• facebook
  • twitter
Friday, 5 December, 2025

তালিবান ও আরএসএস একই আদর্শিক পথের সহযাত্রী

তালেবান বা আরএসএস—দুই পক্ষই নারীকে নিয়ন্ত্রণের প্রতীকে পরিণত করেছে। তাদের মধ্যে পার্থক্য যতটা বাহ্যিক, অন্তরে তারা ততটাই অভিন্ন।

প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র

প্রবীর মজুমদার

২০২১ সালে ভারত যখন আফগানিস্তান থেকে তাদের কূটনীতিকদের সরিয়ে নিল, তখন খুব কম বিশেষজ্ঞই ভেবেছিলেন যে তালেবান কাবুলের ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় দুই দেশের সম্পর্ক কখনো আবার চালু হবে। নব্বই দশক থেকেই আফগান তালেবানের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক আদৌ ভালো ছিল না বরং বেশ বৈরিতাই ছিল। এর মূল কারণ ছিল তালেবানের সঙ্গে পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠতা। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সালের প্রথম তালেবান শাসনামলে ভারত আফগানিস্তানের মোহাম্মদ নাজিবুল্লাহ ও আহমদ শাহ মাসুদের নেতৃত্বাধীন ‘নর্দান অ্যালায়েন্সকে’ সমর্থন দিয়েছিল তালেবান উৎখাতে।

Advertisement

পরে ২০০১–২১ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তানে ন্যাটো বাহিনীর উপস্থিতি ছিল। সেই সময় ভারত তাদের তালেবানবিরোধী নীতিকে আরও শক্ত করে তোলে। ফলে কাবুল ও নয়াদিল্লির দূরত্ব আরও বাড়ে। এই সময়জুড়ে ভারত তালেবানকে ‘সন্ত্রাসী’ বলে চিহ্নিত করত। তাদের কোনো রাজনৈতিক স্বীকৃতি দিত না। এমনকি যখন আমেরিকা দোহায় তালেবানের সঙ্গে আলোচনায় বসেছিল, তখনও ভারত যে কোনো ধরনের শান্তি আলোচনার ধারণারই বিরোধিতা করেছিল।

Advertisement

সম্প্রতি ভারতের সঙ্গে আফগানিস্তানের তালেবান সরকারের সম্পর্ক উন্নয়নে যে চুক্তি হয়ে গেল, সেটিকে অনেকে ‘শত্রুর শত্রুই বন্ধু’ গোছের মতো ভাবছেন । অর্থাৎ পাকিস্তান এখন আফগানিস্তানের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়েছে। তাই ভারত পাকিস্তানের প্রতিপক্ষ তালেবানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হচ্ছে। এই প্রসঙ্গে মনে রাখা দরকার, ভারত এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দেয়নি। এই বিষয়টিকে সরিয়ে রেখে সম্প্রতি দিল্লিতে আফগান পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে সংযত, কিন্তু উষ্ণ অভ্যর্থনা জানানো হয়। সাধারণত যখন কোনো দেশ অনানুষ্ঠানিক সম্পর্ক গড়ে, তখন প্রকাশ্যে অনেক ‘কূটনৈতিক ভাষা’ বা সৌজন্যমূলক ভান ব্যবহার করে, যাতে অন্য দেশগুলোর প্রতিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণে থাকে। কিন্তু ভারত ও আফগান – দুই পক্ষের প্রকাশ্য বক্তব্যে সূক্ষ্ম কোনো কূটনৈতিকতার ভানও দেখা যায়নি। এটি ইসলামাবাদকে ক্ষুব্ধ করেছে এবং এ ঘটনার পরপরই আফগান সীমান্তে পাকিস্তানি সামরিক অভিযান শুরু হয়। এটিকে অনেকেই দিল্লির ঘটনাবলির প্রতিক্রিয়া হিসেবেই দেখেছেন।

কিন্তু ভারত এবং আফগানিস্তানের মধ্যে এই চুক্তি কেবল কূটনৈতিক দিক থেকে নয়, সময়ের দিক থেকেও তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, চুক্তিটি এমন একসময় হলো, যখন ভারতের দক্ষিণপন্থী হিন্দুত্ববাদী সংগঠন আরএসএসের শতবর্ষ উদ্‌যাপন করা হচ্ছে। কম্যুনিস্টরা একসময় এ ধরনের মানসিক সখ্যকে ‘তমসাচ্ছন্ন ঐক্য’ বলতেন। এ ধারণা এখন তালেবান ও আরএসএসের মতো দুই ধর্মীয় মৌলবাদী গোষ্ঠীর ক্ষেত্রে অদ্ভুতভাবে প্রযোজ্য। পিছন ফিরে দেখলে মনে হবে, তালেবান–আরএসএস সখ্য আসলে তেমন আশ্চর্যের কিছু নয়। ইতিহাসে দেখা যায়, ভারত ও পাকিস্তানের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল তখন, যখন পাকিস্তান ছিল সামরিক শাসক জিয়াউল হকের হাতে। জিয়াউল হক ওই সময় তাঁর দেশকে বিতর্কিত ইসলামি আইন ও অধ্যাদেশের মাধ্যমে এক অন্ধকার যুগে ঠেলে দিয়েছিলেন। আর জিয়াউল হকের সেই গণতন্ত্র হত্যাকে যিনি নৈতিক বৈধতা দিয়েছিলেন, তিনি হলেন ভারতের সে সময়কার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও আরএসএসের আজীবন সদস্য অটল বিহারি বাজপেয়ী।

