সংহিতা বন্দ্যোপাধায়
তৃতীয় পর্ব
Advertisement
কাবুলিওয়ালার দেশভাগ
সম্ভবত সেই সময় কংগ্রেসের প্রধান লক্ষ্য ছিল বৃটিশ সাম্রাজ্যের অবসান। লর্ড মাউন্টব্যাটেন উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের চুক্তির বিনিময়ে কংগ্রেসকে এই দাবি মেনে নেওয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়ে, বলেছিলেন যে অন্যথা হলে, দেশভাগের পরিকল্পনা বলবৎ হওয়ার আগেই তাঁরা অর্থাৎ ব্রিটিশ প্রশাসন ভারত ছেড়ে চলে যাবেন। তৎকালীন রাজনৈতিক প্রেক্ষিতে কংগ্রেসের পক্ষে ব্রিটিশের উপস্থিতি ছাড়া সেই পরিস্থিতি সামলানো সম্ভব ছিল না। খান আব্দুল গফফর খানের আশঙ্কা সত্য প্রমাণিত করে, মুসলিম লিগ আর কংগ্রেসের হাতে দ্বিধাবিভক্ত ভারতের ভার সঁপে দিয়ে ব্রিটিশ সরকার চলে গেলে, পাকিস্তানের জন্মের এক সপ্তাহের মধ্যে খান আব্দুল গফফর খানের খুদা-এ-খিদমতগার এবং কংগ্রেসের নির্বাচিত সরকার ভেঙে দেওয়া হয়। খান আব্দুল গফফর খান ও তাঁর ভাই পাকিস্তানে থাকলেও, তিনি ব্রিটিশশাসিত ভারতবর্ষে যতদিন কারাবাস করেছিলেন, তার তুলনায় পাকিস্তানে তাঁর জীবনের দীর্ঘতর কারাবাস পর্ব অতিবাহিত করেন।
Advertisement
পাকিস্থানের দাবির পাশাপাশি পাশতুনিস্তানের দাবি ১৯৪৬-এর নির্বাচনের নিরিখে ন্যায্য ছিল। যদি পাশতুনিস্থানের দাবিকে পাকিস্তানের সঙ্গে স্বীকৃতি দেওয়া হতো, তাহলে পাশতুনরা গণভোটে সম্মত ছিলেন। কিন্তু তা না হওয়ায়, খান আব্দুল গফফর খান সহ পাশতুনরা এই গণভোট বয়কট করলেন। ফলত, মুষ্টিমেয় মুসলমান সম্প্রদায়ের ভোটের ভিত্তিতে পাকিস্তানের দাবি গৃহীত হল।
এই প্রসঙ্গে আফগানিস্থানের জন্মের বিষয়টি উল্লেখযোগ্য, কারণ আফগানিস্থানের বাসিন্দা মূলত এই পাশতুনরাই।
ইতিহাস বলে, পাশতুনরা প্রথম ঐক্যবদ্ধ হয়ে ওঠে এহমদ শাহ আব্দালির নেতৃত্বে ১৭৫৭ সালে। তিনি রাজ্য বিস্তার করে, আটাক পর্যন্ত অধিকার করে ভারতবর্ষ আক্রমণ করেছিলেন। পরবর্তীকালে, তাঁর উত্তরাধিকারিদের সঙ্গে ব্রিটিশের চুক্তিতে, ১৮৯৩ সালে ডুরান্ড লাইন তৈরি করা হয়, পাশতুন জনজাতিকে দ্বিধাবিভক্ত করে। ডুরান্ড লাইনের এক দিকে বালোচ অঞ্চল ছিল, যা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত এবং পরে পাকিস্থানের অংশ হিসেবে পরিচিত, অন্যদিকে তৎকালীন ‘ফাটা’ অর্থাৎ, ফেডেরালি এডমিনিস্টার্ড ট্রাইবাল এরিয়া, এই অঞ্চল ছিল উপজাতি অধ্যুষিত। যারা ছিলেন স্বাধীনচেতা এবং ব্রিটিশের অধীনস্ত নয়। পাশতুনদের বরাবর নির্দিষ্ট এলাকায় নির্দিষ্ট জেলাভিত্তিক বসবাসের ইতিহাস থাকায় তাঁরা ডুরান্ড লাইনের মতো এলাকা নির্ধারক সীমারেখা চেয়েছিলেন।
শোনা যায়, উপজাতি অধ্যুষিত পাশতুনদের বসতি অঞ্চলে উজীরিস্তান এলাকায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর প্রায় পঞ্চাশ শতাংশই এই উপজাতিদের দমনে নিয়োজিত ছিল, কিন্তু তারা কখনোই এদের অধীনস্থ এমনকি অবদমিত করতে পারেনি। পরে, উজীরিস্তান বর্তমান খাইবার পাখতুনখোয়ার অন্তর্ভুক্ত হয়। ডুরান্ড লাইন স্বাধীন পাশতুন অঞ্চল থেকে ব্রিটিশ অধীনস্থ পাশতুন অঞ্চলকে আলাদা করেছিল।
