বহুমুখী ব্যক্তিত্বের অধিকারী বিপিনচন্দ্র পাল (১৮৫৮-১৯৩২) ছিলেন নব্য রাজনৈতিক চেতনায় উদবুদ্ধ নবীন ভারতের অন্যতম রূপকার। তাঁর স্বদেশী ও স্বরাজের বাণী বাংলা তথা ভারতবর্ষের এক প্রান্ত হতে অপর প্রান্ত পর্যন্ত ব্যাপক প্রসার লাভ করেছিল। মসি যে অসি অপেক্ষা শক্তিধর এই প্রবাদ বাক্য বিপিচন্দ্রের জীবনে যে পরিমাণে সত্য হয়ে উঠেছিল, একমাত্র অরবিন্দ ঘোষ ছাড়া সমকালীন অপর কোন স্বদেশ সেবকের জীবনে তা হয় নি। বাগ্মী, রাষ্ট্রনায়ক এবং নবীন ভারতের নব্য জাতীয়তাবাদের প্রধান প্রবক্তা, এটাই বিপিনচন্দ্রের সর্বজন স্বীকৃত পরিচয়। কিন্তু তাঁর সামগ্রিক জীবন সাধনায় সাংবাদিকতা কোন ক্রমেই উপেক্ষনীয় নয়। মাসিক, সপ্তাহিক, পাক্ষিক, দৈনিক প্রভৃতি প্রায় এক ডজনের অধিক পত্রিকা তিনি সম্পাদনা করেছেন। গান্ধীজীও জনমত গঠন করতে সংবাদ পত্রকে সব চেয়ে গুরুত্ব দিয়ে ছিলেন।
ঙ্গভঙ্গ তখনও শুরু হয়নি, তার দু-দশক আগে ১৮৮০ সালের মাঝামাঝি সময়ে শ্রীহট্ট শহর হতে ‘পরিদর্শক’ নামে একখানি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ শুরু হয়। এই পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব গ্রহণের ভিতর দিয়ে বিপিনচন্দ্র পালের সাংবাদিক জীবনের সূচনা হয়।
বিপিনচন্দ্রের মতে সেই সময়েই শুধু শ্রীহট্ট জেলা নয় প্রায় সমগ্র বাংলা প্রদেশের শিক্ষিত জনমত প্রকাশের অন্যতম শক্তিশালী বাহক হয়ে ওঠে এই পত্রিকা। স্বাধীনভাবে পত্রপত্রিকার নীতি ও সমস্যার দেখা শোনা করার অপূর্ব সুযোগ বিপিনচন্দ্রকে সৃষ্টি করে দেয় এই পরিদর্শক সাপ্তাহিক। ১৮৮৪ সালে বিপিনচন্দ্র ও সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের কিছু যুবক নম্র জাতিয়তাবাদের বক্তব্য তুলে ধরার জন্য ‘আলোচনা’ নামে বাংলা মাসিক পত্র প্রকাশ করেন। এর উদ্দেশ্য ছিল হিন্দু ও ব্রাহ্ম রক্ষণশীলতার মধ্যে যুক্তি সম্মত বোঝাপড়া ও সমন্বয় সাধন করা। এই মাসিক পত্রের লেখক তালিকায় ছিলেন রাজনারায়ণ বসু, শিবনাথ শস্ত্রী, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ। হিন্দু বিধবা পুনর্বিবাহ ও অন্যান্য প্রগতিশীল সমাজসংস্কারের সমর্থনে বিপিনচন্দ্র ‘আলোচনার’ স্তম্ভে লেখনী ধারন করেন।
এরপর বিপিনচন্দ্র পাল প্রথমে অবৈতনিকভাবে ‘বেঙ্গল পাবলিক ওপিনিয়ন’ এর সম্পাদকের সহকারীরূপে যোগদান করেন। এই পত্রিকায় যোগদান করে বিপিনচন্দ্র ইংরেজি সাংবাদিকতায় নিয়মিত শিক্ষা লাভ করেন। ১৮৮৪ সালের শেষভাগে ‘বেঙ্গল পাবলিক ওপিনিয়ন’ পত্রিকার প্রকাশ বন্ধ হয়ে গেলে বিপিনচন্দ্রের সাংবাদিকচর্চাতে সাময়িকভাবে ছেদ পড়ে যায়। তিন বৎসর পর ১৮৮৭ সালে অক্টোবর