• facebook
  • twitter
Thursday, 18 December, 2025

সিন্ধুর নীরবিন্দু

১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সিন্ধু অববাহিকার উপনদীগুলির জলের বন্টন নিয়ে সংঘাত তৈরি হয়। দুই দেশ তখনও কৃষিনির্ভর।

ফাইল চিত্র

সিন্ধু নদ ও তার উপনদীগুলির জলপ্রবাহকে একসঙ্গে ‘ইন্দাস রিভার সিস্টেম’ বা সিন্ধু জল ব্যবস্থা বলা হয়। ভারত ও পাকিস্তান, এই দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতার সম্পর্ক বজায় রাখতে ১৯৬০ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর করাচিতে সিন্ধু জল চুক্তি (ইন্দাস ওয়াটার ট্রিটি বা আইডব্লিউটি) সম্পন্ন হয়। মধ্যস্থতা করে বিশ্বব্যাঙ্ক। স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু এবং পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আয়ুব খান এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন। চুক্তির বাস্তবায়নে পাকিস্তানকে অর্থ সাহায্যও করেছিল বিশ্বব্যাঙ্ক।

১৯৬০ সালে বিশ্বব্যাঙ্কের মধ্যস্থতায় হওয়া সিন্ধু জলচুক্তি বিশ্বের অন্যতম দীর্ঘস্থায়ী কূটনৈতিক বোঝাপড়া। এই চুক্তির ফলে এখনও পর্যন্ত দুই দেশের মধ্যে জলের ভাগাভাগি নিয়ে কোনও যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। বিভিন্ন সময়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়েন চলেছে। ১৯৬৫, ১৯৭১ এবং ১৯৯৯ এই তিন বছর ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হয়েছে। কিন্তু পরিস্থিতি যতই উত্তপ্ত হোক ১৯৬০ সালের সিন্ধু জলচুক্তির ওপর কোনও প্রভাব পড়েনি। পরিস্থিতি অবশ্য বদলে দিয়েছে পহেলগামে পাক সন্ত্রাসবাদীদের হাতে নিরীহ পর্যটকদের মৃত্যু।

Advertisement

১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সিন্ধু অববাহিকার উপনদীগুলির জলের বন্টন নিয়ে সংঘাত তৈরি হয়। দুই দেশ তখনও কৃষিনির্ভর। এই পরিস্থিতিতে ১৯৫২ সালের ৬ মে বিশ্বব্যাঙ্কের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইউজিন ব্ল্যাকের উদ্যোগে একটি বৈঠক হয় ওয়াশিংটনে। তারপর দীর্ঘ আট বছর ধরে জল ভাগাভাগি নিয়ে আলোচনা চলতে থাকে। শেষে ১৯৬০ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর করাচিতে সিন্ধু জলচুক্তি সম্পন্ন হয়। এই চুক্তি অনুযায়ী সিন্ধু অববাহিকার পূর্বদিকের ইরাবতী, বিপাশা, শতদ্রু নদীর জলের ওপর সম্পূর্ণ কর্তৃত্ব ভারতের। আবার পশ্চিম দিকের সিন্ধু, ঝিলাম ও চেনার— এই তিনটি নদীর জলের নিয়ন্ত্রণ পাকিস্তানের হাতে। সিন্ধু জল চুক্তিতে ভারত এই ব্যবস্থার মাত্র ২০ শতাংশ জল ব্যবহার করতে পারে। ৩৩ মিলিয়ন অ্যাকর-ফিট (এমএএফ) বা বছরে ৪১ বিলিয়ন কিউবিক মিটার (বিসিএম) জল পায় ভারত।

Advertisement

অন্যদিকে, সিন্ধু জল ব্যবস্থার ৮০ শতাংশ জলের নিয়ন্ত্রণ আছে পাকিস্তানের কাছে। ১৩৫ এমএএফ বা বছরে ৯৯ বিসিএম জলের কর্তৃত্ব প্রতিবেশী দেশের চুক্তিতে বলা আছে, পশ্চিম দিকের নদীগুলির (ঝিলম, চেনাব, সিন্ধু) প্রবাহে কোনও বাধা দেবে না ভারত। একইভাবে পূর্ব দিকের নদীগুলির (শতদ্রু, বিপাশা, ইরাবতী) প্রবাহ বইতে দেবে পাকিস্তান। সিন্ধু জলচুক্তি মেনে প্রতি বছর ৫,৯০০ টিএমসিএফটি (হাজার মিটার কিউবিক ফিট) জল পাকিস্তানকে দেয় ভারত। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বিশ্বে যে দেশগুলি প্রবল জল সংকটে রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম পাকিস্তান। ওই দেশের ৮০ শতাংশ সেচ ও কৃষি হয় পূর্ব দিকের নদীর (ঝিলম, চেনাব ও সিন্ধু) জলে। ১৬ মিলিয়ন বা ১.৬ কোটি হেক্টর জমিতে কৃষিকাজ হয় সিন্ধু চুক্তির ফলে পাওয়া জল থেকে।

বিগত দু’বছর ধরে সিন্ধু জলচুক্তি নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে টানাপোড়েন চলছে। জম্মু-কাশ্মীরের বান্দিপোরা জেলায় ঝিলাম নদীতে ৩৩০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন কিষাণগঙ্গা হাইড্রোলেক্টিক প্রজেক্ট (কেএইচইপি) এবং কিশতেয়ার জেলায় চেনাব নদীর উপর ৮৫০ মেগাওয়াটের র‍্যাটল হাইড্রোইলেক্ট্রিক প্রজেক্ট নিয়ে আপত্তি জানিয়েছিল পাকিস্তান। ২০২৩ সালের ২৫ জানুয়ারি ভারত সিন্ধু জলচুক্তিতে বদল চেয়ে পাকিস্তানকে নোটিশ পাঠিয়েছিল। এরপর ফের সেপ্টেম্বরে জলচুক্তির পর্যালোচনা ও পরিবর্তনের কথা জানিয়ে নোটিশ পাঠায় ভারত। কিন্তু প্রতিবারই পাকিস্তান সেই আলোচনা পিছিয়ে দেয়। তবে পহেলগাম জঙ্গি হামলা বদলে দিয়েছে অনেক কিছু। সিন্ধু জলচুক্তি স্থগিত হয়ে যাওয়ার ফলে ভরা গ্রীষ্মে এবং তারপর বর্ষার সময়ে নিম্ন সিন্ধু অববাহিকার কী পরিস্থিতি তৈরি হয় এবং তার প্রভাব পাকিস্তানের ওপর কতটা পড়ে, সেটাই এখন দেখার। সন্ত্রাসবাদীদের মদতকারী দেশের এটাই প্রাপ্য ছিল।

Advertisement