• facebook
  • twitter
Friday, 5 December, 2025

শিল্পীর নবজন্ম

মনকে বুঝাইল যে আদর্শকে তাহারা রক্ষা করিতে চাহিতেছে ‘সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের’ মধ্যে তাহার প্রচার করাই উদ্দেশ্য সিদ্ধির প্রকৃষ্ট পথ।

ফাইল চিত্র

রম্যাঁ রলাঁ

পূর্ব প্রকাশিতর পর

Advertisement

এই সব পরিকল্পনার কি পরিণতি হইয়াছে তাহা আজ জানা কথা। কতকগুলি চতুর প্রতিক্রিয়াশীল দল ইহা আত্মসাৎ করিয়াছে। আজ বিশ্বসঙ্ঘের অভাব নাই— Institutes of Intellectual Co-operation, the Permanent Committees of Literature and Arts, the Pan-Europas রহিয়াছে। ব্যবসায় ও বুর্জোয়া আদর্শে পরিচালিত গভর্ণমেন্টগুলির আশ্রয়ে এইগুলি পরিপুষ্ট। (দুই আদর্শের একটি অন্যটিকে ছাড়িয়া থাকিতে পারে না)। যে সকল স্বাধীনচেতা ব্যক্তিকে স্পষ্টভাষণের জন্য সকলে ভয় করে এই সকল প্রতিষ্ঠান হইতে কৌশলে তাহাদের বাহিরে রাখা হইল। ভিতরে রহিলেন তাহারা বুদ্ধিজীবী জগতে প্রতিক্রিয়াশীলতার যাহারা প্রতিনিধি; সঙ্গে রহিলেন লেখাপড়া লইয়া ব্যস্ত থাকা নিরপেক্ষের দল, আর এমন কতকগুলি দেশ যাহারা সব ব্যাপারেই সগৌরবে নীরব থাকেন। অতএব যুদ্ধের মধ্যে মহৎ আদর্শগুলিকে বাঁচাইয়া রাখিবার যে সংগ্রাম আমরা করিয়াছিলাম, তাহাল ফলটুকু যুদ্ধের পরে আমাদের চরমতম শত্রুরাই হরণ করিয়া লইয়া গেল। এই সকল আদর্শের সাংঘাতিক শক্তি বুঝিতে পারিয়াছিল বলিয়াই তাহারা এক মুহূর্ত সময় নষ্ট করে নাই।

Advertisement

আইনকানুন স্বাধীনতা ও সভ্যতাকে যুদ্ধের মধ্যেই ত’ তাহারা চুরি করিয়া লইয়াছে। গণতান্ত্রিক ভাবধারা বাড়িয়াছে বটে, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে আদর্শগত প্রবঞ্চনার বৃদ্ধিও ত’ কখনও থামে নাই।

এই পাশ কাটানো আক্রমণকে প্রথম হইতেই প্রবলভাবে বাধা দিবার প্রয়োজন হইল। আমার লিলুলি (Liluli) নামক পুস্তকে আমার সাধ্যমত বাধা আমি দিলাম। বইখানি যুদ্ধের মধ্যেই জেনেভায় বসিয়া লিখি এবং সেখান হইতেই উহা প্রকাশিত হয়। কিন্তু এইটুকুই যথেষ্ট নহে। সূক্ষ্ণ বিদ্রূপ খুব কম লোককেই বেঁধে! যুদ্ধের জন্য চাই আরও মোটা হাতিয়ার। আমাদের প্রয়োজন ছিল ভারি কমানোর; কিন্তু ঘাঁটি রক্ষার উপযোগী শক্তি আমাদের ছিল না। যুদ্ধের কয়েক বৎসরের অগ্নি পরীক্ষা হইতে বাহিরে আসিয়া আমাদের অনেকে ব্যাধি ও মৃত্যুর কবলে পতিত হন। যুদ্ধবিরতি এবং শান্তির সন্ধি স্বাক্ষরের মাঝামাঝি সময়টাতে আমাদের শ্রেষ্ঠ সহকর্মী অনেকেরই জীবন তেল ফুরাইয়া যাওয়া প্রদীপের মত নিভিয়া গেল।

চারিদিকে শোকের ছায়া, নিজে বিয়োগবেদনায় কাতর, এই ভাবে দুইটি বৎসর আমি মৃত্যুর সাথে কাটাইলাম। আমাদের মধ্যে যাহাদের স্বাস্থ্য অটুট ছিল তাহারা নৈতিক পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হইয়া ছিলেন। মানুষ যে কতখানি হীন, কতখানি নির্বোধ, কতখানি পশু এবং কতখানি উদাসীন হইতে পারে, তাহা এবার তাহারা চোখের উপর দেখিয়াছিলেন। মানবতায় তাহাদের আর বিশ্বাস ছিল না। তাহারা মানুষের সংস্পর্শ হইতে পালাইয়া গেলেন, পালাইয়া গেলেন সেই আন্দোলনের মধ্য হইতে যে আন্দোলন তাহাদিগকে মানুষের সাথে মিলাইতে পারিত। যে কপটতাকে তাহাদের আঘাত করা, আক্রমণ করা উচিত ছিল সেই কপটতার প্রতি নিবিড় ঘৃণাই তাহাদিগকে সংগ্রাম হইতে দূরে সরাইয়া দিল, বাকি যাহারা রহিল তাহাদের এতখানি তীব্র অনুভূতি না থাকার ফলে বিরুদ্ধদলের আমন্ত্রণে তাহাদের সহিত একটা আপোশ নিষ্পত্তি করিয়া নিল। মনকে বুঝাইল যে আদর্শকে তাহারা রক্ষা করিতে চাহিতেছে ‘সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের’ মধ্যে তাহার প্রচার করাই উদ্দেশ্য সিদ্ধির প্রকৃষ্ট পথ।

অবশ্য ইহাকে পুরোপুরি আত্মপ্রবঞ্চনা বলা চলে না, এবং প্রাণপণে এই আদর্শকে সত্যই যদি তাঁহারা রক্ষা করিবার চেষ্টা করিতেন তবে তাঁহাদের কাজের একটা সার্থকতা থাকিত। (অবশ্য বেশিদিন ইহা চলিত না, অতি শীঘ্র নূতন বন্ধুদের বন্ধন ছিঁড়িয়া আসিতে তাহারা বাধ্য হইতেন)।

(ক্রমশ)

Advertisement