বন্দুক নয়, অস্ত্র ছিল ক্যামেরা। এতেই আপত্তি ট্রাম্পের বন্ধু রাষ্ট্র ইজরায়েলের। পৈশাচিক উল্লাসে নরহত্যার কোনও প্রমাণ যাতে না থাকে তার জন্য ‘সফট টার্গেট’ সাংবাদিকরাই। পরিবার-পরিজন সবাইকে ছেড়ে, মাথায় হেলমেট আর গায়ে প্রেস লেখা জ্যাকেট পরে, গাজায় ইজরায়েলের ‘সাফাই অভিযান’-এর মর্মান্তিক বাস্তবতাকে গোটা বিশ্বের সামনে তুলে ধরার কাজ করে গেছেন বছর পঁয়ত্রিশের মারিয়াম দাগ্গা। আঙুলের মৃদু চাপে এক রাতে একেকটা গোটা পরিবারকে মুছে দেওয়া, সন্ত্রাসবাদ দমনের নামে সেনাদের গুলিতে ঝাঁঝড়া হয়ে যাওয়া ছোট ছোট শিশুদের দেহ, নির্দ্বিধায় হাসপাতাল, স্কুল বা বম্ব শেল্টারে বোমা ফেলে নিমেষেদের মধ্যে কয়েক শত নিরীহ মানুষকে মেরে ফেলা, তারপর ত্রাণের খাদ্য সরবরাহ আটকে গোটা শহরে কৃত্রিম আকাল তৈরি করা, হাজার হাজার মানুষকে ‘ভাতে মারার’ পরিকল্পনা, সেই ক্ষুধার্ত মানুষ যখন ত্রাণের লাইনে ভিড় করেন, তাঁদের উপর এলোপাথাড়ি গুলি চালিয়ে সেনাবাহিনীর পৈশাচিক উল্লাস— এসবই গোটা দুনিয়ার সামনে তুলে ধরেন মারিয়াম ও তাঁর সহকর্মীরা। ক্যামেরাকে সম্বল করেই এই অসম লড়াইয়ে সামনের সারিতে ছিলেন মারিয়ামরা।
যথারীতি মারিয়ামদের খতম করতেই হতো। সম্প্রতি গাজার আল-নুসেরাইত হাসপাতালের বাইরে বিমান হানায় মারিয়াম সহ আরও ৫ সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। কোনও দুর্ঘটনা নয়। ‘পরিকল্পিত’ভাবেই হামলা করে তাঁদের হত্যা করা হয়েছে। ছিন্নভিন্ন দেহের পাশে পড়ে ছিল মরিয়ামের সেই রক্তমাখা ক্যামেরা। গাজা গণহত্যার বাস্তবতা তুলে ধরাই ছিল তাঁদের অপরাধ। তবে এই ঘটনা মোটেই নতুন নয়। এর দিন কয়েক আগে আরও ৭ সাংবাদিককে এভাবেই পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছিল ইজরায়েল। মারিয়াম দাগ্গা, ইব্রাহিম জাহের, নেরমিন কাওয়াস, আবু মাহদির মতো ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে মোট ২৭৮ জন সাংবাদিককে গাজায় হত্যা করেছ ইজরায়েল। এর মধ্যে ২৭৩ জন প্যালেস্তাইনের নাগরিক, ৩ জন লেবাননের নাগরিক এবং ২ জন ইজরায়েলের নাগরিক। সত্যি কথা বলায় ইজরায়েলের অতি-দক্ষিণপন্থী সরকার স্বদেশের নাগরিকদেরও রেহাই দেয়নি।
Advertisement
এই ২৭৮ জন সাংবাদিকের হত্যার প্রতিবাদে নেমেছে দেশ-বিদেশের সংবাদমাধ্যম। বিশ্বজুড়ে ৫০টিরও বেশি দেশের প্রায় ২৫০টি সংবাদমাধ্যম প্রতিবাদে একজোট হয়েছেন। তাঁদের মূল বার্তা— ‘যেভাবে গাজায় ইজরায়েলি সেনার হাতে সাংবাদিকরা খুন হচ্ছেন, তাতে অচিরেই সঠিক খবর পৌঁছে দেওয়ার জন্য ওখানে আর কেউ অবশিষ্ট থাকবে না।’ গাজায় সাংবাদিক হত্যার বিরুদ্ধে এবং ওই শহরে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করার দাবিতে এই প্রথমবার বিশ্বজুড়ে প্রায় ২০০টি সংবাদ সংস্থা একযোগে তাদের প্রথম পাতা, ওয়েবসাইটের হোমপেজ এবং সম্প্রচার কার্যক্রম ব্যাহত করেছে।
Advertisement
এই বিশ্বব্যাপী পদক্ষেপে একজোট হয়েছে ‘রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স’ (আরএসএফ), আওয়াজ এবং ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব জার্নালিস্টস (আইএফজে)-র মতো বিভিন্ন সংবাদকর্মী সংস্থা। সাংবাদিক ও সম্পাদকরা একযোগে এই প্রতিবাদে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছেন। তাঁরা মনে করেন, এটা শুধু গাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধ নয়, সাংবাদিকতার বিরুদ্ধেও যুদ্ধ। সাংবাদিকদের হত্যা করা হচ্ছে, টার্গেট করা হচ্ছে, অপমান করা হচ্ছে। তাঁরা না থাকলে কে দুর্ভিক্ষের কথা বলবে, কে যুদ্ধপরাধ প্রকাশ করবে, কে গণহত্যার সত্য উন্মোচন করবে? রাষ্ট্রসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদের রেজোলিউশন ২২২২ গৃহীত হওয়ার এক দশক পর আমরা প্রত্যক্ষ করছি আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন এবং সাংবাদিক সুরক্ষার নিশ্চয়তার ক্ষয়িষ্ণু চিত্র। এই পরিস্থিতিতে বিশ্বজুড়ে সাংবাদিকদের সংহতি ও ভ্রাতৃত্বই সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রক্ষার একমাত্র আশ্রয়।
Advertisement



