বরুণ দাস
আমরা অনেক কিছুই চাই কিন্তু সে চাওয়ার মধ্যে কতোখানি আর্তি ও আন্তরিকতা আছে তা নিয়েই সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ আছে। আমরা কলুষতা মুক্ত সমাজ চাই, আমরা নিরেপেক্ষ প্রশাসন চাই, আমরা ঘুষ-মুক্ত সরকারি কর্মী চাই, আমরা ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি চাই, আমরা দূষণমুক্ত পৃথিবী চাই, কুসংস্কসার ও অন্ধবিশ্বাস রুখতে বিজ্ঞান মনস্কতার প্রসার সহ আরও অনেক কিছুই চাই।
কিন্তু আমাদের ‘চাওয়ার মধ্যে যে অনেকটা ফাঁকফোকর আছে তা নিয়ে কী একবারও ভেবে দেখেছি? বোধহয় দেখিনি। যদি দেখতাম তাহলে আমাদের চাওয়ার সবটুকু না হোক-অন্ততঃ কিছুটার বাস্তবায়ন ঘটাতে পারতাম। চাওয়া আর পাওয়ার মধ্যে হয়তো বড়ো মাপের কোনও ফারাক থাকত না। আসলে গোড়াতেই অর্থাৎ বিসমিল্লায় গলদ! কিরকম? এবার আসছি সেকথায়।
বলতে দ্বিধা নেই, যাবতীয় কুসংস্কার আর অন্ধ বিশ্বাসের উৎসই হল আমাদের নিজেদের ঘর। ঘরের প্রিয়জনেরা। ছোটোবেলা থেকেই বড়োদের মুখে আমরা ভূতের গালগল্প শুনে এসেছি। বড়োদের প্রয়োজনে ছোটোদের ভয় দেখানোর জন্য, তাঁদের শান্ত করানোর জন্য নানারকম আজগুবি সব বিষয় ছোটোদের সামনে তুলে ধরেছি, অস্তিত্বহীন জিনিসের অস্তিত্বকে বড়ো করে দেখিয়েছি।
যদি প্রশ্ন করি, কে শিখিয়েছে পরীক্ষার দিন ডিম কিংবা কলা খাওয়া যাবে না? খেলে পরীক্ষার ক্ষতি হতে পারে। শিখিয়েছেন বাড়ির বড়োরাই। কে শিখিয়েছে বাইরে বেরনোর সময় হাঁচি দিলে দাঁড়িয়ে পড়তে হবে? তা নাহলে বিপদের ঝুঁকি আছে? শিখিয়েছেন বাড়ির বড়োরাই। কে শিখিয়েছে ভুল করেও রাতে সাপের নাম করা যাবে না? লতা বলতে হবে। শিখিয়েছেন বাড়ির বড়োরাই।
হাতে-কলমে এই শেখানোর তালিকায় আরও অনেক কিছু আছে। যেমন, বাড়ির কোনও শুভ কাজের সময় বন্ধ্যা নারীর মুখ দেখা চলবে না। তাতে কী হবে? শুভকাজে নাকি বিঘ্ন ঘটতে পারে। কিংবা কোনও বিধবা নারী- তিনি বাড়ির তথা পরিবারের অতি নিকটজন হলেও, বিবাহের কিছু কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজে অংশ নিতে পারবেন না। কে শিখিয়েছেন? শিখিয়েছেন বাড়ির বড়োরাই।
সন্তান দুরন্ত কিংবা চঞ্চল। তাঁকে শান্ত করার জন্য জ্যোতিষের কাছে নিয়ে যান কে? ছেলেমেয়ের ‘সময় মত’ বিয়ে কিংবা চাকরি হচ্ছে না। প্রতিকারের জন্য জ্যোতিষের কাছে ছুটে যান কে? সন্তানের পরীক্ষায় ‘আশানুরূপ’ রেজাল্ট হচ্ছে না। তাঁর ‘বিহিত করা’র জন্য জ্যোতিষের কাছে ছুটে যান কে? কে জ্যোতিষীর পরামর্শ মতো দামি পাথরের আংটি বানিয়ে প্রিয়সন্তানের হাতে পরিয়ে দেন?
