• facebook
  • twitter
Friday, 5 December, 2025

উত্তরবঙ্গের বিপর্যয় দেখিয়ে দিল, প্রকৃতির প্রতিশোধের চরিত্র এমনই নির্মম

প্রতিটি সিদ্ধান্তের আগে সম্ভাব্য পরিণতি সমীক্ষা করা জরুরি। মনে রাখতে হবে, নবীন ভঙ্গিল পর্বত হিমালয়ের উপরে জোরজুলুম করলে প্রকৃতি বহু গুণে তা ফেরত দেবে।

উত্তরবঙ্গের প্রাকৃতিক বিপর্যয়। ফাইল চিত্র

শোভনলাল চক্রবর্তী

বিধ্বস্ত পাহাড়। প্রবল বৃষ্টিপাতের পর নদীতে জলের তোড়ে ভেসে গেল রাস্তা, সেতু, ঘরবাড়ি। বহু প্রাণহানির খবর এখনই মিলেছে; আশঙ্কা, সংখ্যাটি আরও বাড়বে। রাজ্যের এক প্রান্তে যখন এমন বিপর্যয় চলছে, তখন অন্য প্রান্তে মুখ্যমন্ত্রীর পক্ষে দুর্গাপুজোর ‘কার্নিভাল’-এ মেতে থাকা শোভন হল কি না, সে প্রশ্ন অন্যত্র বিচার্য। এই মুহূর্তে প্রধান প্রশ্ন হল, কী ভাবে এমন বিপর্যয় ঘটতে পারে? রাজ্য প্রশাসনের তরফে বৃষ্টিপাতের প্রাবল্যের কথা বলা হচ্ছে। ৩০০ মিলিমিটারের চেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত সামান্য কথা নয়, ঠিকই— কিন্তু, উত্তরবঙ্গের পাহাড় আগে কখনও এমন বৃষ্টিপাতের সাক্ষী থাকেনি, তা তো নয়। আসলে যা ঘটেছে, রাজ্য প্রশাসনের পক্ষে সে কথা স্বীকার করা মুশকিল— রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায়, প্রশাসনিক ঔদাসীন্যে হিমালয়ের অতি ভঙ্গুর বাস্তুতন্ত্রের সর্বনাশ হয়েছে। উত্তরাখণ্ড বা হিমাচল প্রদেশ বিষয়ে এ কথাটি যেমন সত্য, উত্তরবঙ্গের জন্যও তেমনই সত্য। পাহাড়ে যত্রতত্র বাড়ি উঠেছে কোনও নিয়মকানুনের তোয়াক্কা না করেই; অতি সংবেদনশীল অঞ্চলে গড়ে উঠেছে রিসর্ট। পাহাড়ি ঝোরার মুখ বন্ধ করে জমি দখল করা হয়েছে; নদী থেকে ক্রমাগত পাথর চুরির ফলে বদলে গিয়েছে নদীর খাতই। গাছ কাটা হয়েছে খেয়ালখুশি মতো। ফলে, মাটি ক্রমশ আলগা হয়েছে, বেঁধে রাখার ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। আর একই সঙ্গে পাহাড়ি নদী সমতলে নামার পর তার নাব্যতা হ্রাস পেয়েছে। সব মিলিয়ে, অতিপ্রবল বৃষ্টিপাতের পর পাহাড়ে নদীতে যখন হঠাৎ করে জলের পরিমাণ বেড়েছে, তখন সেই জল দ্রুত নীচের দিকে নামতে পারেনি; তা নদীখাত ছাপিয়ে দু’কূল ভাসিয়েছে। যথেষ্ট গাছ থাকলে, মাটি শক্ত থাকলে সেই ধাক্কা সামলানো যেত— যে-হেতু তা নেই, ফলে জলের স্রোতে ভেসে গিয়েছে ঘরবাড়ি, রাস্তা, সেতু। প্রকৃতির প্রতিশোধের চরিত্র এমনই নির্মম। পরিস্থিতি সামলাতে নেমেছে রাজ্য প্রশাসন; সেনাবাহিনীও তৎপর হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী সপারিষদ উত্তরবঙ্গ সফরে গিয়েছেন। অনুমান করা চলে, বেশিরভাগ রাস্তা সারিয়ে ফেলা যাবে কিছু দিনের মধ্যে। মৃতদের জন্য ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা হবে; যাঁদের ঘরবাড়ি ভেসে গিয়েছে, তাঁদেরও পুনর্বাসন হবে কোনও না কোনওভাবে। কিন্তু, তাতে এই সমস্যা মিটবে কি? না কি পরবর্তী বিপর্যয়ের জন্য দিন গুনবে উত্তরবঙ্গ? যে কারণগুলির জন্য আজ এই অবস্থা হয়েছে, তার কোনওটিই প্রাকৃতিক নয়— সবই রাজনৈতিক অর্থনীতিসঞ্জাত। তার মধ্যে রাষ্ট্রের ‘উন্নয়ন-ভাবনা’ রয়েছে— কেবলমাত্র তিস্তার উপরেই নির্মিত বাঁধের সংখ্যা এক হাতের কড়ে গুনে শেষ করা যাবে না। রয়েছে অপরিকল্পিত নগরায়ণ— রাজনৈতিক যোগাযোগ এবং টাকার জোর থাকলেই যেখানে ইচ্ছা, যত বড় ইচ্ছা বাড়ি তৈরি করা যায়, ফেঁদে বসা যায় হোটেল বা হোম-স্টে’র ব্যবসা এবং রয়েছে অকৃত্রিম চুরিও— নদীখাতের পাথর, বালি, অরণ্যের গাছ, সবই চুরি করা হয় নির্দ্বিধায়। পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক অর্থনীতির যে চরিত্র এখন প্রশ্নাতীত, সেই অবৈধ খাজনা আদায়ের প্রবণতা আজ উত্তরবঙ্গের হিমালয় অঞ্চলকে এই বিপদের মুখে এনে দাঁড় করিয়েছে। বিপর্যয় ঘটার পর আপৎকালীন ত্রাণ কর্মসূচির মাধ্যমে এই সমস্যার কোনও সমাধান হবে কি? উত্তরটি বিলক্ষণ জানা। সমাধানের পথ অন্যত্র। তার জন্য খাজনা আদায়ের নীতিটি পরিত্যাগ করতে হবে।