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের নিরন্তর ভীতির কারণ ছিল রাশিয়ার আক্রমণ। আফগানিস্তানের অবস্থান ছিল রাশিয়া আর ব্রিটিশ শাসিত ভারতের মধ্যবর্তী এলাকায়। ব্রিটিশ আফগান শাসক শাহকে অপসারণ করে, নিজেদের বিশ্বস্ত পছন্দের আমিরকে সেখানে বসাতে চেয়েছিল রাশিয়ার হাত থেকে সাম্রাজ্য সুরক্ষিত রাখার জন্য। কথিত আছে, ১৬০০০ বৃটিশ সৈন্য এই উদ্দেশ্যে শাহের পশ্চাতে ধাবিত হয়, কিন্তু দু’বছর পর মাত্র একজন আধিকারিক মেজর ব্রায়ান জালালাবাদে ফিরে আসেন। তাঁকে যখন জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল সৈন্যবাহিনী কোথায়, তিনি বলেছিলেন, ‘আমিই বাহিনী’।
অর্থাৎ সেনাবাহিনীর আর অবশিষ্ট কেউ জীবিত ছিলেন না। ইতিহাসে একথা সর্বজনগ্রাহ্য এবং বারংবার প্রমাণিত হয়েছে যে, আফগানিস্তান আক্রমণ করা সহজ কিন্তু তাকে অধীনস্ত করে রাখা প্রায় অসম্ভব। দ্বিতীয় ব্রিটিশ আফগান যুদ্ধের পরিণতিও ছিল অনুরূপ। তৃতীয় যুদ্ধে যখন আফগানিস্তান তাদের বৈদেশিক নীতির বিষয়ে নিজের আধিপত্য কায়েম করতে সক্ষম হল, বিচক্ষণ ব্রিটিশ উপলব্ধি করে, আফগানিস্তান কখনও তাদের অধীনস্ত হবে না।
বর্তমান পাকিস্তানের আশঙ্কা হল, এ হেন আফগানিস্তানের কাবুলে শক্তিশালী সরকার আসীন হলে, ক্রমে ডুরান্ড লাইন অগ্রাহ্য করে তারা খাইবার পাশতুনখোয়া ও বালোচ প্রদেশের পাশতুনদের সঙ্গে একজোট হয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র ঘোষণা করে আটক পর্যন্ত এলাকা কেড়ে নেবে এবং পাঞ্জাব পর্যন্ত অধিকার বিস্তৃত করবে। বলা বাহুল্য, এই আশঙ্কা অমূলক নয়, তা এখন অনস্বীকার্য। কথিত আছে, আফগানদের জিজ্ঞাসা করলে, তারা বলে, ‘এক তরফ হিন্দুস্তান, দুসরি তরফ আফগানিস্তান, কাঁহাসে আয়া পাকিস্তান?’
এ বিষয়ে প্রাসঙ্গিক, অতীতে পারস্য দেশে, বর্তমান আফগানিস্তান অঞ্চলের পাশতুনদের বলা হত আফগানা পাশতুন। ভারতে আমরা তাদের পাঠান বলে অভিহিত করি, কিন্তু, আদতে এরা সবাই পাশতুন জনজাতির পরিচয়ে একাত্মতায় বিশ্বাস করে। জাতিগতভাবে এরা যোদ্ধা, স্বাধীন চেতা, অতিথিবৎসল ও প্রখর আত্মসম্মানে বিশ্বাসী। প্রতিশোধস্পৃহার ক্ষেত্রেও এরা প্রবাদপ্রতিম, বলা হয় একশ বছর পরেও একজন পাশতুন তার পূর্বপুরুষের প্রতি কোনও অন্যায়ের প্রতিশোধ নিতে পৃথিবীর যে কোনও প্রান্ত থেকে অন্যায়কারীর পরবর্তী প্রজন্মের উত্তরাধিকারীকে খুঁজে নিয়ে প্রতিশোধ স্পৃহা চরিতার্থ করেন।
সভ্যতার আলোকে বর্তমান পৃথিবীতে এই সব প্রবাদ বিলুপ্তপ্রায় হলেও শিক্ষিত পাশতুনদের চরিত্রের গভীরেও এই সব বৈশিষ্ট্য এখনও অমলিন।
