স্বপনকুমার মণ্ডল
সমাধানই যখন সমস্যা হয়ে ওঠে,তখন তার অপ্রত্যাশিত প্রকৃতি আরও ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করে। রাজ্যের ২০১৬-র এসএসসি পরীক্ষায় নিযুক্ত প্রায় ছাব্বিশ হাজার শিক্ষক-অশিক্ষকের চাকরি প্রথমে মহামান্য হাই কোর্ট ও পরে সুপ্রিম কোর্টে দুর্নীতির দায়ে বাতিল হয়ে যায়। সেখানে যোগ্য-অযোগ্য পৃথকীকরণের অভাবে যেভাবে তা বাতিল করে পুনরায় পরীক্ষার মাধ্যমে তার সমস্যা সমাধানের উপায় বেঁধে দেয় মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট,তাতে সমাধানই সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষ করে দুর্নীতিগ্রস্ত অযোগ্যদের বাদ দেওয়ার সমস্যাকে যেভাবে মেধার যোগ্যতার ভিত্তিতে পাওয়া যোগ্যদের চাকরিও বাতিল করে নতুন করে পরীক্ষা দিয়ে নিযুক্তির মাধ্যমে সমাধানে সুরাহা করার রায় চূড়ান্ত রূপ লাভ করে,তাতে শুধু চাকরি হারানোর ভয়ঙ্কর পরিণতিই অনিবার্য হয়ে ওঠে না,তার সঙ্গে যোগ্য-অযোগ্যের মধ্যে পার্থক্য না করতে পারার ব্যর্থতাবোধও চেপে বসে। সেখানে বাছাই করার ব্যর্থতায় যোগ্য-অযোগ্যের সমান দর ও সমান শাস্তি মূল্যবোধের সংকটকে আরও ঘনীভূত করে তোলে। এ বছর ১৭ এপ্রিল রাজ্য সরকারের আবেদনে সাড়া দিয়ে আবার মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট যোগ্যদের চাকরি ৩১ ডিসেম্বর ২০২৫ পর্যন্ত বাড়িয়ে দিয়ে তার মধ্যেই ৩১ -এ মে’র মধ্যে এসএসসি পরীক্ষার বিজ্ঞপ্তি জারি করে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার রায় দান করে। এতে শিক্ষাক্ষেত্রে শিক্ষকের অভাবজনিত অস্থায়ী সমস্যার সুরাহা হলেও যোগ্য শিক্ষকদের স্থায়িত্বের সংকট আরও অনিবার্য হয়ে ওঠে। বিশেষ করে নতুন করে পরীক্ষায় বসে যোগ্যতা প্রমাণ করার চেয়েও বেশ কয়েক বছর ধরে শিক্ষকের স্থায়ী চাকরি করে বদলে যাওয়া জীবন ও অর্জিত মানসম্মান এবং সামাজিক মর্যাদা হারানোর ভয় ও আতঙ্ক মনকে গ্রাস করে। সেখানে চাকরির বাজারে চাকরি না পাওয়ার হতাশার চেয়ে পেয়ে হারানোর বিভীষিকা আরও মর্মান্তিক ট্র্যাজিক পরিণতি মনে হয়। শুধু তাই নয়,জীবিকার সঙ্গে জীবনের অবিচ্ছেদ্য যোগকে বিচ্ছিন্ন করা আত্মহত্যার সামিল। অন্যদিকে এরকম ট্যাজিক পরিণতির জন্য নিজেকে দায়ী করার অবকাশও সেক্ষেত্রে নেই। উল্টে রাজ্য সরকারের সঙ্গে এসএসসি ও মধ্যশিক্ষা পর্ষদের প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে সংগঠিত দুর্নীতির কথা আজ হাই কোর্ট ও পরে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের মাধ্যমেই দিনের আলোর মতোই স্বচ্ছ হয়ে উঠেছে। সেদিক থেকে সংগঠিত দুর্নীতির জন্যে যোগ্যদের চাকরির হারানোকে মন থেকে মেনে নেওয়া যায় না।
Advertisement
