• facebook
  • twitter
Sunday, 16 February, 2025

হিমেল ভুবনে বিস্মিত স্কুলের বিশ্বরূপ

স্কুলের পাশাপাশি আলাস্কা ও গ্রিনল্যান্ডের কতিপয় স্কুল মোটামুটিভাবে পড়াশোনার জন্য উন্মুক্ত থাকে -৩০°সেলসিয়াস তাপমাত্রাতেও।

ফাইল চিত্র

সুবীর পাল

বঙ্গে শীত এখন বায়না ধরেছে যাই যাই। ঋতুর উঠোনে কিছুটা মুখ উঁচিয়ে অপেক্ষারত বসন্ত বলতে চাইছে, আবার এসো, পরের বছর দেখা হবে ভাই। তবু শেষের স্পেলে শীতের এখনও একটা পলকা আমেজ কিন্তু তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করছে বঙ্গবাসী। এই শীত মানেই স্কুলে স্কুলে পরীক্ষা সবে হয়ে যাওয়া। তারপর বড়দিনের ছুটির পালা। নতুন ইংরেজি বছরে নয়া ক্লাসের অচেনা রোল কলের উৎসুক। নানা স্কুলে স্পোর্টসের আন্তরিক আয়োজন। আসলে শীত মানেই স্কুলের অনেক কিছুই। যা একটু অন্যরকমের। তা স্রেফ শীতেই তুল্য। হ্যাঁ, তাইতো এই সুযোগে রকমারি শীতের দাপুটে ওভারে নানাবিধ স্কুলের কিছু কেতাবী ব্যাটিং পরখ করে নিতে আপত্তি কি? অন্তত, একটু জানা অনেকটা অজানার গ্রিনরুমে। তা আলোচনার ময়দান রাজ্যের বা দেশের হতেই পারে। আবার তথ্যকেন্দ্রিক আন্তর্জাতিক মাঠও হলেও আপত্তি থাকার কথা নয়।

প্রসঙ্গত রাজ্যটির নাম যদি সর্বাগ্রে পশ্চিমবঙ্গ হয় তখন গ্রীষ্মকালে অতি গরমের কারণে স্কুল ছুটি তো এখানে ফি বছরের অতি চেনা ধারাবাহিক প্রতিচ্ছবি। কিন্তু যখন শীত জাঁকিয়ে পড়ে ভারতের এই অঙ্গরাজ্যে। বিশেষ করে উত্তরবঙ্গের পাহাড়ি প্রান্তে। শীতের আমেজে মোটামুটি কাহিল হয় বাঙালি সমাজ। ঠিক তখনই বঙ্গবাসীর মনে অবশ্যই বাসা বাঁধে, অতি শৈত্যেও কি তবে স্কুল বন্ধ থাকে এমন রূপসী ভূমে? কই তেমন তো কিছুর দৃষ্টান্ত আমাদের অনেকটা চেনা সমাজে খুঁজে পাওয়া যায় না। অনন্ত দক্ষিণবঙ্গের পরিসরে। তবে ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে পাহাড়ি কন্যা দার্জিলিং স্থিত স্কুলগুলির ক্ষেত্রে। অল্পস্বল্প বরফের চাদরে শৈলশহর মুখ ঢাকলেই হলো। ওমনি স্থানীয় স্কুলেও তখন শুরু হয় ‘আজ আমাদের ছুটি’র সাময়িক মহড়া। আবার খুব কনকনে ঠাণ্ডা পড়লে বা ৫° সেলসিয়াসের নিচে থার্মোমিটারের পারদ পতন ঘটলে আলিপুরদুয়ার, কালিম্পং, কোচবিহারের মতো এলাকার বহু স্কুল বন্ধ থাকে। তবে কতটা শীত জেঁকে বসলে স্কুল ছুটি হবে তা নির্ধারণ করে থাকে আঞ্চলিক প্রশাসন ও এলাকার বিদ্যালয় পরিদর্শক দফতর।

