সুব্রত রায়
এই পথ যদি না শেষ হয় তবে কেমন হতো তুমি বলতো? ‘সপ্তপদী’ সিনেমার এই বাইক দৃশ্য আজও বাংলা সিনেমার রোমান্টিক দৃশ্যের রত্নভাণ্ডারের কোহিনুর হয়ে আছে। রোমান্টিক বাঙালি দর্শককে প্রজন্মের পর প্রজন্ম আজও স্মৃতিমেদুরতায় আক্রান্ত করে এই ছবিতে উত্তম-সুচিত্রার বাইক দৃশ্য। চলচ্চিত্রে কেবলই দৃশ্যের জন্ম হয়। এই দৃশ্য ও সপ্তপদী সিনেমাটি বলতে স্টারডম আক্রান্ত বাঙালি দর্শকের শুধুমাত্র উত্তম-সুচিত্রা কথা মনে পড়ে, কিন্তু অন্তরালে রয়ে যান এই ছবির চিত্রপরিচালক অজয় কর। এই গান বাংলা রোমান্টিক সিনেমার যেন থিম সং। তার একাধিক হিট ছবিগুলি যেমন হারানো সুর, সপ্তপদী, সাত পাকে বাঁধা, কাঁচ কাটা হিরে, মাল্যদান বা আরো অনেক ছবি দেখে আজ আমরা বিস্ময় ও ভালোলাগায় আপ্লুত হয়। কিন্তু এই সব ছবির যিনি পরিচালক সেই অজয় করকে আমরা ক’জন মনে রেখেছি।
Advertisement
চিত্র পরিচালক হিসেবে কর বাবুর আত্মপ্রকাশ ‘গৃহপ্রবেশ’ ছবির মধ্য দিয়ে যেখানে উত্তম-সুচিত্রা জুটির মায়াবী বিচ্ছুরণ। সিনেমাটোগ্রাফার হিসাবে চারু রায়ের প্রথম ছবি পথিক এ প্রথম ব্যাক প্রজেকশন পদ্ধতি নিয়ে আসেন। কিন্তু হে পাঠক অত্যন্ত সবিনয় জানিয়ে রাখি ‘হারানো সুর’ ছবিতে বিখ্যাত গানের দৃশ্য ব্যাক নয়, করবাবু করেছিলেন ফ্রন্ট প্রোজেকশনে। এই বক্তব্য যার, তিনি অজয় করের উনিশটি ছবির প্রোডাকশন ম্যানেজার ক্ষিতীশ আচার্যের। বর্ষিয়ান ক্ষিতীশবাবুর আরো আক্ষেপ, করবাবুকে যে কেউ মনে রাখলো না এটা ভাবলেই আমার চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে আসে। একটা মানুষ সারা জীবন কেবল দিয়েই গেল পেলনা কিছুই। এমনটা হওয়ার কথা ছিল না।
Advertisement
কিন্তু এমনটাই হলো। কেন হলো তার কারণ খুঁজতে গেলে একটা জিনিস ভাবতে হবে যাদের হাত দিয়ে পঞ্চাশের দশকে বাংলা সিনেমাকে বই বলা শুরু হল এবং যিনি রবীন্দ্রনাথ শরৎচন্দ্রের কাহিনীর সার্থক চলচ্চিত্রায়ন করলেন, যার পরিচালিত ছবিগুলির ব্যাবসায়িক স্বীকৃতি মিলেছে অথছ এসবের পিছনে যিনি মূল কারিগর তিনি রয়ে গেছেন বিস্মৃতির ঘেরাটোপে। অদৃষ্টের কি নির্মম পরিহাস।
পরিচালক অজয় কর তো ছিলেন মূলত দৃশ্য শিল্পী। ক্যামেরা আর প্রযুক্তি ছিল তার প্রধান অস্ত্র। সেই কোন এক শীতের সকালে মুরারি ভাদুড়িকে লেখা একটি চিঠিতে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন সিনেমাকে সাহিত্যের চাটুকারি বৃত্তি ত্যাগ করতে হবে। যে কথার প্রতিধ্বনি আমরা শুনতে পাই এক ফরাসি চলচ্চিত্র তাত্ত্বিকের লা ক্যামেরা স্টাইলো প্রবন্ধে| সেখানে তিনি বলেছিলেন পরিচালককে ক্যামেরার কি অসম্ভব ক্ষমতা আছে তা জেনেই পরিচালনায় আসতে হবে পরিচালক অজয় কর তাই করেছিলেন। কিন্তু তাও তার জন্মশতবর্ষের পরেও তিনি উপেক্ষিতই রয়ে গেলেন।