Advertisement

আজকের দিনে দাঁড়িয়ে এই দাবি করার কোনও অর্থ হয় না যে, পাহাড়ে কোনও রকম ‘উন্নয়ন’ চলবে না। কিন্তু, তার জন্য কোনও রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক বিবেচনা নয়, বিশেষজ্ঞদের মতামতকে শিরোধার্য করতে হবে। প্রতিটি সিদ্ধান্তের আগে সম্ভাব্য পরিণতি সমীক্ষা করা জরুরি। মনে রাখতে হবে, নবীন ভঙ্গিল পর্বত হিমালয়ের উপরে জোরজুলুম করলে প্রকৃতি বহু গুণে তা ফেরত দেবে। সেই ধাক্কা সামলানোর ক্ষমতা যে মানুষের নেই, বিপর্যস্ত দার্জিলিং জেলা এই মুহূর্তে সেই সত্যের সাক্ষ্য বহন করছে। রাতভর বৃষ্টিতে বিপর্যস্ত দার্জিলিং। মিরিক, সুখিয়াপোখরির অবস্থাও বেহাল। উত্তরবঙ্গের প্রায় সব নদীর জলস্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। এই আবহে বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে ডুয়ার্স-সহ উত্তরবঙ্গের জেলাগুলির বিভিন্ন এলাকাতেও। শিলিগুড়ির পোড়াঝাড়ে মহানন্দা নদীর বাঁধ ভেঙে প্লাবিত আস্ত গ্রাম। ফুলেফেঁপে উঠেছে তোর্সা নদী। তার জল ঢুকে জলমগ্ন গোটা কোচবিহার শহর। কোথাও হাঁটুজল জমেছে। কোথাও আবার কোমরজল। উদ্ধারকাজে নেমেছে বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী। মালদহের মানিকচকও জলমগ্ন। সেখানে বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে বলে আশঙ্কায় প্রশাসনের একাংশ। আলিপুর আবহাওয়া দফতর জানিয়েছে, আলিপুরদুয়ার, জলপাইগুড়ি, কোচবিহারে ভারী বৃষ্টি চলবে। তাই সেখানকার পরিস্থিতি নিয়ে ইতিমধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুরে এখনও ভারী বৃষ্টি হয়নি।

