• facebook
  • twitter
Saturday, 6 December, 2025

আজ পরিযায়ী পাখি দিবস

ভারতের চরাঞ্চলে নীল-গলা ফিদ্দা (Bluethroat), সাইবেরীয় চুনিকন্ঠী (Siberian Rubythroat) পাখিরা আসে প্রতিকূল আবহাওয়া থেকে মুক্তি পেতে।

প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র

হীরক কর

শীত আসা মানেই পরিযায়ী পাখিদের এদেশে আসা। সাঁতরাগাছি ঝিল, বা আলিপুর চিড়িয়াখানার ঝিলে পরিযায়ী পাখিদের আগমনের কথা আমরা কে না জানি।

Advertisement

পরিযায়ী পাখিকে পরিব্রাজক বা যাযাবর পাখিও বলা হয়। পরিযায়ী পাখি বলতে সাধারণভাবে আমরা বুঝি, যারা শীতের সময় বহু পথ পেরিয়ে আমাদের দেশে আসে এবং কিছুদিন অবস্থান করে।

Advertisement

পরিযায়ী প্রজাতি অর্থ ওই সব বন্যপ্রাণী, যারা এক বা একাধিক দেশের ভৌগোলিক সীমানা অতিক্রম করে বছরের একটি নির্দিষ্ট সময় আসা-যাওয়া করে থাকে।

বিশ্ব পরিযায়ী পাখি দিবস পালিত হয় অক্টোবর মাসের ১০ ও ১১ তারিখ। নানা কারণে পাখিরা একটি নির্দিষ্ট সময়ে তার আবাসস্থল ছেড়ে অন্য দেশে যায়। আর তার এই ভ্রমণ পরিক্রমায় নানা দুর্যোগ ঘটে। আর তারই ফলশ্রুতিতে এই দিবসের (World Migratory Bird Day) সূচনা। মূলত ২০০৬ সালে রাষ্ট্রসঙ্ঘ কর্তৃক শুরু হয়েছিল। রাষ্ট্রসঙ্ঘের আফ্রিকান-ইউরেশিয়ান পরিযায়ী জলপাখি সংরক্ষণ চুক্তি (UNEP-AEWA) এবং বন্য প্রাণী সংরক্ষণ কনভেনশনের সচিবালয়ের (CMS) সহযোগিতায় এই দিবস শুরু হয়, যাতে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে পাখির স্থানান্তর এবং তাদের সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তার প্রতি বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায়।
পৃথিবীতে প্রায় ১২ হাজার প্রজাতির পাখি আছে, তার এক-তৃতীয়াংশই পরিযায়ী পাখি। ভারতে ৭০০-র অধিক প্রজাতির পাখি পাওয়া যায়। তার মধ্যে প্রায় ৩০০ প্রজাতির পরিযায়ী পাখির দেখা মেলে।

বেশিরভাগ জলচর পাখি পরিযায়ন করে সমুদ্রের সীমারেখা ধরে। এদের মধ্যে কিছু পাখি বঙ্গোপসাগর থেকে নদীর উজানে উড়তে উড়তে বিভিন্ন জলাশয়ে আশ্রয় নেয়। সারস, ঈগল, বাজসহ বেশ কিছু পরিযায়ী পাখি মধ্য ও উত্তর ইউরোপ থেকে সরাসরি ভারতীয় উপমহাদেশে পরিযায়ন করে। পরিযায়ী পাখিদের এক বিস্ময়কর প্রজাতি দাগী মাথা রাজহাঁস (Bar-headed Goose) পাখি৷ বিজ্ঞানীদের মতে, এরা পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচুতে উড়তে সক্ষম।

ভারতের পরিযায়ী পাখিদের একটি বড় অংশ ঘাসবনের পাখি। এরা সাধারণত রাতের বেলা অন্ধকারে দলবেঁধে পরিযায়ন করে। পাখি বিজ্ঞানীদের মতে, এরা মূলত শিকারি পাখিদের আক্রমণ থেকে নিজেদের রক্ষা করতে রাতের অন্ধকারে পরিযায়ন করে।

ভারতের চরাঞ্চলে নীল-গলা ফিদ্দা (Bluethroat), সাইবেরীয় চুনিকন্ঠী (Siberian Rubythroat) পাখিরা আসে প্রতিকূল আবহাওয়া থেকে মুক্তি পেতে। নীললেজ সুঁইচোরা (Blue tailed Bee Eater) পাখিরা ভারত উপমহাদেশ জুড়ে পরিযায়ন করে উপযুক্ত প্রজনন ভূমির খোঁজে। ইউরোপ থেকে লম্বা-লেজ তিশা বাজ (Long Legged Buzzard), মঙ্গোলিয়া থেকে স্টেপ ঈগল (Steppe Eagle) ভারতে আসে সহজ খাদ্য শিকারের জন্য।

পরিযায়ী পাখিদের মধ্যে ভারতে সবচেয়ে পরিচিত হচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির হাঁস। এদের মধ্যে ভারতে ১৭ প্রজাতির হাঁস পরিযায়ন করে। পরিযায়ী পাখিগুলো আমাদের দেশে বিল, ঝিল, হাওর, বাওড়, হ্রদ, নদ, নদী, নালা, সাগর ও জলাভূমিতে বাস করে থাকে।

