রম্যাঁ রলাঁ
পূর্ব প্রকাশিতর পর…
Advertisement
ঘন ঘন করতালির মধ্যে জুলিয়া বাঁদা একদিন এই কৌলিন্যের দম্ভই প্রকাশ করিয়াছিলেন। আমার বহু প্রবন্ধে এবং লা’ম আঁশাঁতে পুস্তকের বহু স্থানে আমি বলিয়াছি—কখনও যথেষ্ট বলিতে পারিয়াছি বলিয়া মনে করিতে পারি নাই—বাস্তব সংস্পর্শ শূন্য মনস্বিতার এই পুতুল পূজার প্রতি আমার নিবিড় ঘৃণা এবং বিদ্বেষ আছে। যে মাটি হইতে সে জীবনরস আহরণ করিতেছে সেই মাটির সহিত সংস্রব ছিন্ন করিয়া কেমন করিয়া বাঁচিবে। বাস্তবের সহিত আত্মীয়তায় যে বিপদ আছে তাহার হাত হইতে সে বাঁচিল বটে কিন্তু তাহার প্রাণরসটুকুও ত’ বাস্তবের হাতে, ইহা ছাড়া সে বাঁচিবে কেমন করিয়া। এই পৌত্তলিকতা ইচ্ছাকৃত হউক বা না হউক রাজনীতির আধুনিক ধুরন্ধরগণ ইহাকে উপেক্ষা করেন না; ইহাকে তাহারা উৎসাহ দেন; কারণ ‘‘এই বাস্তববিদ্বেষী কলাবিলাসী মননজীবীদের ‘‘অপ্রযুক্ত’’ বুদ্ধির খেলায় জনসাধারণের বুদ্ধিমান অংশের মনযোগহ টানিয়া লওয়ার ফলে বহির্জগতে জাতিপুঞ্জের ভাগ্যনিয়ন্ত্রণের যে বিরাট সংগ্রাম চলিয়াছে সেদিকে তাহাদের আর নজর পড়ে না।’’
Advertisement
যে চিন্তার স্বাধীনতা থাকিলে যুদ্ধক্ষেত্রে আত্মপ্রভাব বিস্তারের সুবিধা হয় তাহা আমি চাই। কিন্তু একথা মানি না যে, যে দেখে তাহার আর কাজ করিবার প্রয়োজন হয় না। কেহ যখন ভালো করিয়া দেখিতে পায় তখন ভালো করিয়া কাজও সে করিতে পারে। ‘‘কাজ করিতে হইবে’’। বুদ্ধিজীবীদের আন্তর্জাতিক সঙ্ঘে (রেলজিসের দেওয়া নাম) ‘‘চিন্তার সেবকগণের’’ সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন হইতে দম্ভভরে দূরে থাকিবার কোনো অধিকার নাই। ‘‘মানুষের শ্রমজীবনের একটি বিশেষ অংশ তাহারা।’’ স্টালিন একটি ছোট্টকথায় ইহাদের নাম দিয়াছেন ‘‘ইনজিনিয়ার্স অব দি স্পিরিট।’’
শ্রমজীবী সহকর্মীগণের চেয়ে কোনো অংশে উঁচু বলিয়া ইহারা নিজেদের দাবী করিতে পারে না। শ্রমজীবী ছাড়া ইহাদের কোনো অস্তিত্ব নাই। দুই দলের কার্যের লক্ষণ হইবে এক— বৃহত্তর মহত্তর সমাজ প্রতিষ্ঠা। রেলজিস যখন তরুণদের জন্য আমার নিকট বাণী চাহিয়া পাঠাইলেন আমি লিখিলাম, ‘‘তাহারা যেন কখনও চিন্তা হইতে কর্মকে বিচ্ছিন্ন না করে।’’ যে সংগ্রাম আজ নূতন পৃথিবীর সৃষ্টি করিতেছে তাহার মহান যোদ্ধা হওয়ার চেয়ে চিন্তার আজ আর বড় কোনো কাজ নাই।
(আট)
আমি যখন হইতে সৈনিক হইয়াছি সে কোনো অদূর অতীতের কথা নহে। ১৯০০ সালে লেখা আমার ‘‘জনসাধারণের রঙ্গমঞ্চ’’ পুস্তকখানিতে আমি ফাউস্টের কথা দিয়া শেষ করিয়াছিলামঃ ‘‘প্রারম্ভে ছিল কর্ম।’’ আমার সমস্ত বই-এর মধ্যে এই কথাই আমি বলিতে চাহিয়াছি। আমার জাঁ ক্রিস্তফ সেই ক্রিস্তফ যে শিশুপৃথিবীকে কাঁধে লইয়া নদী পার হইয়াছিল। আনেৎ, ‘‘মুগ্ধ হৃদয়’’ সেই নদী যে নদীর নামে তাঁহার নাম— ‘‘সেই জীবন্ত জলধারা—‘‘সেই চিরপ্রবহমান জীবন।’’ মরণে পর্যন্ত আমরা সংগ্রামর পুরোভাগেই থাকিব।’’ এমনকি আর্টে, যে আর্ট আমার কাছে আমার সমগ্র সত্তার সামিল, এবং সংগীতে বিটোফেন ও হাণ্ডল-এর মত সেই সকল মহাশ্রষ্টাগণের দিকেই আমার আকর্ষণ বেশি, যাহাদের সংগীত কর্মের প্রেরণা আনে।
আমার মানসলোক যখন ভারতবর্ষ হইতে তীর্থযাত্রা সারিয়া ফিরিল, অনন্তের যে স্বানু স্বপ্নের মধ্যে ভারতীয় চিন্তাধারার পরিসমাপ্তি ঘটিয়াছে সেই চিন্তাকে সে সঙ্গে লইয়া ফিরিল না,
(ক্রমশ)
Advertisement