Advertisement

তবে পরিস্থিতির দিকে নজর রাখছে প্রশাসন। দার্জিলিং, কালিম্পঙে সারা রাত ধরে বৃষ্টি হয়েছে। ধস নেমে মৃত্যু হয়েছে ১৭ জনের। মৃতের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে পারে বলে আশঙ্কা। সেই সঙ্গে বৃষ্টি হয়েছে ভুটানেও। আর সে কারণে ফুলেফেঁপে উঠেছে তিস্তা, তোর্সা, মহানন্দা, জলঢাকা-সহ উত্তরবঙ্গের নদীগুলি। ভুটান এবং পাহাড়ে ভারী বৃষ্টির কারণে জল নেমে এসেছে ডুয়ার্স-সহ উত্তরবঙ্গের সমতলেও। প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, ফুলেফেঁপে উঠেছে মহানন্দা নদী। নদীর বাঁধ ভেঙে জল ঢুকে পড়েছে শিলিগুড়ির পোড়াঝাড় এলাকায়। ধসে গিয়েছে বেশ কিছু বাড়ি। বহু মানুষ ঘরছাড়া হয়েছেন। জলপাইগুড়ি জেলা প্রশাসন মহানন্দা নদীর ব্যারেজের লকগেট খুলে দেন। তার ফলে জল কিছুটা নামতে শুরু করে। তবে প্রশাসনের আধিকারিকদের একাংশ মনে করছেন, জল নামতে অনেক সময় লাগবে। এর মধ্যে ভারী বৃষ্টির পূর্বাভাস রয়েছে কয়েক জেলায়। ফলে বৃষ্টি শুরু হলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে বলে আশঙ্কা। আবহাওয়া দফতরের পূর্বাভাস ছিল। সেই মতো বৃষ্টি শুরু হয়েছে কোচবিহারে। ভোর থেকে কয়েক ঘণ্টা চলেছে মুষলধারে বৃষ্টি। তার জেরে প্রায় গোটা কোচবিহার জলমগ্ন। শহরের ২০টি ওয়ার্ডে হাঁটু জল, কোথাও কোমর পর্যন্ত জল। সব থেকে খারাপ পরিস্থিতি কোচবিহার মিনি বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন এলাকা, রাজবাড়ি সংলগ্ন এলাকা কলাবাগান, কদমতলা, হাসপাতাল চৌপতি, বিশ্বসিংহ রোড, সুনীতি রোডে। ইতিমধ্যেই হু হু করে বাড়ছে তোর্সা নদীর জল।

কোচবিহার সদর মহকুমা শাসক জানান যে, কোচবিহার শহরের দু’টি ব্লকে বিপর্যয় মোকাবিলা দল কাজ করছে। কোচবিহার দু’নম্বর ব্লকের সোনারপুরে তোর্সা নদীর চরে বসতি এলাকা থেকে কিছু মানুষজনকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। তোর্সা নদীর জলস্তর এখনও পর্যন্ত বিপদসীমার নীচেই বইছে। কিন্তু তার জলস্তর বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে কোচবিহার পুরসভা এলাকার জল বার হতে পারছে না। পুরসভার জল নিকাশি দল, বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী তৈরি রয়েছে। বিভিন্ন এলাকায় কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছিল। রাতভর বৃষ্টিতে বিপর্যস্ত জলপাইগুড়ির নাগরাকাটা। জলের স্রোতে ধসে গিয়েছে বেশ কিছু কালভার্ট, সেতু। জলমগ্ন বহু এলাকা। সেখানে ভেঙে পড়েছে বহু বাড়ি। উদ্ধারকাজে নেমেছে জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী। তাদের সূত্রে জানা গিয়েছে, ৩৫ জন গ্রামবাসীকে জিপ লাইনের মাধ্যমে উদ্ধার করা হয়েছে। ২০ জনকে নৌকায় চাপিয়ে নিরাপদ স্থান সরানো হয়েছে। এক জনের দেহও উদ্ধার হয়েছে।