বাড়ির বড়োদের ‘শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে’ পরবর্তীকালে ওই বড়োরাও নিজেদের প্রমোশন কিংবা অপছন্দের বদলি রুখে দেওয়ার জন্য সেই জ্যোতিষীর কাছে ছোটেন এবং প্রচুর অর্থব্যয়ে দামি পাথরের আংটি পরেন। ক্লায়েন্ট স্বচ্ছল ও দুর্বল চিত্তের হলে কোনও কোনও জ্যোতিষী আবার প্রচুর অর্থ ব্যয় করে হোমযজ্ঞের পরামর্শ দেন। আর এভাবেই সংশ্লিষ্ট সংসার বঞ্চিত হয় আর্থিক স্বচ্ছলতা থেকে।
কোথাও-বা স্বামী স্ত্রীকে, স্ত্রী স্বামীকে বশীকরণের জন্য জ্যোতিষীর কাছে যান। কেউ-বা পরিবারের অবাধ্য কাউকে বশীকরণের জন্যেও জ্যোতিষীর আশ্রয় নেন। আর এভাবেই পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে, পরিচিতজনদের মধ্যে, বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে এই কুসংস্কার বা অন্ধ বিশ্বাসের পরিসর ক্রমশঃ বেড়ে ওঠে। একে প্রতিহত করবেন কে? বাইরে থেকে নাকি পরিবারের মধ্য থেকে?
বিয়ের সময় প্রিয়সন্তান যখন পাত্রীপক্ষের বাড়িতে যায়, তখন কী বলে যায় তার মাকে? বাড়ির কিংবা মায়ের জন্য ‘দাসী’ আনতে যাচ্ছে সে। সম্ভাব্য স্ত্রী কিংবা পুত্রবধূ সে তো নতুন সংসারে আর এক প্রিয়জন। যে তার নিজের বাড়িঘর, প্রিয়জন ছেড়ে অপরের সংসারে আসবে। তাকে যদি শুরুতেই ‘দাসী’ হিসেবে দেগে দেওয়া হয় তো তাঁর পরিনাম কখনও শুভ হতে পারে কী?
সন্তানের কানে এই মন্ত্র দিয়েছেন কে? বাড়ির প্রিয়জনেরাই। এমন উদাহরণ আরও আছে। যা আমরা অনেকেই কমবেশি জানি এবং তা উল্লেখ করতে গেলে এই প্রতিবেদনের কলেবর অনেকটাই বেড়ে যাবে। তাই আমাদের জানা প্রসঙ্গগুলির মধ্যে কয়েকটি উল্লেখ করা হল। এরপর আছে আমাদের বন্ধুবান্ধব এবং পরিচিতজনদের কাছ থেকে শেখা কুসংস্কার আর অন্ধ বিশ্বাসের নানাবিধ নমুনা।
যেগুলোও কম ক্ষতিকারক নয়। দু’-একটি উল্লেখ করা যাক। যেকোনও যানবাহনের সামনে দিয়ে বেড়াল ছুটে গেলে দাঁড়িয়ে পড়তে হবে। কেন? ভয়ঙ্কর বিপদ ঘটতে পারে। এমন কি, জীবনহানী পর্যন্ত। কে আর জেনেশুনে জীবনহানীর ঝুঁকি নেয়? অগত্যা চালককে দাঁড়িয়ে পড়তেই হয়। শুভকাজের আগে বৃষ্টির মুখ দেখা ভালো। সকালে কারও কারও মুখ দেখলে নাকি দিন খারাপ যায়।
সুতরাং আমরা যারা নিজেদেরকে অগ্রণী ভাবি, কুসংস্কার এবং অন্ধ বিশ্বাসের বিরুদ্ধে সরব তথা প্রতিবাদী ভূমিকা নেব, বিজ্ঞান মনস্কতার কথা বলব- তাঁরা নিজেরাই যেন আগেভাগে সচেতন হই। আসলে নিজেরা সচেতন না হলে অন্যদের সচেতন করব কিভাবে? মঞ্চে স্ত্রী-স্বাধীনতার স্বপক্ষে লম্বা-চওড়া বক্তব্য রেখে নিজের স্ত্রীকে যেন অনাকাঙ্ক্ষিত নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রবণতা প্রকাশ না করি!
