স্বপনকুমার মণ্ডল
স্রষ্টার সঙ্গে সৃষ্টির অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক । যাপিত জীবন থেকেই সেই সৃষ্টির রসদ নানাভাবে উঠে আসে। সেই সূত্রে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘অবনী বাড়ি আছো’র ‘অবনী’র পরিচয়ে বাঁকুড়ার অবনী নাগের নাম জুড়ে যায় এবং তাঁর জীবিতকালেই ভিন্ন মাত্রা লাভ করে। তার সত্য মিথ্যার চেয়েও অবনী নাগের সংযমী নীরবতার সরব প্রকৃতি আপনাতেই ভাবিয়ে তোলে। রীতিমতো সাহিত্যচর্চার সক্রিয় হয়েও তিনি প্রচারমুখর হাতছানিকে উপেক্ষা করেছেন আজীবন। আবার স্বয়ং শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের নিবিড় সান্নিধ্যে তাঁর ‘অবনী’ হওয়ার অবকাশেও তাঁর বিরল সংযম লক্ষ করা যায় । সব ক্ষেত্রেই অবনী নাগের নীরব সাধনা সমীহ আদায় করে নেয়।
Advertisement
আসলে লেখার জন্য সাধনার প্রয়োজন, না-লেখার জন্যও। বিশেষ করে যেখানে লেখার পরিসর আপনাতেই হাতছানি দিয়ে চলে, সেখানে প্রকাশের তাড়নায় লেখনীর সচলতা স্বাভাবিক হয়ে ওঠে । সেই হাতছানি পেয়েও আত্মসচেতনতায় আমৃত্যু অন্তরালে ছিলেন বাঁকুড়া শহরের কবি অবনী নাগ । তাঁর সেই প্রচারবিমুখ বিরল প্রকৃতি অনায়াসেই দৃষ্টান্ত তৈরি করে । কবি সমর সেন যেখানে ত্রিশ বছর বয়স পর্যন্ত কাব্যচর্চা করে বাকি চল্লিশ বছর কবিতাবিমুখ ছিলেন, সেখানে অবনী নাগ যৌবনের পরশে একমাত্র কাব্য ‘মনে মনে’র পরে কাব্যপ্রকাশে মৌনমুখর হয়েছিলেন। অথচ কাব্যচর্চার বনেদি পরিসর পেয়েছিলেন তিনি। সেই সময়ে ছাত্রজীবনেই যিনি কবিখ্যাতি লাভ করেছিলেন সেই আনন্দ বাগচী (১৯৩২-২০১২) কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এম এ পাশ (১৯৫৮) করার পর ১৯৬২-তে বাঁকুড়ার ক্রীশ্চান কলেজে অধ্যাপনায় যোগ দিয়েছিলেন। অবনী নাগ তাঁর চেয়ে বছরচারেকের ছোট হলেও যৌবনের ধর্মে ও আন্তরিকতার পরশে দুজনে বন্ধু হয়ে উঠেছিলেন । বাংলার কাব্যজগতে তখন আনন্দ বাগচী রীতিমতো কবি-পরিচিতি লাভ করেছেন।
Advertisement
কৃত্তিবাসী প্রকাশনী থেকে তাঁর ‘স্বগত সন্ধ্যা’(১৩৬০) কাব্যটি প্রকাশের পর কবিপ্রতিষ্ঠা ছড়িয়ে পড়ে। এরপর তাঁর দ্বিতীয় কাব্য ‘তেপান্তর’ (১৩৬৬) বেরিয়ে গেছে। সেদিক থেকে প্রতিভাধর তরুণ অধ্যাপক-কবির নিবিড় সান্নিধ্যে অবনী নাগের সাহিত্যচর্চার পরিসর সক্রিয় হয়ে ওঠার সম্ভাবনা ছিল তীব্র। দু’জনে মিলে ‘পারাবত’(১৩৭৩-১৩৭৬) নামে একটি সাহিত্য পত্রিকাও সম্পাদনা করেছিলেন। আনন্দ বাগচীর উষ্ণ সান্নিধ্যে তাঁর সেই কাব্যটিও আত্মপ্রকাশ করে। অন্যদিকে সাহিত্যের পরিসরে নিজেকে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে রাখলেও অবনী নাগ কাব্যপ্রকাশের মাধ্যমে তাঁর কবি প্রতিভাকে প্রকাশে আর সক্রিয় হয়ে ওঠেননি। অথচ তার অবকাশ ছিল, ছিল বিস্তর পরিসর। শুধু কাব্যজগতেই নয়, সাহিত্যের অন্যশাখাতেও তিনি নিজেকে মেলেধরায় তৎপর হননি। প্রসঙ্গত, উল্লেখ্য, সত্তরের দশকে