝাবোঝি থেকে ক্রমশঃ বিভেদ-বিদ্বেষ জন্ম নেয়। অনেকে অবশ্য এও বলেন, যে, উনিশ শতকের রেনেসাঁস থেকে বাঙালি মুসলমানেরা নিরাপদ দূরত্বে ছিলেন; তার কোনও সুফল গ্রহণ করতে পারেননি। একথার যথার্থতা হয়তো কোনওভাবে অস্বীকার করাও যায় না।
কিন্তু যারা ওই নবজাগরণের সুফল গ্রহণ করেছেন, চেটেপুটে খেয়েছেন, তারাও [বাঙালি হিন্দুসমাজ] কেন আজও উদার মনের অধিকারি হতে পারেননি? এমন সঙ্গত প্রশ্নও তো করা যেতে পারে। আসলে ধর্মীয় কুসংস্কার থেকে কোনও সম্প্রদায়ের মানুষই নিজেদেরকে মুক্ত করতে পারেননি। ‘ধর্মীয় অনুশাসন’ কে ধ্রুবসত্য মেনে চলতে অভ্যস্থ মানুষ তার প্রিয় প্রতিবেশীকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। একে অস্বীকার করি কিভাবে?
দীর্ঘকাল পাশাপাশি বাস করেও আমাদের মধ্যে কোনও রকম আত্মিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে দেয়নি। সবটাই যেন প্রক্ষিপ্ত মনে হয়। আমাদের মুখের ভাষা এক। আমাদের শিক্ষা-সংস্কৃতি প্রায় এক। বেশভূষা আর খাওয়া-দাওয়াও প্রায় এক। অথচ একে অপরকে জানা-বোঝার চেষ্টা করি না। ‘ওরা তো অন্য সম্প্রদায়ের-ওদের নিয়ে আমাদের মাথা ঘামানোর কি আছে?’ এমন একটা উদাসীনতা কাজ করে আমাদের মধ্যে।
এই উদাসীনতা, এই নির্লিপ্ততার মূলে বোধহয় পরিচয়হীনতা। একে অপরকে না জানলে দূরত্ব ঘুচবে কিভাবে? এভাবেই উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদের প্রাচীর গড়ে উঠেছে। সেই প্রাচীর ভাঙার চেষ্টা দু’-চারজন শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী-মনীষী করলেও তাতে এযাবৎ কাজের কাজ কিছু হয়নি। সমাজের ব্যাপক মানুষের কাছে সেই প্রয়োজনীয় বার্তাটুকু ঠিকভাবে পৌঁছয়নি। ফলে আমাদের ভিতরকার অন্ধকার ঘোচেনি।
আজকের দিনে সমাজের ওপরতলার মানুষ ধর্মীয় অনুশাসন অনেকেই হয়তো সেভাবে মানেন না; কিন্তু ধর্মীয় প্রাচীর ভেঙে এগিয়ে আসার চেষ্টাও কিন্তু তেমন করেন না। যে ধর্মীয় ও সামাজিক সংস্কার প্রয়োজন ছিল তা কিন্তু হয়নি। মানুষের মনে মনুষ্যত্ব ও মানবিকতার বীজ পুঁতে দেওয়া যায়নি। যে বীজ থেকে অঙ্কুরিত চারাগাছটি একদিন মহীরূহ হয়ে দেখা দিতে পারতো আমাদের মধ্যে। এদিক থেকে আমরা পুরোপুরি ব্যর্থ।
চতুর ইংরেজদের ‘বিভাজন ও শাসন’ নীতি নিয়ে আমরা সমালোচনায় বেশ উচ্চকিত হই। ইংরেজশাসক এদেশ থেকে বিদায় নিয়েছে বটে; কিন্তু তাদের ফেলে যাওয়া [অপ]নীতিকে আজও আঁকড়ে আছি আমরা। দিল্লির এখনকার শাসকদের মধ্যেও এই বিভাজনি দোষ অত্যন্ত প্রকট। তারা প্রকাশ্যেই বিভাজন নীতিকে শুধু প্রশ্রয় নয়, আশ্রয় করে শাসনকার্য চালাতে অভ্যস্থ। অন্য শাসকেরাও করেন তবে গোপনে। কিছুটা নরম পথে।
কিন্তু আমরা যারা এসবের তীব্র নিন্দা করি, সমালোচনা করি, তারা নিজেরাও যে ওই একই দোষ থেকে মুক্ত-তা কিন্তু নয়। বলা যায়, একই দোষে দোষী; যদিও তা কখনও ভুলেও স্বীকার করিনা। শুধু অন্যের ত্রুটি খুঁজে বের করার মধ্য দিয়ে নিজেদেরকে ত্রুটি-মুক্ত তথা নির্দোষ প্রমাণের [অপ] চেষ্টা করি। বিভিন্ন সভা-সমাবেশে নিজেকে অ-সাম্প্রদায়িক প্রমাণের চেষ্টা করি। সাজানো-গোছানো কথায় ব্যস্ত রাখি নিজেদেরকে।
আমাদের হাতের কাছেই লালন ফকির [সাই]। তাঁর গানে আমরা অনেকেই উৎফুল্ল হই। তাঁকে নিয়ে বড়ো বড়ো কথা বলি। কিন্তু বাউল-ফকিরদের গানের মর্মার্থ বোঝার চেষ্টা করিনা। এই উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠতম মানুষ লালন। জাতপাতের উর্ধে তাঁর দর্শন বিশ্বমানবতার পথ দেখায়। অথচ তাঁর মহতি দর্শনকেই অগ্রাহ্য করি। ‘সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে-‘ শুনেও আমাদের ভ্রান্তি ঘোচেনা। জাতপাতের পঙ্কিলে মজে থাকি।
আমাদের হাতের কাছেই আছেন নজরুল-রবীন্দ্রনাথ-সুভাষচন্দ্র-গান্ধীজি। যাঁরা সম্প্রীতি তথা বিশ্বমানবতার শ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি। কিন্তু তাঁদের ভক্তি-শ্রদ্ধা করলেও তাঁদের দেখানো পথে হাঁটি না। বছরে দু’-দু’বার তাঁদের পুজো করি; কিন্তু তাঁদের আদর্শ থেকে দূরে থাকি। ‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম’ এমন স্বতঃস্ফূর্ত উচ্চারণ করতে আজ আমরা অপারগ। কারণ স্বীকার করি বা না-ই করি, আমাদের মনের মধ্যে বিষ ঢুকে গেছে।
ওই বিষই আমাদেরকে বিপথে চালিত করে। বিভেদ-বিদ্বেষের দিকে তাড়িত করে। প্রতিবেশিকে কাছে টেনে নেওয়া নয়, অকারণে আঘাত করার প্রেরণা জোগায়। অথচ নিজেদেরকে প্রগতিশীল অ-সাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ প্রমাণ করার জন্য কি আপ্রাণ প্রচেষ্টা। সবটাই আসলে লোক-দেখানো। সত্যিকথা বলতে কি, বিষমুক্ত হওয়ার ইচ্ছেটাই আমাদের নেই। চিন্তা-চেতনায় নিজেকে উন্নত করার, সমৃদ্ধ করার স্পৃহাটাই হারিয়েছি।