২০২৬ বিধানসভার ভোট নিয়ে এখন থেকেই রাজ্যের রাজনৈতিক দলগুলির মাতামাতি। ওই বছর যদি মে মাসে ভোট হয়, তাহলেও এখন এক বছরের বেশি সময় হাতে রয়েছে। কিন্তু শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস আর রাজ্যের অন্য দলগুলির আর তর সইছে না। ভোটের প্রস্তুতির কাজে মাঠে নেমে পড়েছে সব দলই। কী বার্তা পেল এই দলগুলি ছাব্বিশের নির্বাচন নিয়ে?
তৃণমূলের চতুর্থবার এই ভোটের ফল তথা জেতা নিয়ে কোনও সংশয় নেই। সেকথা দলনেত্রী ও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্প্রতি দলীয় এক বড় সমাবেশে স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছেন। তাঁর ঘোষণা, তৃণমূল দুই-তৃতীয়াংশ আসন পেয়ে চতুর্থ বারের জন্য ক্ষমতায় থাকবে। এবং তিনি তো মুখ্যমন্ত্রী হবেনই। এই নিয়ে চতুর্থবার। তাঁর এই ঘোষণাকে যদি গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়, তাহলে বিজেপি সহ অন্যান্য দলগুলির ভোটের জন্য দৌড়িয়ে লাভ কী? না, তা ঠিক নয়। জিততে সবাই চায়। তাই সবারই প্রস্তুতি। মুখ্যমন্ত্রী দলীয় নেতা-কর্মী এবং দলের জনপ্রতিনিধিদের নির্দেশ দিয়েছন ভোটার তালিকা সাফাই করতে। অর্থাৎ যেসব ভুয়ো ভোটাররা স্থান পেয়েছে ভোটার তালিকায় তা খুঁজে বের করতে হবে এবং আইনানুযায়ী তাদের বাদ দিতে হবে। ভোটার তালিকা স্বচ্ছ ও নির্ভুল হোক, তা মুখ্যমন্ত্রী কেন, সব দলই চায়। কিন্তু এ পর্যন্ত যতগুলি নির্বাচন হয়েছে ভোটার তালিকায় ভূতদের তাড়িয়ে হয়েছে? হয়নি। ভুয়ো ভোটার থাকবে, থাকবে মৃতদের নামও— তাদের হয়ে ভোট দেবে অন্যরা।
মুখ্যমন্ত্রীর এই সাফাই কাজে নেমে পড়েছে দলের নেতা-কর্মীরা— তাঁরা ভোটার তালিকা সঙ্গে করে নিয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে নাম মিলিয়ে দেখছেন। উত্তরবঙ্গ থেকে দক্ষিণবঙ্গে তালিকা সংশোধনের কাজ শুরু হয়েছে। নিঃসন্দেহে ভালো কাজ। ভোটাররাও চায় একটি স্বচ্ছ ভোটার তালিকা। যদিও মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, তাঁর দলের বড় জয় নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই— কিন্তু রাজনীতির কথা কি বলা যায়? কোথাকার জল কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, সবশেষে কী হবে তার পরিণতি তা কি আগ বাড়িয়ে. বলা যায়? তবে অনেক সময় সেই প্রবাদ বাক্য ‘মরা শামুকেও পা কাটে’। তৃণমূলের অবশ্য সে ভয় নেই। কারণ মুখ্যমন্ত্রীর জনহিতকর কাজের জন্যই রাজ্যের মানুষ এত উপকৃত যে তাঁরা মুখ্যমন্ত্রীর দিকে তাকিয়েই তৃণমূলকে ভোটে জেতায়। কিন্তু তবুও ভোট নিয়ে একটু চিন্তা থেকেই যায়। আরজি কর কাণ্ড, দুর্নীতি, আইনশৃঙ্খলাজনিত নানা অপ্রীতিকর ঘটনা নিয়ে বিরোধীরা শাসক দলের বিরুদ্ধে প্রচারে নামবে। মানুষ তাতে কতটা ভুলবে তা বলা কঠিন। তবে দলের বিকল্প এই সব অপবাদ যে ভিত্তিহীন, তা নিয়ে তৃণমূল নেতারাও রাজ্যের মানুষের দরবারে যাবে। এই সব যে ভোটে প্রভাব পড়ে না, তা বোঝা গেল কিছুদিন আগে ছয়টি বিধানসভার উপনির্বাচনে। রাজনৈতিক পণ্ডিতরা বলেছিলেন, আরজি কর কাণ্ড এবং অন্যান্য ঘটনা তৃণমূলের জয়ে বাধা হতে পারে। কিন্তু তা হয়নি। বরং সবগুলি আসনেই বড় ব্যবধানে তৃণমূল প্রার্থীরা জয়ের মুখ দেখেছে। বিজেপি-বামেদের শোচনীয় পরাজয় ঘটেছে। এমনকি উত্তরবঙ্গের একটি কেন্দ্রে তৃণমূল কোনওদিনই জয়ের মুখ দেখেনি— সেখানেই তৃণমূল প্রার্থীর জয়।
পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে বিজেপির মাথাব্যথা আর যাচ্ছে না। এই রাজ্যে ভোট এলে গৈরিক পতাকা ওড়ানোর কত চেষ্টাই না করছে। কিন্তু প্রতিবার বিফল। তাই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বিজেপি নেতা-কর্মীদের নিরাশ না হয়ে এখন থেকেই এই রাজ্য জয়ের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশ জারি করেছেন। কিন্তু রাজ্য বিজেপির দুর্দশা তো আর কাটছে না। কী করে শাসক দলের বিরুদ্ধে লড়াই করে জেতা যায়, সেই শক্তি এই দলের নেই। তাছাড়া রাজ্য বিজেপির নেতাদের মধ্যেও একতার অভাব। একমাত্র বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীকে সক্রিয় দেখা যাচ্ছে। দলের পুরো সময়ের জন্য সভাপতি নেই— যিনি এখন সভাপতি সুকান্ত মজুমদার, তিনি আবার দলের সাংসদ। সুতরাং তাঁর পক্ষে দলের কাজে পূর্ণ সময় দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। আছেন প্রাক্তনসভাপতি দিলীপ ঘোষ— তিনি এখন দলে থেকেও নেই। প্রাতঃভ্রমণকালে সাংবাদিকদের সঙ্গে দেখা হলে তিনি সরকারের বিরুদ্ধে দু-চার কথা বলেন। কিন্তু দলের সাংগঠনিক শক্তি বাড়ানোর জন্য কোনও চেষ্টা করতে তাঁকে দেখা যায় না। ভোটের প্রচারে প্রধানমন্ত্রী, গৃহমন্ত্রী অমিত শাহ, মন্ত্রী-সভাপতি জে পি নাড্ডা আসবেন।
কংগ্রেস দরজা খোলা রেখেই ছাব্বিশের নির্বাচনের প্রারম্ভিক কাজ আরম্ভ করেছে। সম্ভবত কংগ্রেস একাকীই লড়বে। আপাতত রাজ্যের ৯০ আসনে কংগ্রেস তার প্রার্থী দেবে। বামেদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে গত লোকসভা বিধানসভার ভোটে লড়ে কোনও লাভ হয়নি। বিধানসভায় সিপিএমের কোনও মুখ নেই, নেই কংগ্রেসেরও। সিপিএম নেই ঠিক করেছে তাদের সহযোগী দলগুলির সঙ্গে সমঝোতা করে এই ভোটের আসরে নামবে।
কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধি ইতিমধ্যেই রাজ্যের কংগ্রেস নেতা-কর্মীদের বলেছেন, এখন থেকেই ছাব্বিশের নির্বাচনের প্রস্তুতিনিতে। প্রচারে তিনি আসবেন, আসবেন তাঁর বোন প্রিয়ঙ্কা গান্ধি, কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে এবং অন্যান্য সর্বভারতীয় কংগ্রেস নেতা। সিপিএম সদ্য অনুষ্ঠিত সম্মেলনে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সহযোগী দলগুলির সাথে আসন সমঝোতা করে ভোটে লড়ার। সিপিএম যুবশক্তিকে এবারের প্রচারে নামাবে। সিপিএমের নেতারা বলেছেন, তৃণমূলের অপশাসন, নানা দুর্নীতি, শিক্ষক নিয়োগে নানা কারচুপি ইত্যাদি প্রচারের হাতিয়ার করবে। ভোটার তালিকা থেকে ভুয়ো ভোটার বাদ দেওয়ার অভিযানেই দলের নেতা-কর্মীরা এখন থেকেই নামার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।