সেক্ষেত্রে ১৫ মে বিকাশ ভবনে গিয়ে দুর্নীতিতে অচিহ্নিত যোগ্য শিক্ষকদের অবরোধ আন্দোলন যেমন অস্বাভাবিক নয়,তেমনই তা অনিবার্য মনে হয়। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে তার প্রতিরোধে গড়ে তোলা অনিবার্য হয়ে ওঠে। সেখানে পুলিশি দমনপীড়নের মাধ্যমে চাকরিহারা যোগ্য শিক্ষকদের আন্দোলনকে নিঃস্ব করা কোনওভাবেই সমর্থন করা যায় না।
মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের রায়ে এসএসসির দুর্নীতি নিয়ে যেমন পুনরায় পরীক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে যোগ্যদের চাকরিতে নিযুক্তির কথা বলা হয়েছে,তেমনই তার নেপথ্যে যোগ্য-অযোগ্যদের মধ্যে বাছাই করা অসম্ভবের কথাও উঠে এসেছে। সেখানে রাজ্য সরকারের সদিচ্ছা ও সততার মাধ্যমে এসএসসি পরীক্ষার ওএমআর সিট প্রকাশ করে তা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করলেই বাছাই করার অসম্ভবই সম্ভব হয়ে উঠবে। অবশ্য তা করলে রাজ্য সরকারের দুর্নীতির স্বীকারে তার অস্তিত্ব সংকটও অনিবার্য। স্বাভাবিক ভাবেই সেই আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নেওয়া খুব কঠিন। সেক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের রায় মেনে পুনরায় এসএসসি পরীক্ষার মাধ্যমে যোগ্যদের নিযুক্তির পথ মসৃণ ও সর্বোত্তম উপায় হয়ে ওঠে। অন্যদিকে সেই পরীক্ষার মাধ্যমে নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণের অগ্নিপরীক্ষা বসার মানসিকতা দীর্ঘদিন পর পরীক্ষা দিয়ে চাকরি পাওয়ার পরে বছরদুয়েক ধরে চলা মামলা লড়ে আতঙ্কিত পরিসরে না থাকাই দস্তুর। সেখানে সরকারি ভাবে প্রাতিষ্ঠানিক ষড়যন্ত্র করে সংগঠিত দুর্নীতির দায় মাথায় নিয়ে পুনরায় পরীক্ষায় বসা শুধু অনিশ্চিত ফলাফলই আতঙ্ক জাগিয়ে তোলে না,সেই দুর্নীতির কাছে বশ্যতা স্বীকার করার দায়ও চেপে বসে। তার চেয়ে সেই প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদী আন্দোলন গড়ে তুলে ওএমআর সিটের মাধ্যমে হারানো স্বীকৃতি ফিরে পাওয়া জরুরি মনে হওয়াই স্বাভাবিক এবং প্রত্যাশিত। আর সেখানেই সরকারের দাঁতনখ বেরিয়ে পড়ে। দুর্নীতির কারণে অযোগ্যদের দমিয়ে রাখা যায়, যোগ্যদের দমানো বা চুপ করিয়ে কাজ হাসিল করা চলে না। যোগ্য শিক্ষকরা ‘হীরক রাজার দেশে’র উদয়ন পণ্ডিতের জাত। তাঁরা সত্যসন্ধানী ও সত্য পথের যাত্রী। আসলে সত্য বড় একা,ভয়ঙ্কর নিঃসঙ্গ। মিথ্যে মিলেমিশে থাকে,অবাধে বন্ধুত্ব তার। অথচ সত্যের মুখোমুখি দাঁড়ানো জরুরি। তাতেই জীবনের প্রতিষ্ঠা,পরম আনন্দ। সেই দিকেই যোগ্যদের আত্মপ্রতিষ্ঠার লড়াই লক্ষ্যাভিমুখী। সেক্ষেত্রে তাঁদের দমনপীড়ন করে বশীভূত করা যায় না। উদয়ন পণ্ডিতরাই জাতির মেরুদণ্ড গড়ে তোলার কারিগর। প্রয়োজনে তাঁরা জীবনপণ করেই লড়াই করতে পারে। তাঁদের হারানোর কিছু নেই। লড়াই করাটাই তাঁদের আত্মপ্রতিষ্ঠার সোপান। সেখানে যোগ্যদের শরীরের জোরের চেয়ে মগজের জোর অনেক বেশি। তার চেয়েও বেশি জোর তাঁদের মনের। তাঁদের চাকরি কেউ দেয়নি,তাঁরা অর্জন করেছেন। সেক্ষেত্রে সরকারি উদ্যোগে উদয়ন পণ্ডিতদের মতকে যতই বিপথে চালিত করা হোক,বা,পথকে যতই দুর্গম করা হোক, তাঁরা লক্ষ্যভেদী প্রয়াসে অপরাজেয় থাকে নিরন্তর। সেদিকেই যোগ্য চাকরিহারা শিক্ষকদের আত্মপ্রতিষ্ঠার লড়াই নতুন ইতিহাস সৃষ্টির পথে ধাবিত ।