আনন্দ বাগচী ও বিবেকজ্যোতি মৈত্রের সঙ্গে অবনী নাগও বাঁকুড়া থেকে একটি রঙ্গব্যঙ্গের ভিন্নধর্মী মাসিক পত্রিকা ‘বৃশ্চিক’(১৯৭৩-৭৪) প্রকাশে সামিল হয়েছিলেন। সেদিক থেকে সাহিত্যের সেবায় তাঁর ভূমিকা যেভাবে আন্তরিক হয়ে উঠেছে, সেভাবে তার সৃষ্টিতে তাঁর প্রকাশবিমুখ প্রকৃতি আপনাতেই বিস্ময় বয়ে আনে। তিনি সঙ্গীও পেয়েছিলেন, সঙ্গতও ছিল তাঁর। অথচ তিনি তিনি সংগীতে সরব না-হয়ে নীরবতা পালন করেছেন। শুধু তাই নয়, অন্যের সংগীতের রসদ জোগানোতেই তাঁর অনন্যতা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। সেক্ষেত্রে কবিতায় লেখনীকে সক্রিয় করে তুলতে না পারলেও অন্যের কবিমানসে তাঁর সমুজ্জবল প্রকৃতি আপনাতেই সবুজ সজীবতা লাভ করেছে। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সান্নিধ্যের পরিসরে তাঁর ‘ধর্মেও আছো জিরাফেও আছো’ (১৯৬৫) কাব্যের ‘অবনী বাড়ি আছো’ জনপ্রিয় কবিতায় তাঁর সংযোগ নিবিড়তা লাভ করে। তাঁর বাড়িতে এসে তাঁকে ঐ ভাবেই শক্তি চট্টোপাধ্যায় ডেকে উঠতেন।
অন্যদিকে, শুধু শক্তি চট্টোপাধ্যায়ই নন, অনেক কবি-সাহিত্যিকের সঙ্গেই অবনী নাগের আন্তরিক পরশ ছিল। সমরেন্দ্র সেনগুপ্তের কবিতাতে তো তাঁর প্রকট উপস্থিতি। প্রথম আলাপের সূত্রেই কবির লেখনীতে উঠে এসেছিল ‘অবনী নাগের সঙ্গে’ কবিতাটি। এছাড়া সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, তারাপদ রায়, পবিত্র মুখোপাধ্যায় প্রমুখ কবি অবনী নাগের বাড়িতে এসে রীতিমতো আড্ডা জমিয়েছেন। কথাসাহিত্যিক বিমল কর তো তাঁকে আদর করে ‘ইলেকট্রিক কবি’ বলে ডাকতেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, অবনী নাগ প্রথম জীবনে ইলেকট্রিক্যাল কাজ করতেন। অন্যদিকে সমরেশ বসুর ‘দেখি নাই ফিরে’ উপন্যাসে ভাস্কর রামকিঙ্কর বেঈজের বাল্যকৈশোরের তথ্য সরবরাহকারী হিসাবেও অবনী নাগের ক্লান্তিহীন ভূমিকা বিশেষভাবে স্মরণীয়। এজন্য সমরেশ বসু দিনরাত তাঁর বাড়িতে ঠাঁই নিয়েছিলেন৷ সেদিক থেকে অবনী নাগের সাহিত্যসেবী প্রকৃতিতে স্রষ্টার চেয়ে সেবকের ভূমিকাই বড় হয়ে উঠেছে। কোথাও তাঁর আত্মপ্রকাশের ঘটা নেই। বরং তাঁর আত্মসংযমী প্রকৃতিই তাঁর সাহিত্যিক প্রতিভার বিরলতাকে চিনিয়ে দিয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বৈষ্ণবপদাবলির চণ্ডীদাসের কবিত্ব সম্পর্কে বলেছেন, লেখার জন্য তো বটেই, না-লেখার জন্যও তিনি বড় কবি। এই ‘না-লেখা’র দিক থেকে অবনী নাগ যেভাবে তাঁর স্বকীয় প্রতিভা ও অধিকার সম্পর্কে আত্মসচেতনতার পরিচয় দিয়েছেন, তাতেই তাঁকে চিনে নেওয়া যায়। ভিড়ে ভেড়া যত সহজ, স্বতন্ত্র হয়ে ওঠা ততই কটিন। অসংখ্য প্রতিভাধর কবি-সাহিত্যিকদের পরশে তাঁর উন্নত সাহিত্যবোধই তাঁকে প্রকাশেই বিমুখ করেনি, প্রচারেও বিচ্ছিন্ন করেছিল। সেদিক থেকে বাংলা সাহিত্যের নক্ষত্রদের আলোর পরশকে পাথেয় করে অবনী নাগ পথ চলতে চাননি, বরং সেই আলোতে নিজেকে আড়াল করার দুর্লভ শক্তি