মাসে তিনি লাহোরের ইংরেজি সাপ্তাহিক ‘ট্রিবিউন’ পত্রিকার সহ-সম্পাদকের পদ লাভ করেন। সম্পাদক শীতলাকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের পাঁচ মাস অনুপস্থিতির কারণে বিপিনচন্দ্র সম্পাদকীয় দায়িত্ব বহন করেন। কিন্তু পরে যে কোন কারণে হোক বিপিনচন্দ্র তাঁর পদত্যাগ পত্র দাখিল করেন। সর্দার দয়াল সিং তাঁর ক্ষোভের প্রতিকারের আশ্বাস দিলেও বিপিনচন্দ্র তা সবিনয়ে সেই প্রস্তাব গ্রহণে অসম্মতি প্রকাশ করেন। এর কারণ সম্পর্কে ইংরেজি আত্মজীবনীতে বিপিনচন্দ্র লেখেন –‘কোন পত্র পত্রিকার মালিক এইভাবে সম্পাদকের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করুন, ইহা আমি কখনই পছন্দ করিতে পারি নাই, যদিও এ ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ আমার অনুকূলেই হইত’। তবে বিপিনচন্দ্র পাঁচ মাস ‘ট্রিবিউন’ পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্বে থেকে পাঞ্জাবের শিক্ষিত মানুষের পত্রিকার প্রতি উচ্চসমাদর আদায় করতে সমর্থ হয়ে ছিলেন।
তারপর বিপিনচন্দ্র (১৮৮৮) লাহোর থেকে কলকাতা ফিরে আসেন। এ সময় প্রায় চার বৎসর সাংবাদিকতার সঙ্গে তাঁর প্রত্যক্ষ যোগ ছিল না। তিনি মনে করতেন সমস্ত কাজের মধ্যে বলা এবং লেখার কাজেই তাঁর যোগ্যতা সর্বাধিক। সেই সময় তিনি ‘আশা’ নামে একটি মাসিক পত্রিকা (১৮৯২) এবং ‘কৌমুদী’ নামে একটি বাংলা পাক্ষিক পত্রিকা (১৮৯৪) প্রকাশ করেন। এই দুটি পত্রিকারই উদ্দেশ্য ছিল ব্রাহ্মসমাজের ত্রুটি বিচ্যুতির সংশোধন। ‘আশা’ পত্রিকাটি দীর্ঘজীবী না হলেও এতে ব্রাহ্মসমাজের তৎকালীন সংবিধানের সীমাবদ্ধতা ও ক্ষতিকর দু-দিক বেশি গুরুত্ব পেত।
পরে বিপিনচন্দ্র ইংল্যান্ড, আমেরিকা হয়ে ভারতে ফিরে এলেন। ঐ সময় নিউইয়র্কের পাঠাগারে এক অজ্ঞাতনামা ভারত ভক্ত মার্কিন ভদ্রলোক বিপিনচন্দ্রের কানে স্বাধীনতার নতুন মন্ত্র শুনিয়ে ছিলেন। বিপিনচন্দ্র অনুভব করলেন জগৎ সভায় শ্রেষ্ঠ আসন পেতে হলে দেশকে আগে স্বাধীন করা প্রয়োজন। আর তা করতে হলে ধর্ম-বর্ণ-ভাষা নির্বিশেষে সমগ্র ভারতবাসীকে এক জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ করা অপরিহার্য। এই ভাব নিয়ে নবীন ভারত গঠনের স্বপ্নে বিপিনচন্দ্র পাল তাঁর সম্পাদনায় সেই সময়কার বিখ্যাত ইংরেজি সাপ্তাহিক ‘নিউ ইণ্ডিয়া’ ১৯০১ সালের ১২ আগস্ট প্রকাশ করেন। এই পত্রিকার পৃষ্টপোষকমণ্ডলীর অন্যতম ছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ। পত্রিকার প্রথম দিকের লেখক গোষ্ঠীর মধ্যে ছিলেন ভগিনী নিবেদিতা। নিউ ইণ্ডিয়ার মূলমন্ত্র ছিল For God, Humanity and the Fatherland.। বিপিনচন্দ্র এই পত্রিকার স্তম্ভে Composite Patriotism যৌগিক স্বাদেশিকতা তত্ত্ব প্রচার করেন। মুখ্যত সাংস্কৃতিক প্রচার পত্রিকারূপে আত্মপ্রকাশ করলেও পরিবর্তিত পরিস্থিতির প্রয়োজনে নিউ ইণ্ডিয়া অচিরেই নব্ব ভারতীয় জাতিয়তাবাদ প্রচারের শক্তিশালী মুখপত্রে রূপান্তরিত হয়।