বিজ্ঞান মনস্কতার কথা শুধু ভারী ভারী বক্তৃতা করে নয়, নিজেদের ঘর থেকেই বরং শুরু হোক। আপনার যাপনচিত্র তথা নিত্যদিনের ব্যবহার এবং আচার-আচরণে পরিবারের অন্য সদস্যরা যেন বুঝতে পারেন আপনি একজন বিজ্ঞান মনস্ক মানুষ। যাবতীয় কুসংস্কার কিংবা অন্ধ বিশ্বাসকে আপনি দু’পায়ে মাড়িয়ে চলেন। তাহলেই সেও কিন্তু উদ্বুদ্ধ হবে আপনাকে অনুসরণ করতে।
মনুষ্য সমাজের সিংহভাগ মানুষই শুনে নয়, দেখে শেখে। শিশুরা তো বটেই। এটাই আসলে মানুষের চিরায়ত বা স্বাভাবিক ধর্ম। আপনার প্রতিবেশী তথা আশপাশের সবাই না হলেও কিছু মানুষও তো আপনাকে দেখে প্রাণিত হবেন। আর এভাবেই বিজ্ঞান মনস্কতার পরিসর ক্রমশঃ বাড়বে। মঞ্চ বেঁধে কম্বুক কন্ঠে তথ্য-সমৃদ্ধ বক্তৃতা নয়, বাস্তব ঘটনার প্রেক্ষাপটে বিষয়গুলো তুলে ধরতে হবে।
এখানে-সেখানে ছোটো ছোটো আসর বসিয়ে অতি সহজ-সরলভাবে বিজ্ঞানের আলোয় কুসংস্কার এবং অন্ধ বিশ্বাসের বিরুদ্ধে গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা করতে হবে। বক্তার জ্ঞানের ভান্ডার তুলে ধরা নয়, কিংবা কথার কচকচানিও নয়, বাস্তব জীবনের প্রেক্ষাপটে বিষয়গুলোর ওপর আলোকপাত করতে হবে। শুধু বিজ্ঞান দিবসে নয়, সারা বছর ধরেই এই কাজটি আমাদের আন্তরিকতার সঙ্গে করতে হবে
এবং ধারাবাহিকভাবে। তা নাহলে প্রজন্মের পর প্রজন্ম মনের মধ্যে শিকড় গেড়ে থাকা কুসংস্কার ও অন্ধ বিশ্বাসকে উপড়ে ফেলা কখনও কোনও ভাবেই সম্ভব নয়। কথাগুলো মুখে বলা যতোটা সহজ-কাজে প্রতিফলিত করা ততোটাই কঠিন। কিন্তু কঠিন বলে তো আর সচেতনভাবে দূরে সরিয়ে রাখা যায়না৷ সমাজভাবনায় ভাবিত- তাঁরা উদাসীন থাকবেন কী করে?
আমরা যেন হাতে দামি পাথরের আংটি পরে জ্যোতিষশাস্ত্রের ভন্ডামী তথা কুসংস্কার এবং অন্ধ বিশ্বাসের বিরুদ্ধে কখনও সরব না হই। বিজ্ঞান সচেতনতার কথা না বলি। তাহলে তা হবে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে বসে ঝুপড়ি কিংবা ফুটপাতবাসীদের জন্য অশ্রু বিসর্জনের মতো! কিংবা তারকা খচিত রেস্তোরাঁয় ভালোমন্দ খেয়ে প্রান্তিক মানুষের জীবন-যন্ত্রণায় হা-পিত্যেশ করার মতো!