এই কারণেই সম্ভবত ব্রিটিশের চোখে পাশতুনদের জাতীয় চরিত্র দুর্বোধ্য ছিল। তারা আশ্রিত শত্রুর ওপরেও প্রতিশোধ নিতে পারে না, বরং তাকে উষ্ণ আতিথ্য দিয়ে অবশেষে তারা আশ্রয় ত্যাগ করলে তবে তার ওপর প্রতিশোধ নেয়। সুশৃঙ্খল, আইনানুগ ব্রিটিশ তাদের বুঝবে কীকরে? এই জনজাতির বৈশিষ্ট্যের মূলে রয়েছে তাদের ভৌগোলিকভাবে প্রতিকূল এলাকার জীবনযাত্রা, আর বারংবার তাদের জনজীবনের ওপর দিয়ে ভারতবর্ষে বহিঃশত্রুর আক্রমণের ইতিহাস। পাঞ্জাব পর্যন্ত বিভিন্ন আক্রমণের পথ ছিল আফগানিস্তানের ওপর দিয়ে। এই আক্রমণকারীদের ইতিহাসে ফেরার পথও আফগানিস্তানের মধ্যে দিয়েই নির্ধারিত ছিল। এর প্রভাবে এই অঞ্চলের পাশতুনদের জীবন যুগে যুগে বিপর্যস্ত ও বিক্ষিপ্ত হয়েছে। পাকিস্তান পাশতুন এবং পাঞ্জাবীদের মধ্যে দীর্ঘকালীন বৈরিতা সর্বজনগ্রাহ্য। সেই দেশের প্রায় ৫২ শতাংশ জনসংখ্যা পাঞ্জাবী হওয়ায় তাদের আধিপত্য বিস্তারের প্রবণতা স্বাধীনচেতা পাশতুনরা সহ্য করতে পারে না, যদিও বর্তমান পাকিস্তানের সেনাবাহিনীতে বহু পাশতুন উচ্চপদস্থ আধিকারিক আছেন। করাচি একটি উল্লেখযোগ্য উন্নত পাশতুন শহর হিসেবে ইসলামাবাদের তুলনায় কিছু কম গুরুত্বপূর্ণ নয় এবং শিক্ষা ও সভ্যতার আলোয় এই শত্রুতা অনেক স্থিমিত হয়েছে।
বর্তমানে পাকিস্তানের বালুচিস্তানে দীর্ঘকালীন বিদ্রোহের ইতিহাস আছে। বালুচিস্তানের বৈশিষ্ট্য হল পাকিস্তানের ৪৪ শতাংশ জমি এই প্রদেশের অন্তর্গত হলেও এদের জনসংখ্যা মোট জনসংখ্যার ৫ শতাংশ। নির্বাচনের ক্ষেত্রে তাদের জনসংখ্যা স্বভাবতই গুরুত্বহীন। লক্ষ্যণীয় এই যে, পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালিদের জনসংখ্যা ছিল নির্বাচনের নিরিখে তাৎপর্যপূর্ণ। উপজাতি অধ্যুষিত বালুচিস্তানের শিক্ষাব্যবস্থায় পিছিয়ে থাকাও তাদের উপস্থিতির গুরুত্বকে প্রভাবিত করেছিল দীর্ঘকাল। যদিও বর্তমানে শিক্ষিত বালোচরা পাকিস্তানের জাতীয় ব্যবস্থায় নিজেদের উপস্থিতি কায়েম করতে পেরেছেন, তবুও বর্তমানে বালুচিস্তান পঞ্চমবার বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে।
পাকিস্তানে পাঞ্জাবী আধিপত্যে সিন্ধিরাও খুশি নয়। তবে পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ ভীতির কারণ হবে যদি পাশতুনরা একজোট হন। পাশতুনদের পাকিস্তানের রাজনীতিতে আওয়ামী জাতীয় দল ইত্যাদি দলের মাধ্যমে একাধিক উপস্থিতি আছে।
ব্রিটিশের কূটনীতি পাশতুনদের বিভক্ত করার ক্ষেত্রেও সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলেছিল। উত্তর বালুচিস্তান পাশতুন এলাকা। ব্রিটিশ সরকার, কাবুলের আমীরের সঙ্গে চুক্তিসূত্রে এই অঞ্চলের শাসনভার পেলেও তাকে মূল পাশতুন এলাকার সঙ্গে প্রশাসনিকভাবে যুক্ত না করে, উপজাতি এলাকার সঙ্গে যুক্ত করে তাকে ব্রিটিশ বালুচিস্তান নামে অভিহিত করেছিল। এই উপজাতি এলাকার বালোচদের সঙ্গে বালুচিস্তানের উত্তরে পাশতুনদের সহবাস, কোয়েটা ও তার উত্তর পর্যন্ত বিস্তৃত। এর ফলে পাশতুনরা একতাবদ্ধ হতে পারেনি এবং সংখ্যার নিরিখে গুরুত্বপূর্ণ হলেও পাকিস্তানের রাজনীতিতে নির্বাচনের চিত্রকে আলাদা রাষ্ট্রের দাবিতে প্রভাবিত করতে পারেনি, যদিও তাদের জাতীয় চরিত্র অনুসারে তারা এক ‘ওয়াতনে’ বিশ্বাস করে তা আফগানিস্তানে হোক বা পাকিস্তানে! আহম্মদ শাহের উত্তরাধিকারের সূত্রে, সেই ‘ওয়াতন’ তার অন্তরে অধিষ্ঠিত।
(ক্রমশ)
Advertisement