তথাপি রাজ্য সীমানা অতিক্রম করে সারা দেশের স্ফটিক কাঁচে এ প্রসঙ্গ উত্থাপন করলে সর্বাগ্রে চর্চার ফোকাস গিয়ে পড়বে অবশ্যই লাদাখের কিনারে। সেখানে শীতকালে উত্তাপের পারদ নেমে যায় কখনও কখনও
-৩০° সেলসিয়াস পর্যন্ত। স্বাভাবিকভাবেই তখন স্থানীয় স্কুলগুলোর দরজায় ঝুলিয়ে দেওয়া হয় তালা।

যদিও প্রয়োজন পড়লে  -১০°সেলসিয়াসেও এখানকার কিছু স্কুলে পড়াশোনা সচল রাখে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এই বিষয়ে ‘কার্গিল আর্মি পাবলিক স্কুল’ সহ ‘লেহ আর্মি পাবলিক স্কুলের প্রসঙ্গ অনায়াসেই অগ্রগন্য। এমন তীব্র শীতেও সেনাশাসিত কঠোর অনুশাসিত স্কুলের পঠনরীতির কথা ভাবলে সত্যি আমাদের হতবাক হতে হয় বৈকি। তবে -৫° সেলসিয়াস ঠান্ডাতে কাশ্মীরের ‘সোশ্যাল এন্ড মিলিটারি স্কুল’ মাঝেমধ্যে খোলা থাকে বলে জানা গেছে। হিমাচল প্রদেশ ও উত্তরাখন্ডের বেশ কিছু স্কুলও এই ইস্যুতে পিছিয়ে নেই। হিমাচল প্রদেশের শিমলা, কুলু, মানালি, কাঁগ্রার মতো তীব্রতর ঠান্ডা পাহাড়ি অঞ্চলেও -৫° সেলসিয়াস তাপমাত্রা বহমান থাকলেও কিছু কিছু স্কুল খোলা থাকার কথা সাধারণ ভারতবাসীকে অবাক করে অবশ্যই। এমনতর একই মাত্রার শীতেও খুলে থাকা স্কুলগুলোর মধ্যে ‘শিমলা গ্রামার স্কুল’, ‘মানালি ইন্টারন্যাশনাল স্কুল’, কুলুর ‘ডেভিড সেন্টিনারী স্কুল’ প্রকৃতই উদাহরণ সৃষ্টি করে। এগুলো ছাড়াও প্রায় একইরকম ভয়াবহ শীতে উত্তরাখণ্ডের বেশ কিছু স্কুলেও সচল থাকে নিত্য পড়াশোনা। রুদ্রপ্রয়াগের ‘উত্তরাখণ্ড পাবলিক স্কুল’, নৈনিতালে অবস্থিত ‘ফুলবাগ স্কুল’, হরিদ্বারের ‘দ্য স্কুল ফর এক্সিলেন্স’, দেরাদুনের ‘দ্য ক্যান্টনমেন্ট স্কুল’এর মতো বিদ্যালয়ে এহেন অকল্পনীয় শীতেও স্বাভাবিক মাত্রায় পঠনপাঠন চালু থাকে।

ভাবতে পারা যায়, সাধারণ পশ্চিমবঙ্গের সমতল এলাকায় বসবাসকারীরা ৫° সেলসিয়াস ঠান্ডা কদাচিৎ পড়লে আমরা ঠকঠক করে কাঁপতে থাকি। আমাদের পুরো শরীর কেমন যেন জুবুথুবু হয়ে ওঠে এমন ঠান্ডায়। আমরা সব কাজ ফেলে অস্থির হয়ে উঠি কখন লেপের তলায় শরীরটাকে চালান করবো। আর আমাদেরই দেশেরই কিছু কিছু অতি শীতল প্রান্তে-৫° সেলসিয়াসের মতো অসহ্য ঠান্ডাতেও থাকছে স্কুল পুরোপুরি খোলা অবস্থায়। ছোট ছোট পড়ুয়ারা এমন অসহনীয় ঠান্ডা উপেক্ষা করে সেখানে যাচ্ছে পড়াশোনার তাগিদে। এও কল্পনা করতে গেলে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যেতে হয়, কার্গিল ও লেহের মতো বিপদসংকুল স্থানেও -১০° সেলসিয়াস ঠান্ডায় স্কুল উন্মুক্ত রাখা হয় বিশেষ প্রয়োজনে।