‘নিউ ইণ্ডিয়ার’ ১৯০৪এর ৭ জুলাই সংখ্যায় প্রকাশিত ‘The Partition of Bengal’ শীর্ষক প্রবন্ধে বিপিনচন্দ্র প্রস্তাবিত বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে জাগ্রত প্রবল জনমতের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে যেন ভবিষ্যদ্রষ্টার ন্যায় লিখলেন – ‘though such discontent is not of much consequence now, the cumulative effect of it may be such that in course of time, the Government may find it very difficult to cure or cope with it.’
বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে স্বদেশী আন্দোলনের উদ্ভব ঘটে। এই আন্দোলন আশু লক্ষ্য অতিক্রম করে ব্যাপকতর জাতীয় আন্দোলনের আকার ধারণ করে। কংগ্রেস রাজনীতি নরমপন্থী ও চরমপন্থী নামে দুটি দলে ভাগ হয়ে যায়, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘দি বেঙ্গলী’, মতিলাল ঘোষের ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’, কালীপ্রসন্ন কাব্য বিশারদের ‘হিতবাদী’ প্রভৃতি নরমপন্থীর শক্তিশালী মুখপত্র ছিল। গরমপন্থীদের ‘নিউ ইণ্ডিয়া’ এবং ‘সন্ধ্যা’ থাকলেও এতখানি দায়িত্ব পালন করা সম্ভব ছিল না। ‘যুগান্তর’ও গরমপন্থীদের প্রয়োজন পূরণ করতে পারল না।
এই অভাব অনুভব করে বিপিনচন্দ্র পাল কালীঘাটের হরিদাস হালদার ও শ্রীহট্টের ক্ষেত্রমোহন সিংহের আর্থিক আনুকূল্যে দৈনিক ইংরেজি পত্রিকা ‘বন্দেমাতরম’ প্রকাশ করেন ১৯০৬ সালের ৬ আগস্ট। ‘বন্দেমাতরম’ পত্রিকার মূলমন্ত্র ছিল ‘India for Indians’. রবীন্দ্রজীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় মন্তব্য করেছেন ‘ইন্ডিয়া ফর ইণ্ডিয়ানস’ হইতেছে মহাত্মাজীর ‘কুইট ইণ্ডিয়ার’ মন্ত্রের অগ্রবাণী। ‘বন্দেমাতরম’ প্রায় দু-বৎসর দু-মাস তিন সপ্তাহব্যাপী টিঁকে ছিল। এই অল্প সময়কালের মধ্যে পত্রিকাখানি সাংবাদিকতার যে উচ্চমান প্রতিষ্ঠা করেছিল তা সংবাদিকতা চর্চার ইতিহাসে গৌরবের বস্তু। এই পত্রিকাতেই বিপিনচন্দ্র প্রবল পরাক্রান্ত ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রামের হাতিয়ার রূপ নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ নীতি প্রচার করেন। কিন্তু পরিচালকমণ্ডলীর সঙ্গে বিপিনচন্দ্রের মতানৈক্যের ফলে পত্রিকার সঙ্গে তাঁর সাময়িকভাবে সম্পর্কচ্ছেদ ঘটে। পরবর্তী সময় সুভাষচন্দ্রও সংবাদ পত্রকে হাতিয়ার করে ছিলেন, তাঁর ফরওয়ার্ড ব্লক পত্রিকায় প্রতিটি সংখ্যায় থাকত স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন।