ইন্দিরা গান্ধী জরুরি অবস্থা জারি করে গণতন্ত্র স্থগিত করার পর তাঁকে সরিয়ে ক্ষমতায় আসে প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাইর সরকার। ১৯৭৮ সালে মোরারজি দেশাই সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে বাজপেয়ী যখন পাকিস্তান সফরে যান, তখন তিনি প্রকাশ্যে জিয়াউল সরকার ও জনতা পার্টির বন্ধুত্বের প্রশংসা করেছিলেন। ওই জনতা পার্টিরই একটি বড় অংশ ছিল আরএসএস। মজার ব্যাপার হলো, বিশ্বের বিভিন্ন নেতা যেখানে জিয়াউলের কাছে আবেদন করছিলেন যেন জুলফিকার আলী ভুট্টোর মৃত্যুদণ্ড রদ্ করা হয়, সেখানে বাজপেয়ী সেই প্রসঙ্গ সম্পূর্ণ এড়িয়ে গিয়েছিলেন। ওই সময় ক্ষমতাচ্যুত ও নির্বাচনে পরাজিত কংগ্রেস নেত্রী ইন্দিরা গান্ধীও ভুট্টোর প্রাণভিক্ষা চেয়ে আবেদন করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত জিয়াউল হক মোরারজি দেশাইকে পাকিস্তানের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার দিয়েছিলেন। এটি ছিল ভারত–পাকিস্তান সম্পর্কের ইতিহাসে এক ব্যতিক্রমী মুহূর্ত। পরবর্তী কোনো ভারতীয় সরকার সেই রকম সৌহার্দ্য দেখাতে পারেনি।

এই প্রসঙ্গে আরেকটি ঘটনার উল্লেখ করা যায়। সেটি ছিল মোদির উজবেকিস্তান সফর। সেখানে তিনি উজবেক নেতাদের সঙ্গে হাসিমুখে মেলামেশা করেছেন। এটিকে একধরনের ঐতিহাসিক বিদ্রূপ হিসেবে ধরা হয়। কারণ, মোদি যে উজবেকিস্তানে গিয়েছিলেন হাসিমুখে, সেই উজবেকিস্তানে তৈমুর লং ও জহিরউদ্দিন বাবর জাতীয় বীর হিসেবে পূজিত হন। অথচ ভারতে এই দুই ঐতিহাসিক চরিত্রকে হিন্দুত্ববাদীরা ‘আক্রমণকারী’ ও ‘অসভ্য মুসলমান’ হিসেবে গালি দেন। এ ঘৃণায় আরএসএস এবং পশতু তালেবান উভয়েই যেন একমত। কারণ, দুই পক্ষই বাবর ও মোগলদের প্রতি শত্রুতাপূর্ণ মনোভাব পোষণ করে।

তালেবান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকির দিল্লি সফরে তাঁর সংবাদ সম্মেলনে নারী সাংবাদিকদের আমন্ত্রণ না জানানোর বিষয়টি নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। মুত্তাকির সাংবাদিক সম্মেলনে মহিলা সাংবাদিকদের প্রবেশাধিকার না দেওয়া নিয়ে প্রবল বিতর্ক শুরু হয়েছে দেশজুড়ে। এত বড় বৈষম্যমূলক ঘটনা ভারত সরকারের নাকের ডগায় ঘটে গেল অথচ নয়াদিল্লি প্রতিবাদ করল না, এহেন অভিযোগ তুলে কেন্দ্রকে কাঠগড়ায় তুলেছেন বিরোধীরা। তাঁদের প্রশ্ন, কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদি সরকারও কি তালিবানি মানসিকতাকে সমর্থন করে?