Advertisement
অন্যদিকে নাছোড় চাকরিহারা শিক্ষকদের আন্দোলন নিয়ে রাজ্য সরকারের মাথাব্যথার যথেষ্ট কারণ আছে। দুর্নীতিপরায়ণ সরকারের ভাবমূর্তি কাটিয়ে ওঠার পক্ষে যোগ্যদের আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া শিরঃপীড়া হয়ে ওঠে। সামনেই বিধানসভা নির্বাচন। সেখানে সরকারের স্বচ্ছ ভাবমূর্তি গড়ে তোলা একান্ত জরুরি। সেক্ষেত্রে সরকারের প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করে সরাসরি আন্দোলনে সামিল হওয়ার পক্ষে দুর্নীতির প্রকট অস্তিত্ব সময়ান্তরে পচনের অসহ্য বিকট দুর্গন্ধ থেকে হারানো মানুষের মৃতদেহ জেগে ওঠার ভয়ে শঙ্কিত খুনির আতঙ্কিত পরিসর জেগে ওঠে। স্বাভাবিক ভাবেই তার আতঙ্কে যোগ্যদের আন্দোলনকে প্রতিহত করার রাষ্ট্রীয় শক্তির চরম ব্যবহারের মধ্যেই সরকারের গভীর উৎকণ্ঠা বেরিয়ে পড়ে। শাসক যখন তার হিংস্র দাঁতনখ বের করে,তখন বোঝা যায় সে খুব ভয় পেয়েছে। তার যত ভয়, তত সে দমনপীড়নে মরীয়া, ততই তার স্বৈরাচারী মনোভাবের ঔদ্ধত্য সামনে চলে আসে। অন্যদিকে ভয় কাটিয়ে জয়ের প্রতীক্ষায় উদয়ন পণ্ডিতদের অকুতোভয় সংসপ্তকী লড়াই সামনের দিকে এগিয়ে চলে। সত্যের পথে চলা নীতিশিক্ষার সাহস দুর্নীতির দুঃসাহসকেও পরোয়া করে না। তাঁরা শিখে এসেছেন,সত্যের পথ যতই কঠিন ও দুর্গম হোক,তাই একমাত্র জয়ের পথ। রাজ্য সরকার সুপ্রিম কোর্টের দোয়াই দিয়ে যোগ্যদের আন্দোলনকে নিঃস্ব করে নিজেদের দুর্বলতা গোপন করতে মরীয়া হলেও তা দিয়ে যোগ্যদের দাবি বা অধিকারকে অস্বীকার করা যায় না। বরং দমনপীড়নের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় শক্তির অপপ্রয়োগে দুর্নীতির বিরুদ্ধে গড়ে তোলা আন্দোলনই সরকারের দুর্নীতিতে কলুষিত ও কলঙ্কিত ভাবমূর্তিকে আরও বেশি নগ্ন করে তোলে। সেদিক থেকে যোগ্যদের নাছোড় লড়াইয়ের জীবনপণ প্রকৃতিই যেমন তাঁদের অর্জিত যোগ্যতার আলো জ্বালিয়ে দেয়, তেমনই সরকারের শান্তিপ্রিয় গণতান্ত্রিক আন্দোলনের বিরুদ্ধে গর্জে উঠে রাষ্ট্রীয় শক্তি ব্যবহার করে দমনপীড়নের নিবিড় আয়োজনে তার আতঙ্কে দিশেহারা নগ্ন চেহারাও অন্ধকারে জেগে ওঠে। এজন্য সত্যের আলোতেই এই সময়ের উদয়ন পণ্ডিতের জয় শুধু সময়ের অপেক্ষা। তাদের সত্যের পথেই দুর্নীতির মিথ্যার নিকষ কালো অন্ধকার দূরীভূত হওয়ার প্রতীক্ষায় জেগে আছে নিরন্তর গোটা বাংলার শিক্ষিত সমাজ।
Advertisement