উল্লেখ্য, শহর ও শহরতলির পাশাপাশি গ্রাম-গঞ্জের প্রান্তিক এলাকায় জ্বেলে দিতে হবে বিজ্ঞানের আলো যে আলোয় আলোকিত হবেন জাতি-ধর্ম বর্ণ-সম্প্রদায় নির্বিশেষে কুসংস্কার আর অন্ধ বিশ্বাসে আটকে থাকা মানুষ। যুগ যুগ ধরে যে ‘বিশ্বাস’ মানুষকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে, তাকে একটানে বিচ্ছিন্ন করা মোটেই সহজ কাজ নয়। হাতে-গরম ফলও হয়তো পাওয়া যাবেনা; কিন্তু থেমে গেলে চলবে না।
স্বীকার্য, বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি বা সংগঠনগুলো এই গুরুত্বপূর্ণ কাজটি শুরু করেছিলেন অনেক আগেই। এখনও তাঁরা শহর ছাড়িয়ে বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে সমিতির শাখা খুলে কাজ করে যাচ্ছেন। প্রথাগত শিক্ষার বাইরে থাকা জাতি-ধর্ম বর্ণ-সম্প্রদায় নির্বিশেষে নানা বয়সের অনেক মানুষই তাতে বেশ আগ্রহ বোধ করছেনও। এটা কিন্ত আমাদের কাছে একটা আশার দিক নিঃসন্দেহে।
আর এভাবেই ধৈর্য ধরে সুচিন্তিত পথে ছোট্ট ছোট্ট পায়ে আমাদেরকে এগিয়ে যেতে হবে। তাহলেই একদিন-না-একদিন ঠিক পৌঁছে যাব আমাদের নির্দিষ্ট লক্ষ্যে। বিত্ত নির্বিশেষে ( অর্থাৎ ধনী-নির্ধন নির্বিশেষে) আমাদের দেশের প্রায় চল্লিশ কোটির ওপর মানুষ স্মার্টফোন ব্যবহার করেন। আক্ষরিক অর্থেই জুতো সেলাই থেকে চন্ডীপাঠ করেন যিনি বা যারা- তাঁদের হাতেও স্মার্টফোন এখন সহজলভ্য।
আর কে না জানেন, আজকের জনপ্রিয় সমাজ মাধ্যম (ফেসবুক-হোয়াটসঅ্যাপ-মেসেঞ্জার-ইন্সট্রাগ্রাম-টুইটর-এক্স হ্যান্ডেল) এখন প্রচারের সেরা মাধ্যম। এক লহমায় অনেক কিছুই ছড়িয়ে দেওয়া যায় এই মাধ্যমে। গোটা বিশ্বে। একে অনায়াসেই আমাদের প্রচারের অন্যতম প্রভাবশালী হাতিয়ার করা যেতেই পারে। তাহলে প্রচারের কাজ অনেকটাই সহজ হয়। তবে অত্যন্ত পরিকল্পিত ভাবে।
আবারও বলি, নিজেদের কাজ তথা বিশ্বাসের প্রতি নিজেদেরকে আগে আস্থাবান হতে হবে। এবং পরিবারের সদস্যদের মধ্য থেকেই শুরু করতে পারলে ভালো হয়। আপনাকে দেখে তাহলে অপরের পক্ষে বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়বে। এটারই আজ বড্ড অভাব। এই অভাবকে গুরুত্ব দিয়েই না হয় শুরু হোক বিজ্ঞানমনস্কতার সপক্ষে এবং কুসংস্কার আর অন্ধবিশ্বাসের বিরুদ্ধে আমাদের সম্মিলিত অভিযান।
এই প্রতিবেদন শেষ করি কবি-মনীষী রবিঠাকুরের কথা দিয়ে। আসলে তাঁকে বাদ দিয়ে কোনও কিছুই যেন সম্পূর্ণতা পায় না। ‘আমরা যাহা পালন করি তাহা বিশ্বাস করি না; যাহা বিশ্বাস করি তাহা পালন করি না।’ এই ‘বুর্জোয়া’ মানুষটি ‘জমিদার’ বংশে জন্ম নিলেও আপামর বাঙালিকে হাড়ে হাড়ে চিনেছিলেন। আমাদের কপটতা আমাদের ভন্ডামিকে কুঠারাঘাত করতে দ্বিধাবোধ করেননি।