অর্জন করেছিলেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ষোলো বছর (১৯৬২-১৯৭৮) অধ্যাপনা করে আনন্দ বাগচী ‘দেশ’ পত্রিকার সম্পাদনা বিভাগে যোগ দেওয়ার জন্য বাঁকুড়া ছেড়ে কলকাতায় গিয়েছিলেন। চাকরিসূত্রে বাঁকুড়াতে এসে সৃজনবিশ্বে নিঃসঙ্গতাবোধ তাঁকে কুরে কুরে খেত। সেদিক থেকে অনাসৃষ্টির বেদনা তাঁকে পেয়ে বসেছিল। সেই আনন্দ বাগচীকে আজীবন সঙ্গ দিয়ে গিয়েছেন অবনী নাগ। জীবনের শেষ বছরছয়েক তিনি হালিশহরে রোগে ভুগেছিলেন। ক্রমশ তাঁর আর্থিক ও শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটে। তাঁর সেই পঙ্গুপ্রায় অবস্থায় অবনী নাগের উদ্যোগে গড়ে ওঠে ‘আনন্দ বাগচী সাহায্যার্থ কমিটি’। আবার তাঁর নেতৃত্বে যখন ‘পারাবত’ পত্রিকায় ‘কবি আনন্দ বাগচী শ্রদ্ধার্ঘ্য সংখ্যা ১৪১৯’ প্রকাশিত হয়েছে, সেখানেও ‘আমি’র পরিবর্তে ‘আমরা’ গৌরব সবাকমূর্তি লাভ করেছে। সম্পাদকীয়তে লেখা হয়েছে : ‘আজ কবি আনন্দ বাগচীর শুভজন্মদিনে আমরা পারাবতের এই শ্রদ্ধার্ঘ্য সংখ্যাটি তাঁকে নিবেদন করতে পেরে ধন্য হলাম। আসুন আমরা সমবেত ভাবে তাঁর শীঘ্র সুস্থজীবন কামনা করি।’ অন্যদিকে অনুজ বন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর সংখ্যাটিতে অবনীনাগের কোনো লেখা প্রকাশিত হয়নি।
যেখানে প্রকাশের আভিজাত্য পেয়ে বসে, সেখানেও অবনী নাগ শুধু মিতবাকই হননি, প্রয়োজনে নীরবতাও পালন করেছেন। অথচ তাঁর প্রকাশের সদিচ্ছা ছিল শিশুর মতো তীব্র। সুদীর্ঘ পঞ্চাশ বছর ধরে তিনি ছদ্মনামের আড়ালে থাকা লেখকদের পরিচয় দেওয়ার মানসে একটি বই লিখেছেন। সেই ‘বাংলা সাহিত্যে ছদ্মনামের চলন্তিকা’ (বইমেলা ২০০৫) বইটিতে ‘যে কথা না বললেই নয়’ শীর্ষক ভূমিকায় তিনি জানিয়েছেন: ‘বাল্যকালের সুন্দর রঙীন প্রজাপতি ধরার নেশার মত, ছাত্রজীবনে প্রাচীন মুদ্রা সংগ্রহের বাতিকের মত, বাংলা সাহিত্যে ছদ্মনামী লেখকদের মুখোসের মুখ দেখার অদম্য কৌতূহলে তাঁদের নাম ধরে রাখার ফলশ্রুতি এই সঙ্কলন।’ অথচ সংকলক হিসাবে ‘ঘোমটা ঢাকা মুখ দেখার আগ্রহ কার না থাকে’র কথা বলেও তিনি আজীবন অবগুন্ঠনের আড়ালে থেকে গেছেন। শুধু তাই নয়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘অবনী’ হিসাবেও নিজেকে জাহির করাও ছিল তাঁর স্বভাববিরুদ্ধ। জিজ্ঞেস করলেই বলতে না পারার উদাসীনতার হাসি তাঁর মুখে ভেসে উঠত।
অথচ অনায়াসেই তাতে নিজেকে মিলিয়ে দিতে পারতেন তিনি। অন্যদিকে বয়সের ভারে আর ধারে কখনও তিনি অভিভাবকের আসনে সমাসীন হয়ে সাহিত্যের আসরে আলো শুষে নেওয়ায় সক্রিয় হতেন না।
অনাড়ম্বর সাতাশি বছরের (মৃত্যু ২৮ নভেম্বর ২০১৫) জীবনে ছিল না অপ্রাপ্তির হা-হুতাশ। যেচে কাউকে তাঁর বনেদি সান্নিধ্যের কথা বলে দৃষ্টি আকর্ষণের ছিল তীব্র অনীহা। সেদিক থেকে আত্মপ্রচারসর্বস্ব পরিসরে অবনী নাগের সংযমী প্রকৃতি সবুজের হাতছানি দিয়ে চলে এবং সেখানেই তাঁর বনেদি স্বতন্ত্রতা, ভাবা যায়!
Advertisement