অবশ্য হাড় হিম করা শীতে স্কুলের পঠনপাঠন নিয়ে অবাক হওয়ার মতো চমকপ্রদ মশলা আরও রয়েছে এহেন আলোচনার আস্তিনে। সেক্ষেত্রে তার সঠিক সুলুক সন্ধান পেতে হলে, ভারতের গন্ডি ছাড়িয়ে রাশিয়ায় অবধারিত ভাবে পাড়ি জমাতেই হবে। ওখানেই রয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে শীতলতম অধ্যয়নরত একটি স্কুলের আশ্চর্যময় কাহিনী। আপাতত মনে হতেই পারে, এসব অসম্ভব ও আজগুবি কাগুজে কল্পগল্প। না বন্ধু না। এ হলো বহুজনের এক অজানা অকল্পনীয় কঠিন কঠোর সত্য নির্ভর কিসসা। বিদ্যালয়টির নাম ‘ওইমায়কন স্কুল।’ এটি সাইবেরিয়া অঞ্চলের একটি গ্রামীণ স্কুল। সেখানে -৫৬° সেলসিয়াস বা তার চেয়ে বেশি ঠাণ্ডা পড়লে তাহলেই স্কুলে ছুটি ঘোষণা করা হয়। অর্থাৎ -৫৫° সেলসিয়াসেও ওই স্কুলে স্বাভাবিক নিয়মে পড়াশোনা চালু থাকে। এমন চমকে যাবার মতো অবিশ্বাস্য তথ্য সত্যি কানে ঢুকলে তা হজম করতেই নিজের বিশ্বাস টলমল করে ওঠে। তবু এই আজব দুনিয়ায় এমনতর স্কুলভিত্তিক ঘটনা প্রকৃতই বাস্তব নির্ভর।

সাইবেরিয়ার অভ্যন্তরে সারা বছর বরফে আচ্ছাদিত বিশ্বের সর্বাধিক শৈত্যপ্রবণ গ্রামটি ‘ওইমায়কন’ হিসেবে সুপরিচিত। ১৯২৪ সালে এখানে এযাবৎ রেকর্ড তাপমাত্রা নেমেছিল-৭১° সেলসিয়াসে। জানুয়ারি মাসে সাধারণত এখানে গড় তাপমাত্রার পতন ঘটে -৬৮° সেলসিয়াস পর্যন্ত। এই গ্রামের জনসংখ্যা মেরেকেটে জনা ৫০০। এখানকার বাসিন্দাদের জীবিকা পশু পালন ও পশু শিকারের উপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। ইউকাগির ও ইয়াকুট সম্প্রদায়ের আদিবাসীরা বসবাস করেন। এখানে ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অত্যধিক ঠান্ডা পড়ে। জানুয়ারি মাসে তাপমাত্রা সর্বাধিক হারে নিচে নেমে যায়।

এহেন গ্রামের ‘ওইমায়কন স্কুল’টি স্থাপন হয় ১৯৩০ সালে। নার্সারি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত এখানে সরকারি ব্যয়ে বিনামূল্যে ছাত্রছাত্রীদের পড়ানো হয়। পড়ুয়ার সংখ্যা বর্তমানে ৩০ জন। আর জনা ১০ শিক্ষক রয়েছেন। এই গ্রাম্য অঞ্চলে এটিই হল একমাত্র স্কুল। সরকার নিয়ন্ত্রিত এই স্কুলটিতে রাশিয়ান ভাষায় পড়ানো হয়। মূলতঃ শিশুদের শিক্ষা প্রদানের কারণেই স্কুলটি এখানে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। স্কুল ঘরটি আকারে খুব ছোট এবং বিদ্যুৎ সংযোগও অত্যন্ত সীমিত পর্যায়ের। স্কুল ড্রেসের রঙ সাদা, লাল, নীল ও হলুদ। তুষারপাতের মধ্যেও যাতে দৃশ্যমান সঠিক থাকে তারজন্যই স্কুল ড্রেসের এমন রঙ নির্ধারণ। থিক উইন্টার কোট, হুড, স্কার্ফ, গ্লাভস, তাপসহায়ক জুতো, স্নো প্যান্ট পরে পড়ুয়ারা স্কুলে যাতায়াত করে।

