• facebook
  • twitter
Friday, 5 December, 2025

একালের ‘অঘোষিত’ জরুরি অবস্থা ইন্দিরা জমানার চেয়েও ভয়ঙ্কর

১৯৭৫ সালের জরুরি অবস্থার আগে, ১৯৬২ সালের ভারত-চিন যুদ্ধ ও ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছিল।

ভারতে জরুরি অবস্থা ঘোষণার ৫০ বছর পেরিয়ে গেল। ২৫ জুন, ১৯৭৫। তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর পরামর্শে দেশজুড়ে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ফকরুদ্দিন আলি আহমেদ। ১৯৭৭ সালের ২১ মার্চ পর্যন্ত ২১ মাস ধরে এই জরুরি অবস্থা জারি ছিল। এই সময়কালকে দেশের ইতিহাসে অন্যতম অন্ধকারময় অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে।

১৯৭৫ সালের জরুরি অবস্থার আগে, ১৯৬২ সালের ভারত-চিন যুদ্ধ ও ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছিল। তবে তার প্রভাব গণতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলেনি। কিন্তু ১৯৭৫-এর জরুরি অবস্থা গোটা দেশকে নাড়িয়ে দিয়েছিল।

Advertisement

১৯৭১-এর লোকসভা নির্বাচনে ৫১৮টি আসনের মধ্যে ৩৫২টি আসনে জয়ী হয় ইন্দিরা গান্ধীর কংগ্রেস। রায়বেরিলি কেন্দ্রে সমাজতান্ত্রিক পার্টির রাজ নারায়ণকে এক লাখ দশ হাজার ভোটের ব্যবধানে পরাস্ত করেন ইন্দিরা গান্ধী।

Advertisement

কেন জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছিলেন ইন্দিরা? নাকি পরিস্থিতিই তাঁকে জরুরি অবস্থা ঘোষণার দিকে ঠেলে দিয়েছিল? নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় দুর্নীতির মামলায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে দোষী সাব্যস্ত করে

১৯৭৫ সালের ১২ জুন এলাহাবাদ হাইকোর্ট। আদালত রায় দেয়, আগামী ছয় বছর কোনও ধরনের নির্বাচনী প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত হতে পারবেন না ইন্দিরা গান্ধী। ১৯৭১ সালে রায়বেরেলিতে ইন্দিরার জয় বাতিল করে দেওয়া হয়, অর্থাৎ লোকসভার সদস্য পদ হারান তিনি।

এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায়ের পর ইস্তফা দিতে চেয়েছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। কিন্তু পুত্র সঞ্জয় গান্ধীর পরামর্শে প্রধানমন্ত্রীর পদ বাঁচাতে হাইকোর্টের রায়কে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে যান ইন্দিরা। কিন্তু সেখানেও বহাল রাখা হয় হাইকোর্টের রায়। ২৪ জুন সুপ্রিম কোর্ট জানায়, প্রধানমন্ত্রী থাকলেও, লোকসভায় ভোট দেওয়ার অধিকার পাবেন না ইন্দিরা। সাংসদ হিসাবে ইন্দিরা গান্ধী যে সমস্ত সুবিধা পেতেন, তা বন্ধ করে দিতে বলা হয়। তাঁর ভোটাধিকারও কেড়ে নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়।

এরপর প্রধানমন্ত্রীর পদ ধরে রাখতে মরিয়া হয়ে ওঠেন ইন্দিরা গান্ধী। পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায় জরুরি অবস্থা জারির পরামর্শ দিলে, ইন্দিরা তা মেনে নেন। ১৯৭৫ সালের ২৫ জুন, মধ্য রাতের কিছুক্ষণ আগে দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়।

পরদিন অর্থাৎ ২৬ জুন সকাল ৮টায়, অল ইন্ডিয়ায় রেডিয়োর এক বার্তায় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন। রেডিয়ো বার্তায় তিনি বলেন, “ভাই ও বোনেরা, রাষ্ট্রপতিজি জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছেন। এতে আতঙ্কিত হওয়ার কোনও কারণ নেই।”

জরুরি অবস্থা ঘোষণা হতেই রাজধানী দিল্লির অধিকাংশ সংবাদমাধ্যমের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। পর দিন সকালে সংবাদপত্রের সাদা পাতা প্রকাশিত হয়। গ্রেফতার হন একের পর এক বিরোধী নেতা। এঁদের মধ্যে ছিলেন অটল বিহারী বাজপেয়ী, জয়প্রকাশ নারায়ণ, মোরারজি দেশাই, চরণ সিং, লালকৃষ্ণ আডবাণী, অরুণ জেটলির মতো নেতারা। সরকারের বিরোধিতা করে গ্রেফতার হন লক্ষাধিক দেশবাসী। বন্ধ হয়ে যায় লোকসভা ও রাজ্যসভার নির্বাচন।

১৯৭৭ সালের ২১ মার্চ আচমকা জরুরি অবস্থা তুলে নেওয়া হয়। লোকসভার ৫৪২টি আসনের মধ্যে ২৯৫টিতে জয়ী হয় জনতা পার্টি। ১৫৪টি আসন পায় কংগ্রেস। স্বাধীনতার পর দেশের প্রথম অ-কংগ্রেসি প্রধানমন্ত্রী হন মোরারজি দেশাই।

নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার পর জরুরি অবস্থা ঘোষণার দিনটিকে ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’ হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেয়, যা নিয়ে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠেছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, দেশে এখন সরকারিভাবে জরুরি অবস্থা ঘোষণা না করা হলেও, পরিস্থিতি ইন্দিরা জমানার চেয়েও ভয়াবহ।

স্বাধীনতার তিন মাস পর, ২৬ নভেম্বর, ১৯৪৭-এ মহাত্মা গান্ধী শাসক দলের মিডিয়াকে ব্যবহার নিয়ে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “কংগ্রেস সরকার যেভাবে রেডিও-র মতো মাধ্যমকে নিজেদের প্রচারে ব্যবহার করছে, তাতে শেষ পর্যন্ত একনায়কতন্ত্র আসতে বাধ্য।

২১ মাসের জরুরি অবস্থায় সেন্সরশিপ এবং নিপীড়নমূলক ব্যবস্থার মাধ্যমে সরকার মিডিয়ার ওপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম করেছিল। নরেন্দ্র মোদির ১১ বছরের শাসনে সরকারের প্রচার এবং ভাবমূর্তি তৈরির কাজে লাগামহীনভাবে সংবাদমাধ্যমকে ব্যবহার করা হচ্ছে। ভারতে এখন “নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্র” চলছে, এমন অভিযোগ বিরোধীরা হামেশাই করে থাকেন। গান্ধীজি যে সতর্কবার্তা উচ্চারণ করেছিলেন, মোদির আমলে দেশ কার্যত সে পথেই এগোচ্ছে।

দেশে আজ প্রথম সারির টিভি চ্যানেল, প্রিন্ট ও সোশ্যাল মিডিয়ার বেশিরভাগই এখন মোদির ভাবমূর্তির তৈরির কাজে ব্যস্ত। ‘গোদি মিডিয়া’ এখন বিজেপির মুখপত্রের মতো কাজ করে চলেছে। দিনের পর দিন ছড়ানো হচ্ছে মুসলিম বিদ্বেষ। ব্র্যান্ড মোদির হিন্দুত্বের শিকড়কে মজবুত করতে গিয়ে সংবিধানের মূল ভাবাদর্শকে লঙ্ঘন করা হচ্ছে। ধ্বংস করা হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষতা ও বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতির পরম্পরাকে।

জরুরি অবস্থার সময় ধর্মের ভিত্তিতে সমাজে বিভাজন তৈরি করা হয়নি। “ধর্মনিরপেক্ষ” এবং “সমাজতান্ত্রিক” শব্দ দুটি সংবিধানের প্রস্তাবনায় যুক্ত করার মাধ্যমে ইন্দিরা গান্ধী ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতান্ত্রিক মূল্যবোধকে তুলে ধরেছিলেন। সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টও এই পদক্ষেপকে সাংবিধানিক বৈধতা দিয়েছে।

১৯৭৭-এ জরুরি অবস্থা প্রত্যাহারের পর সংবাদমাধ্যমের ওপর থেকে সমস্ত বিধিনিষেধ তুলে নেওয়া হয়েছিল এবং লোকসভা নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণা করা হয়। মিডিয়া এবং বিরোধী দলগুলি পুরোপুরি গণতান্ত্রিক অধিকার নিয়ে অবাধে তাদের কাজ চালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। জনতা পার্টি ক্ষমতায় এলেও, মাত্র আড়াই বছরের মধ্যে সেই সরকার ভেঙে পড়ে। ১৯৮০তে আবার ক্ষমতায় ফিরে আসেন ইন্দিরা।

সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার সূচকে বিশ্বের ১৮০টি দেশের মধ্যে এখন ভারতের স্থান ১৫১ নম্বরে। এর সঙ্গে রয়েছে সাংবাদিকদের গ্রেফতারি এবং হেনস্থাও। পুলিশ এবং এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট সহ বিভিন্ন সরকারি সংস্থাকে মিডিয়ার বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেওয়া হয়েছে।

সম্প্রতি কোনওরকম নোটিশ ছাড়াই মোদি সরকার বেশ কয়েকটি ইউটিউব নিউজ চ্যানেল বন্ধ করে দিয়েছে। উত্তরপ্রদেশের হাথরসে দলিত কিশোরীর ধর্ষণ ও হত্যা নিয়ে নিজের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে গ্রেফতার হতে হয়েছে সাংবাদিক সিদ্দিক কাপ্পানকে।

গত ১১ বছরে শুধুমাত্র ভুয়ো বিদ্বেষমূলক খবর ছড়িয়ে বহু নাগরিককে হত্যা করা হয়েছে। যে সব টিভি চ্যানেল এই বিদ্বেষের খবর ছড়াচ্ছে, সেগুলির বিরুদ্ধেও কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ১৯৭৭-এ ইন্দিরা গান্ধীকে ভোটে হারিয়ে মানুষ গণতান্ত্রিক অধিকার হরণের বিরুদ্ধে তাঁদের রায় দিয়েছিলেন। কিন্তু মোদি জমানায় তার চেয়েও খারাপ পরিমণ্ডল তৈরি করা হয়েছে।

Advertisement