১৯০৮ সালে দ্বিতীয়বার বিপিনচন্দ্র বিলেত যান। লন্ডনে তিনি ইংরেজি পাক্ষিক ‘স্বরাজ’ (১৯০৯) এবং ‘ইণ্ডিয়ান স্টুডেন্ট’ প্রকাশ করেন। শেষোক্ত পত্রিকায় বলা হয়েছিল ‘ছাত্রের কর্তব্য হইল ভাবাবেগ এবং পক্ষপাতের দ্বারা প্রভাবিত না হইয়া যুক্তির আলোকে প্রত্যেক সমস্যা সম্পর্কে অধ্যয়ন, অনুসন্ধান এবং সম্যক জ্ঞান অর্জন’। কিন্তু আর্থিক অনটনে এই দুটি পত্রিকা বন্ধ হয়ে যায়। বিপিনচন্দ্র দেশে ফিরে এলে তার সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ইংরেজি মাসিক পত্র ‘হিন্দু রিভিউ’। এই স্বল্পায়ু পত্রিকার লক্ষ্য হিন্দু জাতীয়তাবাদকে অঙ্গীকার করে বিশ্বজনীন মানবিকতার মহাসমন্বয়ের বাণী প্রচার। এরপর তিনি নিজে উদ্যোগী হয়ে আর কোন পত্রপত্রিকা প্রকাশ করেন নি। এক ভিন্ন রাজনীতির আবহে ১৯১৯-২০ সালে বিপিনচন্দ্র এলাহাবাদ হতে প্রকাশিত ‘দি ডেমোক্র্যাট’ এক ইংরেজি সাপ্তাহিক এবং ‘দি ইণ্ডিপেণ্ডেণ্ট’ নামে এক ইংরেজি দৈনিক সম্পাদনা করেন। এই পত্রিকায় তিনি ‘Non Co-operation our last chance’ শিরোনামে ধারাবাহিক ভাবে দশটি প্রবন্ধ লেখেন। কিন্তু পরে অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচীর রূপায়ণ পদ্ধতি নিয়ে মতিলাল নেহরুর সঙ্গে তাঁর মতভেদ হওয়ায় পত্রিকার সম্পাদকের পদে ইস্তফা দেন। এরপর বিপিনচন্দ্রের শেষ উল্লেখযোগ্য ঘটনা বিখ্যাত ইংরেজি দৈনিক ‘বেঙ্গলীর’ প্রধান সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ (১৭ জুন, ১৯২৪ – ১৩মে, ১৯২৫)। জীবন সায়হ্নে তিনি ভবতোষ রায় সম্পাদিত সাপ্তাহিক পত্র ‘হিন্দুর’ ইংরেজি ক্রোড়পত্রের পরিচালনার ভারগ্রহণ করেন। এটি তার সাংবাদিক জীবনের শেষ উল্লেখযোগ্য ঘটনা।
বিপিনচন্দ্র পাল তাঁর সমগ্র জীবনে মাসিক, পাক্ষিক, সাপ্তাহিক ও দৈনিক পত্রিকা (ইংরেজি ও বাংলা) মিলিয়ে প্রায় ১৪টি পত্রিকা সম্পাদনা করে ছিলেন। তবে এর মধ্যে ‘নিউ ইণ্ডিয়া’ এবং ‘বন্দেমাতরম’ এর সম্পাদনাকালেই বিপিচন্দ্রের সাংবাদিক-সত্তা চরম স্ফূর্তি লাভ করেছিল। যে সত্যনিষ্ঠা, ধর্মবোধ, আত্মপ্রত্যয় এবং আপসবিহীন সংগ্রামী মনোভাবের উপাদানে বিপিনচন্দ্রের ব্যক্তিত্ব গঠিত, সেই সমস্ত উপাদান তাঁর সাংবাদিক জীবনেও প্রতিফলিত হয়েছিল। পরাধীন ভারতে তাঁর মতো অন্য কেউ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে এমন নির্ভীকতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারেন নি।