ওইমায়কন স্কুলের পড়েই যে স্কুলটি বিশ্ববাসীকে তাক লাগিয়ে দেয় সেটির নাম হলো ‘অটুয়ারফিক স্কুল।’ এটি গ্রীণল্যান্ডের ব্যস্ততম শহর ‘নুক’এ অবস্থিত। এলাকার অন্যতম সম্ভ্রান্ত স্কুল হিসেবে এটি পরিচিত। শুনতে অবিশ্বাস্য মনে হলেও এটাই বাস্তব যে এই স্কুলটি -৪০°সেলসিয়াসেও খোলা থাকার নজির সৃষ্টি করেছে। যা বিশ্বের দ্বিতীয় স্থানাধিকারী শীতকালীন উন্মুক্ত স্কুল। গ্রিনল্যান্ডিক ভায়ায় অটুয়ারফিক শব্দের অর্থ হলো শিক্ষাস্থল। সেই অনুযায়ী এই স্কুলের নাম রাখা হয়েছে অটুয়ারফিক স্কুল। এই স্কুলে ইংরেজি, গ্রিনল্যান্ডিক ও ডেনিশ ভাষায় শিক্ষা দেওয়া হয় পড়ুয়াদের। এখানে শুধুমাত্র নুক শহরের পড়ুয়ারাই আসে না, পাশ্ববর্তী বিভিন্ন গ্রামের ছাত্রছাত্রীরাও অটুয়ারফিক স্কুলে ভিড় জমায়। বিশালাকার এই স্কুল ভবনটির পুরোটাতে সহনশীল তাপমাত্রা বিশিষ্ট সেন্ট্রাল হিটিং সিস্টেম চালু থাকে। এই স্কুলে অধ্যায়ণের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মানের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়। বিদ্যালয়টি প্রায় ৭৫ বছরের পুরনো। এটি একটি কোএডুকেশন স্কুল ও পুরোপুরি সরকারি পরিচালনায় নিয়ন্ত্রনাধীন। যার স্টুডেন্টের সংখ্যা প্রায় ১ হাজার। এখানে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক এই দুই স্তরেই অত্যাধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা বিদ্যমান।

এমনতর স্কুলের পাশাপাশি আলাস্কা ও গ্রিনল্যান্ডের কতিপয় স্কুল মোটামুটিভাবে পড়াশোনার জন্য উন্মুক্ত থাকে
-৩০°সেলসিয়াস তাপমাত্রাতেও। আলাস্কায় অবস্থিত ‘অ্যানচোরাগ স্কুল ডিস্ট্রিক্ট’ এবং গ্রিনল্যান্ডের অন্তর্গত ‘ইলুলিসসাৎ উঙ্গডোমস্কল’ এমনতর শৈত্যকালীন উন্মুক্ত স্কুলের অন্যতম দু’টি স্বতন্ত্র উদাহরণ।
কি ভাবছেন? স্পেল বাউন্ড হয়ে গেলেন তো? কিন্তু বাস্তবের যে একটাই সংজ্ঞা। তা হলো ‘বাস্তব।’ তা সে যতই অকল্পনীয় হোক না কেন! আসলে শীতবেলার উন্মুক্ত স্কুলের এমন বিশ্বরূপ রসায়ন আক্ষরিক অর্থেই অপ্রত্যাশিত। অচিন্তনীয়ও।