অন্যদিকে, ভুটানে লাগাতার বৃষ্টির কারণে নদীগুলিতে জলস্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। ভুটানের জল হাতিনালা দিয়ে এসে বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বানারহাট, বিন্নাগুড়ি এলাকায়। সেখানে বেশ কিছু এলাকা ভেসে গিয়েছে। শিলিগুড়ির দুধিয়ার কাছে ভেঙে পড়েছে লোহার সেতু। জলপাইগুড়ির মাল শহর সংলগ্ন বেশ কিছু এলাকাও জলমগ্ন। ব্যাহত হয়েছে স্বাভাবিক জনজীবন। উত্তরবঙ্গের ভারী বৃষ্টির ফলে মালদহের মানিকচক ব্লকের উত্তর চণ্ডীপুর, দক্ষিণ চণ্ডীপুর এবং হীরানন্দপুর গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে বলে আশঙ্কা। বিহার এবং ঝাড়খণ্ডে বৃষ্টি হলে এখানে প্রভাব পড়তে পারে। অন্য দিকে, মহানন্দা নদীর জল আরও বাড়লে সমস্যা তৈরি হতে পারে। উত্তর এবং দক্ষিণ দিনাজপুর জেলায় এখনও পর্যন্ত সেভাবে ভারী বৃষ্টিপাত হয়নি। তবে এর আগে দুই দিনাজপুরে ভারী বৃষ্টি হয়েছিল। সেখানে আকাশ মেঘলা। টানা বৃষ্টি শুরু হয়েছে দার্জিলিং, কালিম্পঙে। তাতেই বিধ্বস্ত পাহাড়। বহু জায়গায় ধস নেমে রাস্তা বন্ধ। তিস্তার জল উঠে এসেছে জাতীয় সড়কের উপর। এখনও পর্যন্ত মোট ১৭ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গিয়েছে দার্জিলিং থেকে। পাহাড়ের জল এ বার নামছে সমতলেও। আর তাতেই বিপর্যস্ত হচ্ছে উত্তরবঙ্গের সমতল এলাকা। কেউ প্রশ্ন করতে পারেন যে, মুখ্যমন্ত্রী কার্নিভালে যোগ না দিয়ে যদি সে রাতেই উত্তরবঙ্গে ছুটতেন, অথবা নবান্নের কন্ট্রোল রুমে বসে থাকতেন, বন্যা পরিস্থিতি পাল্টাত কি? না। যে ঘটনা ঘটেছে, তাকে একা হাতে সামাল দেওয়ার সাধ্য কারও নেই। তবুও তিনি যে রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান, তার একটি অংশ বিপর্যস্ত হলে তাঁর সম্পূর্ণ মনোযোগ সেই পরিস্থিতির দিকেই থাকবে, এমনটাই প্রত্যাশিত। এমনটাই কর্তব্য। তবে অধুনা যে কোনও দুর্যোগই রাজনীতির হিসাব কষার মাহেন্দ্রসুযোগ, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর কাছেও, দেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছেও। সে কথা আবারও প্রমাণিত হল। বন্যা পরিস্থিতি পরিদর্শনে দিয়ে বিজেপির সাংসদ-বিধায়কের প্রহৃত হওয়ার ঘটনা চরম নিন্দনীয়, রাজনৈতিক রং বিচার না করেই দোষীদের গ্রেফতার করা জরুরি, কিন্তু প্রধানমন্ত্রী এই সুযোগে ক্ষুদ্র রাজনীতিতে উদ্বেলিত হলেন। ও-দিকে মুখ্যমন্ত্রী উৎসব-অঙ্ক মিটিয়ে আসরে নেমে বন্যার দায় চাপালেন সিকিম-ভুটানের উপরে। উল্লেখ করলেন না দেশের অন্যান্য অংশের মতোই পশ্চিমবঙ্গেও পাহাড়ে অবাঞ্ছিত, অবিবেচনাপ্রসূত নির্মাণের কথা, যেমন খুশি গাছ কাটার কথা, নদীর পাথর চুরি করার কথা। বললেন না যে, ডুয়ার্স-এ নদীগুলি নাব্যতা হারিয়েছে মূলত অসৎ রাজনৈতিক অর্থনীতির কারণে। প্রশাসনের, দলের অন্যায়গুলিকে আড়াল করে রাখার আর এক নামই অবশ্য রাজনীতি।

Advertisement