আমাদের দেশে অধিকাংশ মানুষের ধারণা, পরিযায়ী পাখি মূলত মাছ খেয়ে জীবনধারণ করে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে পরিযায়ী পাখিরা ভাসমান জলজ উদ্ভিদ, ক্ষতিকর কীট-পতঙ্গ ও পোকামাকড়, শামুক, ব্যাঙাচি, জলজগুল্ম, শ্যাওলা ইত্যাদি খেয়েও জীবনধারণ করে। কিছু পরিযায়ী পাখি ছোট মাছ খেয়ে থাকে।

পরিযায়ী পাখিরা শুধুমাত্র নিজেদের প্রশান্তির জন্যই আমাদের দেশে আসে না। আমাদের দেশে অতিথি হয়ে আসা এসব পাখি নানাভাবে আমাদের উপকারও করে চলেছে প্রতিনিয়ত। কিন্তু এ দেশের একশ্রেণীর মানুষ অর্থ, বিত্ত, ক্ষমতা ও আভিজাত্যের বহিঃপ্রকাশ ঘটানোর জন্য পরিযায়ী পাখি শিকার করে। অনেকে বাজারে বিক্রির জন্য বিষটোপ, বাটুল, জালের ফাঁদ ও অন্যান্য বিভিন্ন ধরনের ফাঁদ ব্যবহার করে পরিযায়ী পাখি শিকার করে থাকে। শৌখিন শিকারিদের উদ্দেশ্য মাংস খাওয়া এবং ক্ষমতা ও আভিজাত্যর বহিঃপ্রকাশ। আর অন্যান্য শিকারিদের উদ্দেশ্য বাজারজাত করে স্বল্প পরিশ্রমে বেশি আয় করা।

বিশ্বজুড়ে পরিযায়ী পাখি সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে, পরিযায়ী পাখির গুরুত্ব সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে এবং প্রকৃতিতে পাখির অসামান্য অবদানের কথা বিবেচনা করে ২০০৬ সাল থেকে প্রতি বছর অক্টোবর মাসে আড়ম্বরপূর্ণভাবে পরিযায়ী পাখি দিবস উদযাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ।

২০১৭-র ২৬ অক্টোবর ম্যানিলায় CMS COP12 এর প্রান্তে, এনভায়রনমেন্ট ফর দ্য আমেরিকাস (EFTA), কনভেনশন অন মাইগ্রেটরি স্পেসিজ (CMS) এবং অ্যাগ্রিমেন্ট অন দ্য কনজারভেশন অফ আফ্রিকান-ইউরেশিয়ান মাইগ্রেটরি ওয়াটারবার্ডস (AEWA) বিশ্বব্যাপী পরিযায়ী পাখিদের দুর্দশা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য একটি ঘোষণা করে। আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্বে দুটি পাখি সংরক্ষণের দিন স্থির হয়—আন্তর্জাতিক পরিযায়ী পাখি দিবস (IMBD) এবং বিশ্ব পরিযায়ী পাখি দিবস (WMBD)-কে একত্রিত করে, যাতে পরিযায়ী পাখিদের বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি জোরদার করা যায়। এবং তাদের সংরক্ষণের জরুরি প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরা যায়। ২০১৮ সাল থেকে, “বিশ্ব পরিযায়ী পাখি দিবস”-এর একক নাম গ্রহণ করে এবং দিবসটি উদযাপনের জন্য প্রধান অনুষ্ঠানগুলো বছরে দুবার, মে মাসের দ্বিতীয় শনিবার এবং অক্টোবরে আয়োজন করা হয়।
ডব্লিউএমবিডি ২০২৫ সালে জোর দিয়েছে, শহর থেকে গ্রাম, যাতে- পরিযায়ী পাখিদের সহায়তায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

নগর সম্প্রসারণ এবং মানুষসৃষ্ট পরিবেশ, যদি সঠিকভাবে পরিচালিত না হয়, তাহলে এই পাখিদের জন্য উল্লেখযোগ্য বিপদ তৈরি হবে, যার ফলে তাদের আবাসস্থলের ক্ষতি হবে । সঠিক নগর উন্নয়নের জন্য ভাল পরিকল্পনায় পাখিদের আবাসস্থলের বিস্তার এবং ধ্বংস এড়ানো যায়। স্কুল এবং স্থানীয় সংস্থাগুলোর সঙ্গে সহযোগিতামূলক প্রচেষ্টার মাধ্যমে, সবাই পাখিদের রক্ষা করতে পারে এবং তাদের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে পারে। জীববৈচিত্র্যের উপর নগরায়নের নেতিবাচক প্রভাব কমতে পারে।

পাখি-বান্ধব” মানে আমাদের পরিবেশকে পাখিদের জন্য নিরাপদ এবং স্বাগত জানানো। আমরা স্থানীয় গাছপালা রোপণ করে, পরিষ্কার জল সরবরাহ করে এবং ক্ষতিকারক রাসায়নিকের ব্যবহার এড়িয়ে এটা করতে পারি। পরিবেশ রক্ষা করে, আমরা পাখিদের তাদের দীর্ঘ ভ্রমণে সাহায্য করতে পারি, এবং আমাদের পরিবেশকে আরও সুন্দর এবং স্বাস্থ্যকর করে তুলতে পারি। সারা বছর ধরে, আমরা পাখি-বান্ধব করে তুলতে কী কী পদক্ষেপ নিতে পারি তা অন্বেষণ করাই হবে পাখি রক্ষায় আমাদের পদক্ষেপ।

Advertisement