কাবুল একসময় ছিল দক্ষিণ এশিয়ার ‘ফ্যাশন রাজধানী’। সেখানে নারীরা ছিলেন আত্মবিশ্বাসী, আধুনিক ও সংস্কৃতিমনা। পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যবিত্ত নারীরা যখন পোশাকের বিধিনিষেধে জর্জরিত, তখন কাবুলের মেয়েরা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতেন প্যারিসীয় ডিজাইনারদের তৈরি স্কার্ট পরে। প্রায় দুই দশকের যুদ্ধ শেষে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনপুষ্ট সরকারকে হটিয়ে ২০২১ সালের ১৫ আগস্ট তালেবান কাবুল দখল করে নেয়। সে সময় তালেবান নেতারা আগের কট্টরপন্থা থেকে সরে এসে উদারনীতি গ্রহণের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। কিন্তু মুখের কথা ও বাস্তবতার মধ্যে বিস্তর ফারাক। প্রায় প্রতিটি দিনই দেশটির নারী ও মেয়েদের জন্য খারাপ খবর দিয়ে যাচ্ছেন ক্ষমতাসীনেরা। নারীর স্বাধীনতা যেন খাঁচায় বন্দী।

আজকের দিনে তালেবান নারীদের সঙ্গে যে ধরনের আচরণ করে, ভারতেও ধর্মীয় শুদ্ধতাবাদীরা নারীদের প্রতি প্রায় একই রকম মনোভাব পোষণ করে। তালেবান মতাদর্শে অনুপ্রাণিত ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসা এবং হিন্দুত্ববাদীরা উভয়ই ভ্যালেন্টাইনস ডে, মেয়েদের জিনস পরা, মুঠোফোন ব্যবহার বা ছেলেদের সঙ্গে মেলামেশা—এসব বিষয়ের বিরুদ্ধে একই সঙ্গে প্রচারণা চালায়।

আরএসএসের প্রভাবশালী নেতা মাধব সদাশিব গোলওয়ালকর বিশ্বাস করতেন, আধুনিকতা নারীদের বিপথে নিচ্ছে। ‘দ্য কারাভান’ পত্রিকা ২০১৭ সালে মোদি সরকারের তিন বছর পূর্তি উপলক্ষে আরএসএস নিয়ে একটি বিশদ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে গোলওয়ালকরের উদ্ধৃতি দেওয়া হয়, ‘একজন সচ্চরিত্র নারী তার দেহ আড়াল করে রাখে।’ তিনি আরও আফসোস করেছিলেন যে আধুনিক নারীরা মনে করেন, ‘আধুনিকতা মানে শরীর যত বেশি প্রকাশ করা যায়, তত ভালো।’ এরপর তিনি বলেছিলেন, ‘কী অবনতি!’আরএসএস আসলে এমন এক হিন্দুত্বের উৎস , যা ধর্মান্ধ ও পশ্চাদমুখী।

তালেবান বা আরএসএস—দুই পক্ষই নারীকে নিয়ন্ত্রণের প্রতীকে পরিণত করেছে। তাদের মধ্যে পার্থক্য যতটা বাহ্যিক, অন্তরে তারা ততটাই অভিন্ন। তাই আজ যখন ভারত তালেবান শাসিত আফগানিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় করছে, তখন সেটিকে শুধু ‘কূটনৈতিক কৌশল’ হিসেবে দেখা ভুল হবে; বরং এটি এক ‘অদ্ভুত আত্মীয়তা’। এখানে দুই ভিন্ন ধর্মীয় মতাদর্শ একই রকম রক্ষণশীলতার মাটিতে দাঁড়িয়ে একে অপরকে খুঁজে পেয়েছে। আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবতের বক্তব্যে নারীকে ‘গৃহিনী’ ও পুরুষের অনুগত সঙ্গী হিসাবে দেখা হয়। আর তালেবানও নারীদের ঘরবন্দী করে শিক্ষা এবং কর্মক্ষেত্র থেকে সরিয়ে দিয়েছে। দু’ক্ষেত্রেই নারীদের স্বাধীনতা লঙ্ঘিত, এমনকি পুরুষের ছায়া হিসাবে বিবেচনা করা হয়েছে তাদের। পার্থক্য শুধু মাত্রার- ভারতে এই চিন্তাধারা মতাদর্শের স্তরে সীমিত, কিন্ত আফগানিস্তানে তা রাষ্ট্রের নীতিতে রূপ পেয়েছে। দুটোই মূলত নারী-স্বাধীনতার পরিপন্থী, পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন।

ভারত তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি না দিলেও কূটনৈতিক যোগাযোগ, বাণিজ্য ও উন্নয়নমূলক প্রকল্পের মাধ্যমে যে সম্পর্ক ধীরে ধীরে ভাল হচ্ছে তা ভারতের জন্য একধরনের পরীক্ষা। ভারত কি মানবাধিকার ও নীতির অবস্থান বজায় রেখেও বাস্তব রাজনীতির পথে অগ্রসর হতে পারবে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর ভবিষ্যতেই মিলবে। তবে আপাতত নিশ্চিতভাবে বলা যায়- ভারত আফগানিস্তানের দরজায় আবার কূটনৈতিকভাবে ফিরে এসেছে। স্বীকৃতি না থাকলেও, বন্ধুত্বের নতুন অধ্যায় কি তবে শুরু হয়ে গিয়েছে?

Advertisement