আজ একথা অস্বীকার করা উপায় নেই পরিচালক অজয় কর ক্যামেরা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষাতে একটু বেশিমাত্রায় উৎসাহিত ছিলেন। আর্থার কোনান ডয়েলের হাউন্ড অব দ্য বাস্কারভিলস ও প্রেমেন্দ্র মিত্রের জলার পেত্নী ছিল তার” জিঘাংসা’ ছবির আশ্রয়। বিখ্যাত সিনেমাটোগ্রাফার শক্তি বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, জিঘাংসা দেখার পর প্রথম বুঝতে পারলাম এই মানুষটা কেবলমাত্র ছবি দিয়ে একটা সিনেমার গল্প বলতে পারেন। সত্যি কথা বলতে কি এই ছবিটা দেখার পর আমি প্র্যাকটিক্যালি কর বাবুর ভক্ত হয়ে পড়লাম। এবং মনে মনে ঠিক করলাম একে শিক্ষক মেনে ক্যামেরাম্যান হব।
১৯৬৩ সালে নির্মিত ‘সাত পাকে বাঁধা’ তার একটি অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য ছবি। এখানে সুচিত্রা সেন একজন ধনী বাবার মেয়ে। সে একজন একাডেমিশিয়ান সৌমিত্রকে বিয়ে করে। এই ছবিতে অভিনয় করে সুচিত্রা সেন মস্কো ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে সেরা অভিনেত্রীর সম্মান পান।
দুর্বলতা যদি বলা যায় তা ছিল একটাই। ক্যামেরা তে নিজের মুখ দেখাবার একটা সুযোগও মিস করতেন না কর বাবু। যেমন সপ্তপদী ছবিতে রিনা ব্রাউন যে গাড়ি চালিয়ে কৃষ্ণেন্দুর ডাক্তারখানায় আসছে সেই গাড়ির চালক ছিলেন পরিচালক অজয় কর নিজে।
পরিচালক অজয় কর সম্বন্ধে বিস্তারিত তথ্য গুগলেরও অজানা। ভদ্রলোক দেখতে কেমন ছিলেন তা জানতেও যথেষ্ট বেগ পেতে হয়। অথচ তার ক্যামেরা জাদু আজও টালিগঞ্জে কিংবদন্তি। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে একটা হারানো সুর, সপ্তপদী, সাত পাকে বাঁধা, শুন বরনারী, অতল জলের আহ্বান, বা জিঘাংসা বানানো একেবারে সহজ ব্যাপার নয়। তাই হে পাঠক ভাবো ভাবো ভাবা প্র্যাকটিস করো।
শুধু সংলাপ যে একটা ছবিকে কতদূর টেনে নিয়ে যেতে পারে তার প্রমান বিমল রায় প্রণীত “উদয়ের পথে” (১৯৪৩) আর দ্বিতীয়ত “সপ্তপদীর দ্বিতীয়ার্ধে কৃষ্ণেন্দু ও রীনা ব্রাউনের কথোপকথনই একমাত্র নাট্যবস্তু। ভেবে দেখুন, “ওথেলো” অভিনয়ের পর্বটুকু। আজ বাংলায় ডাবিং জলচল হয়ে গেছে কিন্তু সে যুগে ব্লাইন্ড ডাবিং ই একমাত্র আশ্রয়। কি আশ্চার্য চাতুর্যেই নাঅজয় কর মিশিয়েছিলেন উত্তম কুমারের ঠোঁট ও উৎপল দত্তের গলা। কিন্তু তাও বড় কথা নয়; একজন বাঙালি তরুণ তার প্রনয়িনীর কাছে যে সামান্য স্পর্শের উত্তাপ পেতে চায় তা কি অসামান্যভাবে ট্রাজিডির আগুনে পৌঁছে যেতে পারে তা এই দৃশ্য পর্যায়ে এক্সপ্রেশনিস্ট আলোর ব্যাবহার ও মিড লং শটগুলিকে দেখলে বোঝা যায়। অথবা মত্ত মাধবীলতার মতো রীনা ব্রাউন যখন ট্রেনের ধাতব শব্দে কাঁপতে থাকা আয়নায় কৃষ্ণেন্দু কে ভাঙতে দেখে ভ্রষ্ট স্মৃতি উদ্ধার করে সেই মুহূর্তটি?
কথা, সুর আর ছবির কারুকার্যময় অন্দর মহলে অজয় কর যে রাজকন্যার সিনেমার বাসরশয্যা রচনা করেছিলেন, আমাদের চলচ্চিত্রবোধ কি একবারও অপরাধে মাথা নওয়াব না যে সেই রাজকন্যাকে কনে- দেখা আলোয় আরো ভালো করে দেখার সুযোগ সে দিল না?
Advertisement



